নিজস্ব প্রতিবেদক »
রমজানের শেষ বৃহস্পতিবারে ফের চড়া নগরীর নিত্যপণ্যের বাজার। ঈদকে কেন্দ্র করে বাজারগুলোতে বেড়েছে সব ধরনের মাছ, মাংস ও শাকসবজির দাম। এছাড়া বাজারগুলোতে এখনও সরকারের নির্ধারিত দামে মিলছে না খোলা চিনি। ঈদকেন্দ্রিক প্রয়োজনীয় পণ্যের চাহিদা বেড়ে যাওয়াতেই এই চাহিদাকে পুঁজি করে বাড়তি মুনাফার লোভে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয় অসাধু ব্যবসায়ীরা। প্রতি বছরের ন্যায় এবারও বাজারে একই চিত্র দেখা গেছে। ঈদ যতই ঘনিয়ে আসছে ততই ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে নিত্যপণ্যেও দাম।
এ ছাড়া নতুন করে বেড়েছে চিনি, পোলাওয়ের চাল, দুধ, সেমাই ও কিসমিসের। একইসঙ্গে মসলা জাতীয় পণ্যের মূল্যও বেড়েছে। তার মধ্যে গত ৬ মাসে ৫ দফা বেড়েছে চিনির দাম। সরকারের পক্ষ থেকে নির্ধারিত দরে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না এ পণ্য।
গতকাল বৃহস্পতিবার নগরীর বিভিন্ন খুচরা ও পাইকারি বাজার ঘুরে নিত্যপণ্যের দামে এমন চিত্রই দেখা গেছে। এবার পুরো রমজানজুড়েই নিত্যপণ্যের দামের লাগামহীন অবস্থায় ক্রেতা অসন্তোষ ছিল চরমে। বেশ কিছু পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হলেও বাজারে তার তেমন প্রভাব পড়েনি। এদিকে বাজার দর নিয়ন্ত্রণে তদারকি প্রতিষ্ঠানগুলো বেশ কিছু অভিযান পরিচালনা করলেও বাজার নিয়ন্ত্রণে আসেনি। তবে রমজানের শেষ দিকে নিত্যপণ্যের বাজারে কোনো অভিযান পরিচালনা হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে সাধারণ ক্রেতাদের।
ক্রেতারা অভিযোগ করে বলেন, রমজানের প্রথম দিকে বাজারগুলোতে কিছু অভিযান পরিচালনা করা হলেও শেষের দিকে হয়নি। এই সুযোগে অসাধু ব্যবসায়ীরা যে যেমন পেরেছে ভোক্তাদের পকেট কেটেছে।
গতকাল রমজানের শেষ বৃহস্পতিবার দুপুরে নগরীর রেয়াজউদ্দিন, ফিরিঙ্গী ও কাজীর দেউড়ি কাঁচাবাজার ঘুরে দেখা যায়, ঈদকে কেন্দ্র করে প্রায় সকল ভোগ্যপণ্যের দাম চড়া পাশাপাশি ঈদ উপলক্ষে প্রয়োজনীয় সেমাই, চিনি, কিসমিস, দুধ, ডিম, নুডলসসহ প্রায়সকল নিত্যপণ্যের। তাছাড়া গত একদিনের ব্যবধানে অধিকাংশ বাজারে গরুর মাংস কেজিতে দাম বেড়েছে প্রায় ৫০ থেকে ১০০ টাকা। গত মঙ্গলবার যে মানের গরুর মাংস ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকা বিক্রি হয়েছিল তা গতকাল বাজারে ৯০০ থেকে ৯৫০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়েছে। তার সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে খাসির মাংসের দামও। গতকাল থেকে বাজারে খাসি বিক্রি হয়েছে কেজিপ্রতি ১১০০ থেকে ১১৫০ টাকা।
বক্সিরহাটের শাহ আমানত মাংসের দোকানের জমির সওদাগর বলেন, ঈদ উপলক্ষে গরুর বাজারে দাম বাড়িয়েছে বিক্রেতারা। যার ফলে অনান্য দিনের তুলনায় আমাদের বেশি দরে কিনতে হয়েছে। তাই গরুর মাংসের বাজার একটু চড়া।
শুধু গরুর মাংস নয় ঈদকে কেন্দ্র করে বেড়েছে ব্রয়লার, সোনালি ও দেশী মুরগির দামও বেশ চড়া। ব্রয়লার মুরগির দাম তিনশো ছুঁই ছুঁই। যা এখন আর সাধারণ ক্রেতাদের
নাগালে নেই। গত মঙ্গলবার প্রতিকেজি ব্রয়লার ১৮০ থেকে ১৯৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হলেও দুইদিনের ব্যবধানে ব্রয়লার মুরগির দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি ৮০ থেকে ৯০ টাকা। গতকাল বাজারে ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হয়েছে ২৬০ থেকে ২৮০ টাকা দরে। আর সোনালি মুরগির কেজিতে প্রায় ৭০ থেকে ৮০ টাকা বেড়ে বিক্রি হয়েছে ৩৭০ থেকে ৩৮০ টাকা দরে। আর দেশী মুরগির দাম কেজিতে ৬৫০ টাকার উপরে। যা ঈদের আগের দিন থেকে আরও বাড়তে পারে বলে জানিয়েছে ব্যবসায়ীরা।
পোল্ট্রি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান মোজাম্মেল ব্রার্দাসের মালিক মো. মোজাম্মেল হক বলেন, ফার্মের মালিকরা গত দুইদিন ধরে কম দামে মুরগি বিক্রি করলে আমরা কমদামে বিক্রি করি। কিন্তু আজ (বৃহস্পতিবার) থেকে ফার্মের মালিকরা চড়া দামে বিক্রি করছে। আজকে আমাদের কিনতে হয়েছে ব্রয়লার মুরগি কেজিপ্রতি ২৩৫ টাকা। খরচাদিসহ হিসেব করলে কেজিপ্রতি ২৪২ টাকার উপরে পড়েছে। যার ফলে একটু বাড়তি দরে ব্যবসায়ীরা মুরগি বিক্রি করছে। ঈদকে কেন্দ্র ব্রয়লারের দাম আরো বাড়তে পারে। বাজার তদারকি প্রতিষ্ঠানগুলোকে তদারকি করতে হবে পোল্ট্রি মালিকদের সংস্থাগুলোতে।
এদিকে ঈদকে কেন্দ্র করে বেড়েছে তেলাপিয়া, রুই, কাতলাসহ সকল ধরনের দেশীয় মাছের দাম। বাজারে ২০০ থেকে ২৫০ টাকার নিচে কোন ধরনের মাছ নেই। তাছাড়া সব ধরনের চিংড়ি বিক্রি হয়েছে ৯০০ টাকার ওপরে। সপ্তাহের ব্যবধানে সকল ধরনের মাছে ৫০ থেকে ৮০ টাকা বেড়েছে।
গতকাল বাজারে প্রতি কেজি রুই-কাতলার মত কার্প জাতীয় মাছ বিক্রি হয়েছে ৩০০ থেকে ৩৮০ টাকা কেজিতে। সমুদ্রের পোয়া ২৫০ টাকা, আইড় ৩০০ টাকা, বাটা ২৮০ থেকে ৩০০ টাকা বিক্রি হয়েছে। তাছাড়া প্রজেক্টের চাষের পাঙ্গাস ও তেলাপিয়া বিক্রি হয়েছে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা কেজিতে।
খুচরা বিক্রেতারা জানান, ঈদে চিংড়ির কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি হয়েছে। গত তিন দিন ধরে প্রজেক্টের ও লেকে তেমন চিংড়ি বাজারে আসেনি। যার ফলে চিংড়ির একটু দাম বৃদ্ধি। অন্যদিকে সমুদ্রের মাছ ধরা নিষেধের কারণে এবং ঈদে ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী যোগানের স্বল্পতার কারণে সকল ধরনের মাছের দাম বাড়তি চলছে। এভাবে আরও এক সপ্তাহ চলবে বলে তারা জানান।
অন্যদিকে এক সপ্তাহের ব্যবধানে খোলা ও প্যাকেটজাত পোলাওর চাল চড়া দরে বিক্রি হয়েছে। গতকাল বাজারে খোলা পোলাও চাল বিক্রি হয়েছে ১০০ থেকে ১২০ টাকা এবং প্যাকেটজাত চাল বিক্রি হয়েছে ১৫০ থেকে ১৫৫ টাকা কেজিতে।
এদিকে একের পর শুল্ক ছাড়া ও বাজার দর নির্ধারণ করার পরও নিয়ন্ত্রণ আসেনি চিনির দাম। পরিশোধিত খোলা চিনির সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিল কেজিতে ১০৪ টাকা। আর পরিশোধিত প্যাকেটজাত চিনির দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল কেজিতে ১০৯ টাকা। দাম নির্ধারণের দুই সপ্তাহ পরেও বাজারে দাম কমার কোন প্রভাব পড়েনি। বরং ঈদকে কেন্দ্র করে বাজারে আগের চেয়ে আরো চড়া দামে বিক্রয় করছে এ পণ্য। তার জন্য বাজার তদারকি প্রতিষ্টানগুলোকে দুষছেন ভোক্তারা।
গতকাল নগরীর বাজারগুলোতে খুচরা বাজারে ১২০ থেকে ১২৫ টাকা কেজিতে চিনি বিক্রি করছে ব্যবসায়ীরা। যা গত সপ্তাহেও ছিল ১১০ থেকে ১১৫ টাকা কেজিতে। তাছাড়া গত ৬ এপ্রিল সরকারের পক্ষ থেকে দর নির্ধারণ করে দেন এ পণ্যের যা ৮ এপ্রিল থেকে কার্যকর হয়েছে।
ফিরিঙ্গি বাজারের চিনি ক্রেতা মো. সালাম বলেন, সরকার শুল্ক কমালো, দাম নির্ধারণ করে দিল। অথচ ব্যবসায়ীরা এসব নীতিমালা কোন ধরনের তোয়াক্কা করছে না। শুধু চিনি নয়। ঈদকে কেন্দ্র করে সকল ধরনের নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়েছে ব্যবসায়ীরা। রমজানের শুরুতে কয়েকদিন প্রশাসন নিত্যপণ্যের বাজার তদারকি করলেও শেষের দিকে ঢিলেঢালাভাবে তদারকি করছে। যার ফলে ব্যবসায়ীরা তাদের মনগড়া দরে নিত্যপণ্য বিক্রি করার সুযোগ পাচ্ছে।
এদিকে রমজানের শেষের দিকে এসেও সহনীয় পর্যায়ে আসেনি সবজির বাজার। গতকাল অধিকাংশ সবজি বিক্রি হয়েছে ৬০-৭০ টাকার ওপরে। প্রতিকেজি ভালো মানের বেগুন বিক্রি হয়েছে ৮০-১০০ টাকার মধ্যে। ঢেঁড়স, লাউ, পটল, বরবটি ও ধুন্দল ও করলা কেজি বিক্রি হয়েছে ৬০-৭০ টাকার মধ্যে।
এ ছাড়া বাজারে ৫০০ গ্রামের ডিপ্লোমা ও ডানো প্যাকেটজাত গুঁড়োদুধ বিক্রি হয়েছে ৩৬০ টাকায়। যা এক মাস আগে ৩৩০-৩৪০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এক কেজির ফ্রেশ প্যাকেটজাত গুঁড়োদুধ বিক্রি হয়েছে ৬২০ টাকায়। যা এক মাস আগে ৫৯০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এক কেজি ওজনের মার্কস গুঁড়োদুধ বিক্রি হয়েছে ৬০০ টাকা, যা আগে ৫৮০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। ২০০ গ্রামের প্যাকেটজাত লাচ্ছা সেমাই বিক্রি হয়েছে ৪৫-৫০ টাকায়। যা এক মাস আগে ছিল ৩৫ টাকা। ২০০ গ্রামের প্যাকেটজাত চিকন সেমাই বিক্রি হচ্ছে ৪০-৪৫ টাকায়। যা আগে বিক্রি হয়েছে ৩০-৩৫ টাকায়।
কনজ্যুমার অ্যাশোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাবের) ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন বলেন, প্রশাসন রোজার শুরুতে যেভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণের কথা প্রকাশ করছে আসলে সেভাবেই কোন কিছু হয়নি। তবে অন্যান্য বছরের তুলনায় এবছর নিত্যপণ্যের বাজারে ক্রেতার চাপ কিছুটা কমেছে। সেটি হতে পারে ক্রেতাদের সচেতনতা বা ক্রয়ক্ষমতার হ্রাস। তবে ঈদ উপলক্ষে চিনি-সেমাইসহ নিত্যপণ্যের দাম যেন অস্থির না হয় এ বিষয়ে তদারকি প্রতিষ্ঠানগুলোর অবশ্যই নজরদারির প্রয়োজন।
এদিকে চিনিসহ নিত্যপণ্যের বাজার তদারকির বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আনিসুর রহমান বলেন, ৮ তারিখ থেকে চিনি মন্ত্রণালয়ের বেঁধে দেওয়া নতুন দরে বিক্রির কথা থাকলেও আমাদের কাছে অভিযোগ এসেছে যে অনেক প্রতিষ্ঠান এখনো আগের দরে বিক্রয় করছে। আমরা এ বিষয়ে তদারকি করবো। তাছাড়া নতুন দর কার্যকর হওয়ার পর চিনির দাম বেশি রাখার কারনে মনিটরিংয়ে আমরা একটি প্রতিষ্ঠানকেও জরিমানা করেছিলাম। ব্যবসায়ীদের অনিয়ম ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত থাকবে।