বিধান চন্দ্র পাল »
নারী সুরক্ষা ও মর্যাদা তথা অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন আর সামাজিক ও পরিবেশ সুরক্ষার আন্দোলন যেন এক সূত্রেই গাঁথা। দুটির মাঝে এক ধরনের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। একটিকে বাদ দিয়ে অপরটির অর্জন সম্ভব নয়। একদিকে যেমন সার্বিক পরিবেশের সুরক্ষা সুস্থভাবে নিশ্চিত হলেই নারী সুরক্ষা ও মর্যাদা তথা অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে।
অন্যদিকে তেমনি নারীর ক্ষমতায়ন এবং সার্বিকভাবে নারী সুরক্ষা ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা পরিবেশ ও সামাজিক সুরক্ষা আন্দোলনেরও অন্যতম পূর্বশর্ত।
ফলে সাম্প্রতিক সময়ে নারী নির্যাতনকারী ও ধর্ষণকারীদের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে যে এত প্রতিবাদ হচ্ছে, সকল পরিবেশবাদীদের পক্ষ থেকেও সেটার পক্ষে পূর্ণ ও যৌক্তিক সমর্থন রয়েছে এবং থাকাটাই স্বাভাবিক বলে আমি মনে করি।
আমরা জানি, পরিবেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ রূপ হলো সামাজিক। এই সামাজিক পরিবেশের আওতায় পড়ে মানুষের সঙ্গে মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের দিকটি। এই পারস্পরিক সম্পর্কও পরিবেশকে নানাভাবে বিপর্যস্ত করে। যেমন: নারী-পুরুষ উভয়ে মিলেই পরিবার ও সমাজ।
উভয়ের শ্রম ও মেধার সমন্বয়েই জীবন-জীবিকা, পরিবার ও সমাজ পরিচালিত হয়। একত্রিত উদ্যোগেই সভ্যতার বিকাশ হয়। অথচ জীবনের প্রায় সকল ক্ষেত্রেই আমরা নারী ও পুরুষের মধ্যে অসমতা ও বৈষম্য দেখতে পাই।
বিবিসিতে গত ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২০ তারিখে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, “বাংলাদেশের শ্রমশক্তির ৮৭ শতাংশেরই কর্মসংস্থান হয় অনানুষ্ঠানিক খাতে। যেখানে নারীর সংখ্যাই বেশি। শ্রম জরিপের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে নারীদের ৯২ শতাংশের কর্মসংস্থান এখনো অনানুষ্ঠানিক খাতে।
বাংলাদেশে সরকারি বেসরকারি চাকরি তথা আনুষ্ঠানিক খাতে নারী পুরুষের বেতন বৈষম্য অনেকটা কম হলেও অনানুষ্ঠানিক খাতে বৈষম্য এখনো অনেক বেশি।”
আবার বিশ্বব্যাংকের উইমেন, বিজনেস অ্যান্ড দ্য ল ২০২০ ইনডেক্স শীর্ষক প্রতিবেদনের তথ্যমতে, বাংলাদেশের উৎপাদন খাতে ক্লিনিং, লুব্রিকেটিং ও যন্ত্রাংশ সংযোজনের কাজে নারীদের অংশগ্রহণে আইনি বাধা আছে। অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণের সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান নিচের দিকে। (সূত্র : প্রথম আলো, ৮ মার্চ, ২০২০)
ফলে এটা সুস্পষ্ট যে, বৈষম্য বিরাজমান। এই বৈষম্য একদিকে কাজ ও দায়-দায়িত্বের ক্ষেত্রে, সুযোগের ক্ষেত্রে, মর্যাদা ও অধিকার নিয়ন্ত্রণ কিংবা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে, মতামত প্রকাশ ও পছন্দের ক্ষেত্রে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে।
এটা শুধু কোন এক শ্রেণির মধ্যে নয় বরং শ্রেণি, পেশা, ধর্ম, বর্ণ, শিক্ষিত-স্বশিক্ষিত কিংবা নিরক্ষর, গ্রাম-শহর, বাঙালি-পাহাড়ী প্রতিটি ক্ষেত্রে ও পর্যায়েই রয়েছে। এই বৈষম্য যে শুধু আমাদের দেশেই রয়েছে তা নয়, বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই এই অসমতা বিরাজমান, তবে এর মাত্রাগত তারতম্য রয়েছে।
নারী-পুরুষের মধ্যেকার বিরাজিত এই বৈষম্য আমাদের পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সুস্থ পরিবেশ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এবং সার্বিকভাবে উন্নয়নের ক্ষেত্রেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। আর এর ফলাফল স্বাভাবিকভাবেই নারী-পুরুষ উভয়েই ভোগ করছে।
সাম্প্রতিক সময়ে কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাসের বিভিন্নমুখি প্রভাবের কারণে নারী নির্যাতনের হার আশঙ্কাজনকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে বলে অনেকে ধারণা করেন। এই হার বৃদ্ধি পাওয়ার পুরোনো অনেক কারণ রয়েছে; যেমন: সন্ত্রাসী রাজনৈতিক সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক চাপের নেতিবাচক প্রভাব, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির দুর্বলতা ও অবনতি, মানুষের জীবনের নিরাপত্তাহীনতা, উপযোগী বিনোদনের মাধ্যম কিংবা ক্ষেত্র খুঁজে না পাওয়া ইত্যাদি। সেইসাথে যুক্ত হয়েছে নানা ধরনের নতুন প্রভাবসমূহ; যেমন: প্রযুক্তি ও আকাশ সংস্কৃতির নেতিবাচক প্রভাব, বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে অশ্লীল ছবি, খবর এবং ভিডিও’র সহজপ্রাপ্যতা, দরকারি কিংবা প্রয়োজনীয় বিভিন্ন বিষয়ে যেমন: অনলাইনে কেনাকাটা, অনলাইনে পত্রিকা পড়া ইত্যাদি ক্ষেত্রে অশ্লীল দৃশ্য ও প্রলোভনের হাতছানি। পুঁজিবাদী সমাজে যথেচ্ছাচারে বিভিন্ন উপকরণ কিংবা পণ্যের সাথে নারীকে অশোভনীয়ভাবে উপস্থাপন করার কথাও এর সাথে বিশেষভাবে যোগ করা যেতে পারে।
ফলে নারী নির্যাতন এখন আর স্বাভাবিক পর্যায়ে নেই। এই নির্যাতন এখন নিকৃষ্টতম পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে। আর এই নিকৃষ্টতার অন্যতম উদাহরণ ধর্ষণ। শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত কোন নারীই এখন ধর্ষণের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। আমরা জানি ধর্ষণ, এটা অন্য আর দশটা অপরাধ থেকে একটু ভিন্ন। কারণ এটা নারীর শরীর, স্বাতন্ত্র্যবোধ, আত্মমর্যাদাবোধ ও সত্তার ওপর আঘাত হানে। এখানে নারী এই অপরাধের শিকার হয়ে যাবার পর তাকে পারিবারিকভাবে করুণার চোখে দেখা হয়, সামাজিকভাবে বিব্রতকর অবস্থার সম্মুখিন হতে হয়, তার ওপর কলঙ্ক লেপে দেয়া হয় এবং এই একটি ঘটনার জন্য তাকে সারাজীবন নানা রকমের সামাজিক গঞ্জনাও মেনে চলতে হয়। অথচ এই ঘটনার জন্য সেই নারী কোনভাবেই দায়ী নয়।
সুতরাং পরিবার ও সমাজের এসব নানামুখি দৃষ্টিভঙ্গির কারণে অধিকাংশ ধর্ষণের ঘটনাই গোপন থেকে যায়, স্বাভাবিক কারণে থানাতেও ধর্ষণের অভিযোগ কম আসে।
আবার অন্যদিকে আইনি প্রক্রিয়াটিও নারীর জন্য খুব সহায়ক নয়। সেজন্য অনেক মামলাই আদালত পর্যন্ত যেতে পারে না। আদালতে সাক্ষ্য দেয়ার মতো ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মধ্যে অনেকে যেতে অনাগ্রহ পোষণ করেন। আবার পরিবার থেকেও এসব ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করা হয়। থানায় যাওয়া, মেডিক্যাল পরীক্ষা করানো, আদালতে দাঁড়ানো এ সবকিছুই নারীর জন্য এক কঠিন পরীক্ষার মতো একটা বিষয়। এ অসহনীয় পরীক্ষার মুখোমুখি হতে না চাওয়াটাই স্বাভাবিক, ফলে বেশিরভাগ নারী নীরব ও নিশ্চুপ হয়েই থেকে যায়। কারণ আইনি প্রক্রিয়ার মুখোমুখি হওয়াকে অনেকেই দ্বিতীয়বার ধর্ষণের শিকার হওয়ার সামিল বলেই গণ্য করেন।
এই ধরনের একটি প্রেক্ষাপটে ধর্ষণকারী সহজে রেহাই পেয়ে যান অন্যদিকে তেমনি সমাজে জন্ম নেয় আরেকটি ধর্ষণের সমূহ সম্ভাবনা। ফলে সাম্প্রতিক সময়ে ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদ-ের বিধান রেখে আইনের খসড়া অনুমোদন করায় ধর্ষণের মতো ঘৃণ্যতম সামাজিক অপরাধের অবসান হবে কি-না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে। একইসাথে শুধু এই সাজা যোগ হবার কারণে (নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৩৪টি ধারার মধ্যে ৭টি ধারায়, মৃত্যুদ-ের বিধান আগেই আছে। সূত্র: প্রথম আলো ১৩ অক্টোবর, ২০২০) ধর্ষণকারীরা শাস্তির ভয়ে আর ধর্ষণ করবে না- এটা ভাবাটা অমূলক হবে। ফলে এটা সুস্পষ্ট যে, এর মধ্য দিয়ে মূল সমস্যার সমাধান আসলে হবে না।
যে স্বপ্ন ও সম্ভাবনা নিয়ে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল সেই গণতন্ত্র, পরিবেশসহ সবক্ষেত্রে সুশাসন এবং মানুষে মানুষে সম-অধিকার সত্যিকারভাবেই কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে? কেনো এদেশের নারীরা আজও সুরক্ষার দাবিতে, নিরাপত্তার দাবিতে, ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে এবং সমতা প্রতিষ্ঠার জন্য বারবার আন্দোলনের মুখোমুখি হবে? এদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারীকে বাদ দিয়ে সার্বিক জাতীয় উন্নয়ন সম্ভব নয় জেনেও এক শ্রেণির ক্ষমতালোভী মানুষ নারী উন্নয়নের শ্রোতকে কেন বারবার বিভিন্নভাবে বাধাগ্রস্থ করে চলেছে? কীভাবে তারা এই সুযোগগুলো পাচ্ছে? কেন পাচ্ছে? কেন নানা ধরনের পদক্ষেপ নিয়েও সেসব বন্ধ করা যাচ্ছে না?
বাংলাদেশে বিদ্যমান সামাজিক ও পরিবেশ সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য এবং নারীর সুরক্ষা ও অধিকার নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় নীতি ও আইন রয়েছে। এগুলোর সুষ্ঠু বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা ছাড়া এসডিজি গোলসমূহের লক্ষ্যমালা অর্জন করা তথা স্থায়িত্বশীল উন্নয়ন কখনোই সম্ভব নয়।
অন্যদিকে এটাও আজ সর্বজনস্বীকৃত যে, শুধু আইনগত প্রতিকার ধর্ষণসহ যেকোন ধরনের নারী নির্যাতন প্রতিরোধের ক্ষেত্রে যথেষ্ট নয়। এর জন্য প্রয়োজন সম্মিলিত সামাজিক প্রতিরোধ।
কেননা ক্রমবর্ধমান নারী নির্যাতনের বিপরীতে বিচারহীনতা পরিস্থিতিকে আরো ভয়াবহ করে তুলেছে। ফলে সামাজিক প্রতিরোধের প্রয়োজনীয়তা আরো তীব্রভাবে অনুভূত হচ্ছে। আর এই প্রতিরোধ কর্মকা-েও নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের অংশগ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ। সামাজিক প্রতিরোধ শুধু তাৎক্ষণিকভাবে নয়, বিচার হওয়া পর্যন্ত বিভিন্নভাবে অব্যাহত রাখাটা জরুরি।
রাজনীতিবিদ, উন্নয়নবিদ, পরিকল্পনাবিদসহ সর্বস্তরের মানুষকে সকল নারীর সুরক্ষা ও মর্যাদা নিশ্চিতকরণে এবং সার্বিক পরিবেশ সংরক্ষণে এগিয়ে আসতে হবে। উন্নয়ন পরিকল্পনাকে করে তুলতে হবে অন্যায়হীন, পরিবেশের সাথে সঙ্গতি ও সমতাপূর্ণ এবং নির্যাতনমুক্ত নারীবান্ধব।
‘সচেতনতা’ একটি শব্দ কিন্তু এই শব্দটিকে জয় করতে হবে প্রতিটি মানুষকে- প্রতিটি ক্ষেত্রে ভিন্নরকমভাবে। এজন্য জাতীয়ভাবে উপযুক্ত সচেতনতামূলক শিক্ষা এবং বিভিন্ন কার্যক্রমও থাকতে হবে।
নারীর জন্য সুরক্ষার সচেতনতা এবং নারীদের প্রতি মর্যাদা ও সংবেদনশীল আচরণ পালনে সচেতন হয়ে উঠতে হবে যেমন সবাইকে, তেমনিভাবে পরিবেশের প্রতিও সচেতন ও দায়িত্বশীল হতে হবে প্রতিটি মানুষকে। এই দুটি ক্ষেত্রেই দল-মত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে এক হয়ে কাজ করতে হবে। তাহলেই হয়তো আমাদের চারপাশ সবদিক থেকে সুস্থ, সুন্দর ও আবারও স্বাভাবিক হবে।
লেখক : পরিবেশ আন্দোলনের সংগঠক