হাবিবুল হক বিপ্লব »
মানুষ হিসেবে অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি নিয়েই একসময় আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন শুরু হয়েছিল। সেই লড়াই এখনো চলছে। আপাতদৃষ্টিতে গত দুশ বছরে নারীর অনেক অর্জন আছে। তারপরও পুরুষতন্ত্রের সর্বগ্রাসী ও কর্র্তৃত্ববাদী সমাজ নারীকে সব সময়ই পেছনে টেনে ধরে রাখছে। ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। মনে রাখা দরকার, নারীর আসল লড়াইটা কিন্তু পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে। পুরুষতন্ত্র নারীকে শুধুই নারী বানিয়ে দেয়, নারী বানিয়ে রাখে।
নারীরা ঘরের কাজ করবে, নারীদের বুদ্ধি কম, শক্তি কম, নারীরা ঘরের শোভা, নারীরা যত সর্বনাশের গোড়া এমনি বিশ্বাস ও কথামালা দিয়ে নারীকে প্রতিনিয়ত অধস্তন করে রাখার জাল বোনা হয়। বলা হয়, নারীরা পারে না, কিন্তু পুরুষরা সব পারে। তারপর যদি কোনো নারী কোনো কিছু পেরে যায় তখন বিস্ময় প্রকাশের মাধ্যমে তাকে ব্যতিক্রম বানিয়ে ফেলা হয়। বলা হয়, ‘কী অসাধারণ, সত্যি, মেয়ে হয়েও!’। পুরুষতন্ত্র আসলে মেয়েদের যোগ্যতা ও দক্ষতা স্বীকার করতে চায় না। তাদের অধিকার ও কর্র্তৃত্ব মেনে নিতে পারে না। নিজের কর্র্তৃত্ব ও ক্ষমতা অটুট রাখতে তাই সে এক কৌশল বানিয়েছে; একটা মন্ত্র। মন্ত্রটা হলো ‘সত্যি, মেয়ে হয়েও!’। যে মেয়ে এগিয়ে যাবে, যে মেয়ে উঠে দাঁড়াবে, যে মেয়ে পৌঁছাবে কিংবা পৌঁছাতে চেষ্টা করবে জীবনপণ, তাকে দেখিয়ে সমস্বরে বলা হবে, ‘সত্যি, কী অসাধারণ, মেয়ে হয়েও!’।
নারীর কৃতিত্ব কৌশলে অস্বীকার করা পুরুষতন্ত্রের এ এক নতুন কৌশল। মেয়েরা পারে, তাদের না পারার কোনো কারণ নেই। যে মেয়েরা পারে তাদের কারও দশটা হাত নেই। দেবী দুর্গার সঙ্গে তুলনা করে তাদের ‘মাল্টিটাস্কিং স্কিল’-এর উদ্দেশ্যে পুষ্পাঞ্জলি না দিয়ে বরং পারলে দু-একটা টাস্ক সামলে দিলে সমাজ ও সভ্যতার অনেক উপকার হয়! কিন্তু আমাদের সমাজে তা হয় না। কেন বহু পুরুষ (এবং পুরুষতন্ত্রের পুতুল বহু নারীও) মেয়েদের লাঞ্ছনার জন্য মেয়েদেরই দায়ী করেন? কেন পুরুষতন্ত্র এমন ধারণা লালন করে? সম্ভবত তার একটি কারণ, দায় অন্যের ঘাড়ে না চাপাতে পারলে সেই কাজের দায়িত্ব নিতে হবে এবং সর্বোপরি নিজের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। যে জবাবদিহি হয়তো পুরুষতন্ত্রের ভিত নাড়িয়ে দিতে পারে। আরেকটি কারণ, পুরুষতন্ত্র ক্ষমতার তন্ত্র। আর ক্ষমতা নিজেকে প্রশ্ন করতে চায় না। নিজের কাছে জবাবদিহি করতে তো চায়-ই না। অতএব পুরুষতন্ত্র আপন অন্যায়ের দায় ক্রমাগত মেয়েদের ওপর চাপিয়ে দিতে প্রবৃত্ত হয়। এটা অবশ্য ক্ষমতারই স্বভাব। ঘরে বা বাইরে, ক্ষমতা কোনো অবস্থায়ই নিজের দায় স্বীকার করতে চায় না। আবার সে কারণেই ক্রমাগত ক্ষমতাতন্ত্রকে কঠিন প্রশ্নের মুখে ফেলা দরকার।
মেয়েদের পুরুষের তুলনায় অক্ষম, হীন করে দেখার মেয়েদের লাঞ্ছনার জন্য মেয়েদেরই দায়ী করার যেকোনো চেষ্টাই তাই প্রবল প্রতিবাদের যোগ্য। পুরুষতন্ত্র নারীকে গৃহে বন্দি করেছে, তাকে সতীত্ব শিখিয়েছে, সতীত্বকে নারীর জীবনের মুকুট করে তুলেছে, যদিও লাম্পট্যকেই করে তুলেছে নিজের গৌরব। সমাজের সব মূল্যবোধ, আইন, নীতি, ধর্ম, নিয়ম পুরুষদের সৃষ্টি, পুরুষতান্ত্রিকতার ফল। ‘সতীত্ব’ বা ‘ভার্জিনিটি’ তকমাটা পুরুষশাসিত সমাজই নারীদের দিয়েছে। এই ‘সতীত্বের’ ধারণা টিকিয়ে রাখতে পুরুষতন্ত্রের চেষ্টার কোনো কমতি নেই। তারা ভাবছে, ‘সতীত্বের’ ধারণা ছাড়া নারীকে হয়তো আর তাদের একচ্ছত্র মালিকানায় বেঁধে রাখা যাবে না। এই ধারণাগুলোয় আঘাত হানার দিন এসেছে। মনে রাখতে হবে, কোনো নারীর সম্মান তার যৌনাঙ্গে নেই। আছে তার শিক্ষায়, রুচিতে, ব্যবহারে, সর্বোপরি তার হৃদয়ে। এমন অনেক নারী আগেও ছিলেন, এখনো আছেন, যারা ‘স্বামী’ নামক অপরিচিত প্রথম দেখা পুরুষটির কাছে ফুলশয্যার রাতে তার ‘সতীত্ব’ সমর্পণ করে দেন।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায়, জীবনে সুদীর্ঘ চল্লিশ কী পঞ্চাশ বছর তারা একত্রে বসবাস করা সত্ত্বেও কেউ কারও হৃদয়ের কাছাকাছি আসতে পারেননি, কেউ কারও প্রেমাস্পদ হয়ে উঠতে পারেননি। হয়তো সংসারের বা সমাজের তাগিদে বা সন্তানদের দিকে তাকিয়ে তারা একত্রে থেকে গেছেন। কিন্তু মনের মিল কখনোই হয়নি। অথচ পুরুষতান্ত্রিক রীতিনীতির কাছে আত্মসমর্পণ করার কারণে নিজের ব্যক্তিত্ব ও স্বাধীনতা বিসর্জন দিয়ে এই অস্বাভাবিক সম্পর্কই টিকিয়ে রাখেন। এভাবে পুরুষতন্ত্র নারীকে ‘একা’ এবং ‘আলাদা’ বানিয়ে দেয়। পুরুষতন্ত্রের আক্রমণের নতুন বিষয়বস্তু হয়েছে নারীর পোশাক। বর্তমানে নারী নির্যাতন কিংবা ধর্ষণের জন্য নারীর পোশাককেই সবচেয়ে বেশি দায়ী করা হয়। যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নিই যে, কোনো আধুনিকাকে দেখে কোনো পুরুষ কামার্ত বোধ করলেন, স্মরণে রাখতে হবে, তাও সেই পুরুষটির ব্যক্তিগত অনুভূতি। সেই অনুভবের দায় কোনো নারীর ওপরে চাপিয়ে দেওয়া শুধু অশালীন নয়, অ-সভ্যও বটে। ব্যক্তির স্বাধীনতা একটি গভীর বস্তু। সমস্যা হলো, ‘ব্যক্তি’ অর্থে কার্যত ‘পুরুষ’কেই গণ্য করা হয়।
লিঙ্গ-পরিচয় একটি বিশেষ খাঁচার ভেতরেই আবদ্ধ থাকে। নারী আড়ালেই পড়ে যায়। পুরুষরা নারীকে সন্দেহ করে। নারীকে নিয়ে এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বে ভোগে। আসলে সন্দেহ, ঈর্ষা, দ্বেষ এসবের তল খুঁজতে গেলে শেষ অবধি যেখানে পৌঁছে যাই আমরা, তার নাম ক্ষমতা। পুরুষতন্ত্র সেই ক্ষমতার তন্ত্র। ক্ষমতা পাওয়ার এই লোভ বা ফন্দিফিকির, এটাই পুরুষের মনে বুনে দেয় হিংসা, পুরুষকে করে তোলে সন্দিগ্ধচিত্ত। এই ক্ষমতার জোরেই নারীর গৃহস্থালি ভূমিকা হয় অস্বীকৃত। এই ক্ষমতার দম্ভেই চূর্ণ হয় নারীর অধিকার। হুমায়ুন আজাদ যথার্থই বলেছেন, ‘ক্ষমতাবান পুরুষ পছন্দ করে নম্র, অনুগত মেয়েকে।
পুরুষ নারীকে দেখে দাসীরূপে, করে রেখেছে দাসী; তবে স্বার্থে ও ভয়ে কখনো স্তব করে দেবীরূপে।’ নানা বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে নারীরা আজকাল বাইরের কাজের জগতে প্রবেশ করেছে। নারীর স্বনির্ভরতা পুরুষতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে বিপন্ন করে তুলছে। নারী হয়ে উঠেছে পুরুষের প্রতিদ্বন্দ্বী। এ অবস্থায় পুরুষতন্ত্র সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে। আবারও পুরুষতন্ত্র পুরনো অস্ত্র নতুন করে শান দিয়ে মাঠে নেমেছে। এই অস্ত্রের নাম হলো নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা ও যৌন-সন্ত্রাস। নারীর নিরাপত্তা, আত্মসম্মান, স্বাধীন চিন্তার সুযোগ কেড়ে নিলেই কেবল পুরুষ নিশ্চিন্ত হতে পারে এবং তার সবচেয়ে সহজ উপায় হলো যৌন-নির্যাতন। একজন নারী কেবল পুরুষকে ‘সুখ দেওয়ার একটা শরীর, তার বেশি কিছু নয়’ পুরুষের এটা বারবার মনে করার এবং মনে করানোর প্রয়োজনীয়তা এখন তীব্র। নারীকে গায়ের জোরে অসহায় করে ফেলতে পারলে একদিকে তার ‘স্পর্ধা’ গুঁড়িয়ে দেওয়া যায়, অন্যদিকে ‘পৌরুষের’ তীব্র মনোবেদনা কিছুটা হলেও প্রশমিত হয়। ঘরে-বাইরে নারীর ওপর আগ্রাসী যৌন আচরণ, যৌন হয়রানি, যৌন নিপীড়ন, ধর্ষণ সবই পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতা কাঠামোয় নারীর অধস্তনতাই প্রকাশ করে।
তাই ধর্ষণ, যৌন হয়রানি/নিপীড়ন, নারীর সম্মতি ছাড়া তার ওপর যেকোনো ধরনের আগ্রাসী যৌন আচরণ ক্ষমতা প্রদর্শনের, দমন-পীড়নের, কর্র্তৃত্ব করার কুৎসিত বহিঃপ্রকাশ ছাড়া আর কিছু নয়। দৃষ্টিভঙ্গিটা পুরুষতান্ত্রিক বলেই নারীকে তারা গণ্য করে অধস্তন লৈঙ্গিক পরিচয়ের বস্তু হিসেবে যা পীড়নযোগ্য। এটা মনে রাখা জরুরি যে, নারীকে অবদমিত করে রাখার মানসিকতা একটি সামাজিক ক্ষমতায়নের প্রক্রিয়া। একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়াও বটে। সামাজিক মননের পরিবর্তন না হলে সেই প্রক্রিয়া থামানো সম্ভব নয়।
ক্ষমতাতন্ত্রকে পাল্টে দেবে এমন ব্যক্তি সমাজে একেবারেই কম। তা ছাড়া এটা একা কোনো ব্যক্তির কাজ নয়। কাজটা শুধু নারীরও নয়। কাজটা সমষ্টির। কাজটা আদর্শের। বরং ব্যক্তিকে বারবারই পাল্টে নিয়েছে ক্ষমতাতন্ত্র। প্রশ্নটা হচ্ছে একে কে পাল্টাবে? আমরা কি ক্ষমতাতন্ত্রের মুখ নই? আমরা কি শিষ্টাচার শিখেছি? আমরা কি শিখেছি লিঙ্গরাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে দাঁড়াতে? সমাজটা তাহলে পাল্টাবে কারা? যাদের হাতে ক্ষমতা, তারা। যারা পুরুষতান্ত্রিক সমাজটা গড়েছে, তারা। এ ক্ষেত্রে পুরুষের অংশগ্রহণ ও দায় অনেক বেশি। অত্যাচারী গোষ্ঠী যদি নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে অত্যাচার বন্ধ করে তাহলে তা বন্ধ হবে। শাস্তির ভয়ে বন্ধ করলে সেটা সত্যিকারের বন্ধ করা নয়। বোধোদয় হওয়ার পর বন্ধ করলে সেটাই সত্যিকারের বন্ধ করা। চিরস্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনা সেটিরই বেশি। আজকে নারী আন্দোলনকে লড়তে হবে সর্বগ্রাসী পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে, পুরুষকে সঙ্গে নিয়ে। যদিও পুরুষতান্ত্রিক সমাজে সেটা করতে পারাটা কঠিন। এই কঠিন কাজটিই আজকের নারী আন্দোলনের, প্রধান চ্যালেঞ্জ।