নাফনদীর সীমান্তে মিয়ানমার নৌবাহিনীর জাহাজ!

প্রচণ্ড গোলাগুলি ও বিস্ফোরণের শব্দ শুনেছে টেকনাফের মানুষ

নাফ নদীর মিয়ানমার অংশে টানা দুদিন ধরে টহল দিতে দেখা গেছে জাহাজটিকে। ছবি: সুপ্রভাত

জিয়াবুল হক, টেকনাফ »

মিয়ানমার সীমান্তে দেশটির সরকারি বাহিনীর সাথে বিদ্রোহীদের তুমুল লড়াই চলছে। এ  কারণে  প্রচণ্ড গোলাগুলি ও বিস্ফোরণের শব্দ শুনেছে টেকনাফ ও সেন্ট মার্টিনের মানুষ।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, শাহপরীর দ্বীপ এলাকায় নাফ নদীর মিয়ানমার অংশে নৌযানের অবস্থান দেখা যাচ্ছে। টানা দুদিন ধরে বিশাল এই জাহাজকে টহল দিতে দেখ গেছে।

বুধবার (১২ জুন) দিবাগত রাত থেকে বৃহস্পতিবার (১৩ জুন) দুপুর পর্যন্ত চলছে গোলাগুলি। এ সময় বিস্ফোরণের বিকট শব্দ ভেসে আসছে টেকনাফ উপজেলার নাফনদীর সীমান্তবর্তী এলাকায়।

সীমান্ত এলাকার লোকজন জানান, ১২ জুন বুধবার দুপুর থেকে নাফনদীর টেকনাফ সদর ইউনিয়নের মৌলভীপাড়া এলাকার বিপরীতে মিয়ানমারের কাছে দেখা মেলে একটি বড় জাহাজের। যে জাহাজটি মিয়ানমারের নৌবাহিনীর বলে দাবি করছেন সীমান্তের লোকজন। জাহাজটি দুপুর থেকে টানা সন্ধ্যা পর্যন্ত ওখানে দেখা গেছে। এরপর বুধবার রাত ৯টা থেকে এপারে ভেসে আসতে থাকে বিস্ফোরণের বিকট শব্দ। যে শব্দ টানা ৩ ঘণ্টার ধরে চলে। এরপর থেমে থেমে শব্দ শোনা গেছে রাতভর।

১৩ জুন বৃহস্পতিবার ভোর ৪টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত আবারও শোনা গেছে ওই বিকট শব্দ।

বৃহস্পতিবার সকালের পরে ওই বড় জাহাজটি দক্ষিণ দিকে সরে যায়। তবে বর্তমানে জাহাজটিকে টেকনাফের নাফনদীর ও বঙ্গোপসাগরের নাইক্ষ্যংদিয়া পয়েন্টে অবস্থান করতে দেখা গেছে। মিয়ানমারের স্থলভাগে থেমে থেমে গোলাগুলি ও মর্টারশেল বর্ষণের শব্দ অব্যাহত রয়েছে।

সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আব্দুস সালাম জানান, গত এক মাস টেকনাফ সীমান্তের পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক ছিল। শোনা যায়নি বিস্ফোরণের শব্দ। এর মধ্যে গত ৫ জুন, ৮ জুন এবং ১১ জুন নাফনদী ও বঙ্গোপসাগরের নাইক্ষ্যংদিয়া পয়েন্টে মিয়ানমারের অংশ থেকে সেন্টমার্টিনগামী নৌযানে গুলিবর্ষণ হয়। বুধবার (১২ জুন) দুপুরে নাফনদীতে দেখা মিলে মিয়ানমারের নৌবাহিনীর জাহাজ। এরপর রাত থেকে আবারও শোনা যায় বিস্ফোরণের শব্দ।

তিনি আরও  জানান, বুধবার রাত থেকে টেকনাফ উপজেলার সাবরাং ইউনিয়নের শাহপরীর দ্বীপসহ আশপাশের সীমান্ত এলাকায় মিয়ানমারের ওপার হতে থেমে থেমে ভেসে আসছে বিস্ফোরণের বিকট শব্দ। এতে সীমান্ত লাগোয়া শাহপরীর দ্বীপ জেটিঘাট এলাকাসহ জালিয়াপাড়া, পশ্চিমপাড়া, উত্তরপাড়া ও দক্ষিণ নয়া পাড়ার আশপাশের বসতঘর ও স্থাপনা কেঁপে ওঠে। সীমান্তের একেবারে কাছাকাছিতে বসবাসকারীরা অনেকে বাড়ি-ঘর ছেড়ে কিছুটা দূরে স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নেন। বিস্ফোরণের শব্দ ভেসে আসার ঘটনা অব্যাহত থাকায় স্থানীয়দের অনেকে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন। জাহাজটি এখন নাইক্ষ্যংদিয়া পয়েন্টে রয়েছে। দুপুর একটা পর্যন্ত গোলাগুলি ও বিস্ফোরণ অব্যাহত রয়েছে।

এব্যাপারে সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান-৩ ও ৭,৮,৯ নং ওয়ার্ডের সংরক্ষিত মহিলা ইউপি সদস্য ফারিহা ইয়াসমিন জানান, টেকনাফ উপজেলার সাবরাং ইউনিয়নের শাহপরীর দ্বীপ সীমান্তের নাফনদীর ওপারে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু শহরের আশপাশের মেগিচং, কাদিরবিল, নুরুল্লাহপাড়া, মাঙ্গালা, নলবইন্ন্যা, ফাদংচা ও হাসুরাতা এলাকা। ধারণা করা হচ্ছে, মংডু শহর ও আশপাশের এলাকাগুলোতে দেশটির সরকারি বাহিনী ও বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির মধ্যে তীব্র লড়াই চলছে। এতে উভয়পক্ষ ভারী অস্ত্র ও গোলাবারুদ ব্যবহার করায় বিস্ফোরণের বিকট শব্দ শোনা যাচ্ছে।

এবিষয়ে  টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইউএনও মো. আদনান চৌধুরী বলেন, শাহপরীর দ্বীপ সীমান্তে বিস্ফোরণের বিকট শব্দ শোনা যাওয়ার বিষয়টি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে জেনেছেন। জাহাজটিও মিয়ানমারের অংশে। তবে সীমান্ত পরিস্থিতি সম্পর্কে বিজিবি ও কোস্টগার্ডসহ সংশ্লিষ্টরা সজাগ রয়েছে। সীমান্ত পরিস্থিতি প্রশাসনের পর্যবেক্ষণে রয়েছে বলে জানান তিনি।

শাহপরীর দ্বীপের বাসিন্দা ওয়ারেজ আলী বলেন, গোলার বিকট শব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছি। এত বিকট শব্দ আসছে কোনোভাবে ঘুমানো যাচ্ছে না। মাঝেমধ্যে খুব ভয়ে ছিলাম। যদি গোলা এপারে এসে পড়ে তাহলে কী হবে?

সীমান্তে দায়িত্বে থাকা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সরকারি কর্মকর্তা বলেন, মিয়ানমারে ফের সংঘর্ষ এপারের মানুষজনের মাঝে আতঙ্ক বাড়াচ্ছে। আমরা জেনেছি, ওপারে যুদ্ধ তীব্র হচ্ছে, ফলে সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশ ঘটতে পারে- তাই সীমান্তরক্ষীরা সর্তক অবস্থানে রয়েছে।

স্থানীয়রা জানান, বুধবার দুপুরে নাফনদীর শাহপরীর দ্বীপ সীমান্তে মিয়ানমারের জলসীমায় সে দেশের যুদ্ধ জাহাজ এসেছে। জাহাজটি রাতেও মৌলভীপাড়ার সীমান্তের ওপারে দেখা গেছে। এরপর রাত থেকে শুরু হওয়া মর্টারশেলের বিকট গোলার শব্দ থামেনি। পুরো রাতজুড়ে শাহপরীর সীমান্ত দ্বীপটিতে গোলার শব্দ পাওয়া গেছে।

শাহপরীর দ্বীপের বসবাসকারী মো. ইসমাইল বলেন, মিয়ানমারের গোলার শব্দে দ্বীপ কাঁপছে। আধাঘণ্টা পর পর ওপারের শব্দ এপারে পাওয়া যাচ্ছে। আজকের গোলার শব্দ শাহপরীর দ্বীপ বাজারে পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে। এতে সীমান্তের বসবাসকারী শিশু-নারীরা ভয়ভীতির মধ্য আছেন।

বেশ কিছুদিন বন্ধ থাকার পর শাহপরীর দ্বীপ সীমান্তে ব্যাপক গোলার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন দ্বীপের জেটিঘাটের বাসিন্দা নাছির উদ্দিন। এই দোকানদার বলেন, ‘মিয়ানমারের ওপার থেকে খুব বিকট শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। হঠাৎ আবার এ সীমান্তে গোলার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। ওপারের গোলার শব্দে এপারের মাটি কাঁপছে।

এদিকে, মিয়ানমার মংডু, বুথেডং ও রাথেডংয়ের কয়েকটি গ্রামে মিয়ানমারের আরাকান আর্মির সঙ্গে দেশটির সেনাবাহিনীর তুমুল সংঘর্ষ চলছে। টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং থেকে শাহপরীর দ্বীপ পর্যন্ত ৫৪ কিলোমিটার নাফনদী বিজিবি ও কোস্টগার্ডের সদস্যরা দিনরাত নাফ নদ ও সীমান্ত সড়কে টহল বৃদ্ধি করেছে। সেটি চলমান এবং যেকোনও পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে সব সময় প্রস্তুত বাংলাদেশের এই দুই বাহিনী।

এ বিষয়ে টেকনাফ ২ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. মহিউদ্দীন আহমেদ বলেন, সীমান্তে বিজিবির টহল জোরদারের পাশাপাশি রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ রোধে সর্তক অবস্থানে রয়েছি।