নাজুক অর্থনীতির মুখে সৌদি আরব

বিবিসি বাংলা :

একটা সময় সৌদি আরবের পরিচিতি ছিল কর দিতে হয় না এমন একটি দেশ হিসেবে। তবে সম্প্রতি দেশটির নাগরিকদের জন্য করের হার বাড়ানোর পাশাপাশি আগামী মাস থেকে মাসিক ভিত্তিতে দেয়া সরকারি সহায়তা বাতিল করার সিদ্ধান্ত জানানো হয়েছে।

এমন এক সময় সৌদি কর্তৃপক্ষ এই সিদ্ধান্তটি নিলো, যখন গত বছরের একই সময়ের তুলনায় বিশ্ববাজারে তেলের দাম অর্ধেকের বেশি কমার ফলে দেশটির সরকারের আয় ২২ শতাংশ কমে গেছে, আর স্থগিত হয়ে গেছে বড় কয়েকটি প্রকল্প।

রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানি সৌদি আরামকো জানিয়েছে, এই বছরের প্রথম তিন মাসে প্রতিষ্ঠানটির লাভ ২৫ শতাংশ কম হয়েছে।

বিবিসি’র মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ মাইকেল স্টেফান্স বলেন, “সৌদি আরবের অর্থনীতির অবস্থা খুবই খারাপ, এবং স্বাভাবিক পর্যায়ে আসতে এর বেশ সময় লাগবে।”

সৌদি অর্থনীতির একটা বড় নির্ভরশীলতা এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে আসা অদক্ষ শ্রমিকদের ওপর। আর এই শ্রমিকদের অধিকাংশই ঘনবসতিপূর্ণ এবং অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকেন।

অন্যদিকে, যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান তার নিজের দেশে বিপুল জনপ্রিয় হলেও সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগজি হত্যার অভিযোগের তীর তার দিকে হওয়ায় পশ্চিমা বিশ্বের চোখে তিনি বেশ ঘৃণিত একজন ব্যক্তিত্ব।

২০১৮ সালে ইস্তানবুলের সৌদি দূতাবাসের ভেতরে সৌদি সরকারের কর্মকর্তাদের হাতে জামাল খাসোগজির নৃশংস হত্যার ঘটনার পূর্ণ তদন্ত কখনোই সম্পন্ন হয়নি।

তার উপর প্রায় পাঁচ বছর ধরে প্রতিবেশী দেশ ইয়েমেনের সাথে চলা যুদ্ধে সৌদি আরবের খুব একটা লাভ হয়নি।

অন্যদিকে কাতারের সঙ্গে চলা দ্বন্দ্বের কারণে ছয় দেশের গাল্ফ আরব কো-অপারেশন কাউন্সিলের (জিসিসি) সদস্য দেশগুলোর মধ্যকার ঐক্যও টালমাটাল অবস্থায় রয়েছে।

তাই প্রশ্ন উঠছে, সৌদি আরব কি আসলেই বড় ধরণের সঙ্কটের মধ্যে রয়েছে?

‘উত্তরণের পথ রয়েছে’

করোনাভাইরাস মহামারির কারণে পৃথিবীর সব জায়গাতেই অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে – সৌদি আরবও এর ব্যতিক্রম নয়।

‘পাবলিক ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড’ নামে সৌদি আরবের একটি সার্বভৌম তহবিল রয়েছে, যার অর্থ মূল্য ৩২ হাজার কোটি মার্কিন ডলার ( বা ব্রিটিশ মুদ্রায় ২৬ হাজার কোটি পাউন্ড)।

আবার তাদের সৌদি আরামকো – যে তেল কোম্পানিটির সিংহভাগের মালিকানা রাষ্ট্রের – রয়েছে।

গত বছর এই সংস্থাটির বাজারমূল্য নির্ধারিত হয় ১.৭ লাখ কোটি ডলার – যা দুটো বড় মার্কিন কোম্পানি গুগল এবং অ্যামাজনের একত্রিত মূল্যের চেয়েও বেশি।

ওই প্রতিষ্ঠানের মাত্র ১.৫ শতাংশ বিক্রি করে সৌদি আরব আড়াই হাজার কোটি ডলার পায়, যা শেয়ার বিক্রির হিসেবে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় লেনদেন।

২০০৭ থেকে ২০১০ পর্যন্ত রিয়াদে ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করা স্যার উইলিয়াম প্যাটি বলেন, এই অর্থনৈতিক মন্দা থেকে উত্তরণের জন্য সৌদি আরবের সামনে অনেকগুলো পথ রয়েছে।

“তাদের অর্থনীতি চালু রাখার জন্য তাদের হাতে প্রচুর অর্থের মজুদ রয়েছে এবং তেলের দাম কমে গেলেও তারা তাদের মার্কেট শেয়ার অপরিবর্তিত রেখে অথবা আরো শক্তিশালী করে ফিরে আসতে পারে।”

গত সেপ্টেম্বরে সৌদি তেল শোধনাগারে ইরানের মিসাইল হামলার পর এবং এরপর জানুয়ারিতে মার্কিন সেনাবাহিনীর হামলায় ইরানের রেভোলিউশনারি গার্ড কমান্ডার কাসেম সোলেইমানির মৃত্যুর পর আপাতত ইরানের পক্ষ থেকে সৌদি আরবের প্রতি কোনো ধরণের হুমকি নেই বলে মনে করা হচ্ছে।

ইসলামিক স্টেট গ্রুপ এবং আল কায়েদার সঙ্গে সম্পৃক্ত জঙ্গি বা জিহাদি গ্রুপগুলোর কাছ থেকে হুমকি অনেক কমে গেলেও সৌদি আরবের সামনে বেশ কয়েকটি বড় ধরণের চ্যালেঞ্জ রয়েছে।

অর্থনীতি

গত কয়েক বছর সৌদি কর্তৃপক্ষের নেয়া সংস্কার কার্যক্রমের সুফল পাওয়ার আশা করছিলেন যেসব সৌদি নাগরিক, এ সপ্তাহে দেয়া সরকারি ব্যয় সঙ্কোচনের ঘোষণা তাদের অনেকের কাছেই অবাঞ্ছিত মনে হবে।

ব্যয় সঙ্কোচনের সিদ্ধান্তকে দেশটির অর্থমন্ত্রী নিজেই ‘দুঃখজনক পদক্ষেপ’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

এই বছরের প্রথম তিন মাসে বাজেট ঘাটতির পরিমান দাঁড়িয়েছে প্রায় ৯০০ কোটি ডলার।

তবে এই প্রথমবারই যে সৌদি আরব ব্যয় সঙ্কোচনের পদক্ষেপ নিলো, তা কিন্তু নয়।

১৯৯৮ সালের মে মাসে আমি আবুধাবিতে জিসিসির একটি সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছিলাম, যেখানে তৎকালীন যুবরাজ আবদুল্লাহ উপসাগরীয় অঞ্চলের শাসকদের কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন যে তেলের ওপর নির্ভর করলে আরব দেশগুলোর অর্থনীতি দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

এর কিছুদিন পর তেলের প্রতি ব্যারেলের দাম ১০০ ডলারের বেশি হয়েছিল। তবে তার আগেই সরকার কোন প্রতিষ্ঠানে নতুন কর্মী নিয়োগের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি এবং সারা দেশে সব ধরণের নির্মাণকাজ স্থগিত করেছিল।

তবে এবার পরিস্থিতি ওই সময়ের চেয়েও খারাপ হতে পারে।

তেলের দাম কমা এবং করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব – এই দুই ঘটনায় পুরো সৌদি আরবে সব ধরণের প্রকল্প থেমে গেছে। এখন প্রশ্ন উঠছে যে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের ‘ভিশন ২০৩০’ বাস্তবায়ন আসলে কতটা সম্ভব হয়ে উঠবে।

‘ভিশন ২০৩০’ প্রকল্পের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল তেল বিক্রির লভ্যাংশ এবং বিদেশি শ্রমিকদের শ্রমের ওপর সৌদি অর্থনীতির যেই প্রথাগত নির্ভরশীলতা রয়েছে, তার পরিবর্তন।

সেই লক্ষ্যে মরুভূমিতে ‘এনইওএম’ নামের একটি প্রকল্পের আওতায় প্রায় ৫০ হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগে ভবিষ্যতের জন্য মানানসই একটি শহর তৈরি করা হচ্ছে।

কর্তৃপক্ষ যদিও বলছে যে শহরের নির্মাণকাজ পুরোদমে চলছে, তবে বিশ্লেষকদের বিশ্বাস প্রকল্প সম্পন্ন হতে দেরী হবে।

মাইকেল স্টেফান্সের মতে, “সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বেসরকারি খাত। করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে দেশটিতে নেয়া পদক্ষেপের কারণে এরই মধ্যে চাকরিদাতারা সমস্যায় পড়ছেন এবং এর ফলে দীর্ঘমেয়াদে ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।”

বৈশ্বিক অবস্থান

জামাল খাসোগজি হত্যা এবং তার মৃত্যুর ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার ঘটনায় বিশ্বের সামনে সৌদি আরবের ভাবমূর্তি বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

এমন কি লন্ডনে সৌদি রাষ্ট্রদূতও বলেছিলেন যে এই ঘটনায় ‘আমাদের ভাবমূর্তিতে দাগ’ তৈরি হলো।

ওই ঘটনার বিচারের সময় শীর্ষ কয়েকজন সন্দেহভাজনকে মুক্তি দেওয়ার বিষয়টি আলোড়ন তোলে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মধ্যে। জাতিসংঘও সে সময় দেশটির মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করে।

কিন্তু সৌদি আরব এত বড় এবং এত গুরুত্বপূর্ণ একটি অর্থনীতি যে বিশ্বের পক্ষে এটিকে উপেক্ষা করা সম্ভব নয়।

সম্প্রতি কৌশলগতভাবে বিভিন্ন খাতে হাই-প্রোফাইল বিনিয়োগের চেষ্টা করছে তারা – যেমন ব্রিটিশ ফুটবল ক্লাব নিউক্যাসল ইউনাইটেডের ৮০ শতাংশ কিনে নিতে চাইছে তারা।

ইয়েমেন যুদ্ধে সৌদি আরব যে যুদ্ধবিমানগুলো ব্যবহার করেছিল, সেগুলো যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে নেয়া। কাজেই এই তিন পক্ষের বিরুদ্ধেই যুদ্ধাপরাধ সংঘটনের অভিযোগ রয়েছে।

সৌদি যুবরাজ – এবং কার্যত শাসক – মোহাম্মদ বিন সালমান নিজের প্রধান যে দুই মিত্রের ওপর নির্ভর করতে পারেন, তারা হলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ভ্লাদিমির পুতিন।

কিন্তু এ বছর ইচ্ছাকৃতভাবে তেলের বাজারে যোগান বাড়িয়ে দিয়ে ওই দুই নেতাকেই ক্ষুদ্ধ করেছেন তিনি। তেলের দাম কমার ফলে যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়া, এই দুই দেশের অর্থনীতিই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

ইরানের সাথে সৌদি আরবের সম্পর্ক এখনও স্নায়ুযুদ্ধের পর্যায়ে রয়েছে, তবে কাতারের সাথে সম্পর্ক অপেক্ষাকৃত ভালো।

আর দেশের ভেতরে নারীদের গাড়ি চালানোর সুযোগ দিয়ে, সিনেমা হল উন্মুক্ত করে, গাড়ির র‍্যালি আয়োজনের মত কার্যক্রমের মাধ্যমে সমাজ সংস্কারের চেষ্টা করছেন যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান।

বাইরে থেকে দেখলে যা মনে হয়, তা হলো আগের চেয়ে সৌদি আরব অনেক কম উগ্র একটি জায়গা।

তবে পর্দার আড়ালে রাজনৈতিক দমন-পীড়ন বেড়েছে। যুবরাজের নীতি নিয়ে সমালোচনা তো দূরের কথা, প্রশ্ন করার ফলেই অনেককে কারাদণ্ড পেতে হচ্ছে – যাদের অনেকের বিরুদ্ধেই ‘জাতীয় নিরাপত্তার প্রতি হুমকি’ হওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে।

এছাড়া, শাস্তি হিসেবে শিরশ্ছেদের প্রথা এখনও চালু রয়েছে এবং বরাবরের মতই মানবাধিকার সংগঠনগুলোর সমালোচনার অন্যতম কেন্দ্রে রয়েছে সৌদি আরব।

এ ধরণের পরিস্থিতির মধ্যেই আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে সৌদি আরব।

আর এসব সমালোচনার কারণে সৌদি আরবের মিত্র দেশগুলোও কখনো কখনো তাদের নিয়ে বিব্রত বোধ করে।

চৌত্রিশ বছর বয়সী যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানকে অপ্রতিরোধ্য বলেই মনে হচ্ছে। তার ৮৪-বছর বয়সী পিতা বাদশাহ সালমানের সমর্থন রয়েছে তার পেছনে এবং সিংহাসনের সম্ভাব্য উত্তরাধিকারীদের পর্যায়ক্রমে সরিয়েও দিয়েছেন তিনি।

২০১৭ সালে রাজপ্রাসাদে আকস্মিক অভ্যুত্থানে সিংহাসনের দাবিদার মোহাম্মদ বিন নায়েফকে সরিয়ে যুবরাজ হন মোহাম্মদ বিন সালমান। এরপর এ রকম আরো অনেক সিনিয়র নেতা এবং রাজ পরিবারের সদস্যদের আটক করেন তিনি।

অপেক্ষাকৃত বয়স্ক এবং রক্ষণশীল সৌদি নাগরিকদের মধ্যে ‘এমবিএস’-এর রীতিবহির্ভূত সিদ্ধান্ত এবং নীতির সমালোচনা রয়েছে। তারা মনে করেন মোহাম্মদ বিন সালমানের নীতির কারণে সৌদি আরব ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে যাচ্ছে।

আবার বিদেশে ‘এমবিএস’-এর ভাবমূর্তি যেমনই হোক, সৌদি আরবের তরুণদের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা ব্যাপক।

তরুণদের কাছে তিনি জনপ্রিয়, কারণ তারা তাকে সৌদি জাতীয়তাবাদের প্রতীক হিসেবে মনে করে। তবে তার জনপ্রিয়তার আরো বড় একটি কারণ হলো, তরুণরা মনে করে ‘এমবিএস’ তাদের একটি সমৃদ্ধিশালী অর্থনৈতিক ভবিষ্যত উপহার দিতে পারবেন।

তরুণদের ওই স্বপ্ন যদি পাঁচ বছর পর বাস্তবে রূপ না নেয়, তাহলে তখনই হয়তো বলা যাবে যে সৌদি রাজতন্ত্রের ভবিষ্যৎ সত্যিই নিরাপদ কি-না।