এমরান চৌধুরী »
কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের জাতীয় কবি। আজন্ম দুঃখের সঙ্গে লড়াকু এই কবি বাংলা সাহিত্যের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করে গেছেন বর্ণিল সৃজন সম্ভারে। বাংলা সাহিত্যের বটবৃক্ষ রবীন্দ্রযুগে জন্ম নিলেও নিজস্বতায় নির্মাণ করেছেন স্বীয় ভুবন। সেই ভুবন জুড়ে আছে মানবতাবাদ, সাম্যবাদ ও অসাম্প্রদায়িকতার চেতনামুখর সুন্দর পৃথিবী বিনির্মাণের স্বপ্ন।
মধ্যযুগে বাঙালি কবি চণ্ডীদাস লিখেছেন, শুনহ মানুষ ভাই
সবার উপরে মানুষ সত্য
তাহার উপরে নাই।
এরও পরে বাউল কবি লালন শাহ বলেছেন,
মানুষ ধরো, মানুষ ভজো,
মানুষ খোঁজো, শোন বলিরে পাগল মন। আর সাম্যের কবি, মানবতার কবি, দ্রোহের কবি কাজী নজরুল ইসলাম আরও স্পষ্ট করে মানবতাবাদকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে বলেছেন,
গাহি সাম্যের গান
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই
নহে কিছু মহিয়ান।
ধর্মীয় বিশ্বাসের জন্ম মনের অভ্যন্তরে। মনের গহিনে জন্ম নেওয়া সেই বিশ্বাস প্রকাশ্যে কোনো বিরোধ বা দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করুক, সেটা কবি চাননি। পাক-ভারত উপমহাদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী যে দুটি ধর্মের অনুসারী, তাদের তিনি একই বৃন্তে ফোটা দুটি ফুলের সঙ্গে তুলনা করেছেন। কবি শুধু প্রতীকী অর্থে নয়, বাস্তবতার নিরিখেই তা করেছেন, ফলে তাঁর কবিতায় এসেছে,
মোরা এক বৃন্তে দু’টি কুসুম
হিন্দু-মুসলমান
মুসলিম তার নয়ন-মণি,
হিন্দু তাহার প্রাণ।
এক সে আকাশ মায়ের কোলে
যেন রবি শশী দোলে,
এক রক্ত বুকের তলে,
এক সে নাড়ির টান।’
কবি নজরুল ইসলাম মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন প্রত্যেক মানুষ অত্যন্ত স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে। কিন্তু তার চেয়ে বড় কথা, একজন মানব সন্তানের বড় পরিচয় সে মানুষ। সেই বিষয়টি সবচেয়ে জোরালোভাবে উচ্চারণ করেছেন তিনি। ফলে এ উপমহাদেশে যখন রাজনীতির ক্ষেত্রে ধর্মীয় পরিচয়ই বড় হতে যাচ্ছিল, গোটা বিশ্বে যখন ধর্মীয় বিভেদের কারণে হানাহানি বেড়ে যাচ্ছিল, তখন তিনি উচ্চকিত হয়েছেন এই বলে,
নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ,
অভেদ ধর্ম জাতি,
সব দেশে, সব কালে
ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।
মানবসৃষ্ট নানা বিভেদে বিভক্ত এ সমাজ দেখে যারপরনাই বিচলিত হয়েছিলেন কবি নজরুল ইসলাম। এসব থেকে মনেপ্রাণে মুক্তির প্রত্যাশা ছিল তাঁর। সে কারণেই তার রচিত সাহিত্যের প্রধান উপাদান হয়েছে মানবতাবাদ, সাম্যবাদ আর অসাম্প্রদায়িক চেতনা। এর যথেষ্ট কারণও রয়েছে। তার লেখালেখির শুরুটা হয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিত পর। গোটা বিশ্ব তখন টালমাটাল; মানুষ তখন মানবতার চরম বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার প্রাণান্তকর চেষ্টা করে যাচ্ছে । কোথাও-বা সেই সুযোগে নতুন করে শুরু হয়েছে বিপর্যয়ের পুনরাবৃত্তি। বিশ্বযুদ্ধের সে করুণ সময়ে কবি নিজেও বেছে নিয়েছিলেন যুদ্ধজীবন। ভেবেছিলেন যুদ্ধে অংশ নিয়ে মানুষের জন্য কিছু করবেন। মোহ ভাঙতে দেরি হয়নি তাঁর। কারণ সেই যুদ্ধ ছিল যুদ্ধবাজদেরই পক্ষে আর সাধারণ মানবতার বিরুদ্ধে। ফিরেই তিনি শুরু করেন আরেক যুদ্ধ। কাব্যযুদ্ধ। সেই যুদ্ধকে জীবনযুদ্ধ বললেও অত্যুক্তি হবে না।
প্রচলিত সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে তিনি কলম ধরে প্রতিজ্ঞা করলেন এ সমাজের খোলনলচে পাল্টে দেওয়ার। বাজালেন ‘অগ্নি-বীণা’। হয়ে উঠলেন আজন্ম ‘বিদ্রোহী’। বলে উঠলেন, পুরোনোকে, জীর্ণকে, প্রচলিত সমাজের গণ্ডিকে ভেঙে নতুন করে গড়তে হবে। সেই আহ্বান জানিয়ে তিনি নতুনের জয়ধ্বনি করতে করতে বললেন,
ধ্বংস দেখে ভয় কেন তোর?
প্রলয় নূতন সৃজন-বেদন!
আসছে নবীন-জীবন-হারা
অসুন্দরে করতে ছেদন!
কাল ভয়ঙ্করের বেশে এবার ঐ আসে সুন্দর!
তোরা সব জয়ধ্বনি কর!
সব মানুষের মধ্যে ভেদাভেদহীন-জাতপাতহীন এক উন্নত সমাজ প্রত্যাশা করেছেন কবি। ফলে চোখের সামনে যা দেখেছেন, যা কিছু তার কাছে অন্যায় বলে প্রতীয়মান হয়েছে, তারই প্রতিবাদ করেছেন, প্রতিকার চেয়েছেন। সনাতন সবকিছুর বিরুদ্ধেই সোচ্চার ছিলেন। কোনো ধর্মের মধ্যে উঁচু জাত, নিচু জাত বলে এক ধরনের অলিখিত রীতি চালু ছিল তার সময়ে। এখনো যে সেই ভেদাভেদ নেই তা নয়। সেই জাতের ধোয়া তুলে যারা সমাজকে বিভক্ত করতে চান, তাদের প্রতি বিষোদ্গার করেছেন কবি। সমাজের নিপীড়িত-নিগৃহীত মানুষের প্রতি অকৃত্রিম দরদ প্রতিফলিত হয়েছে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ‘বিদ্রোহী’ কবিতায়-
আমি সেই দিন হব শান্ত,
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না।
একমাত্র বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামই আমাদের পুরুষশাসিত সমাজের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন মায়ের জাত নারীদের সম্মানের কথা। মেয়েদের যে আমরা অবমূল্যায়ন করি, সম-যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তাদের আমরা সমভাবে দেখি না। এটা মোটেই ঠিক নয়, ন্যায্য নয়। তার মতো বাংলার আর কোনো কবি নারীদের প্রতি যুগ যুগ ধরে চলমান অসাম্যকে সামনে এভাবে তুলে আনেননি। ফলে তিনি বলতে পেরেছেন,
সাম্যের গান গাই-
আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই!
বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
বিশ্বে যা-কিছু এল পাপ-তাপ বেদনা অশ্রুবারি
অর্ধেক তার আনিয়াছে নর, অর্ধেক তার নারী। সব সৌন্দর্যের, সব সাফল্যের কৃতিত্ব দিতে তিনি বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করেননি,
এ-বিশ্বে যত ফুটিয়াছে ফুল,
ফলিয়াছে যত ফল,
নারী দিল তাহে রূপ-রস-মধু গন্ধ সুনির্মল।
বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিক-দার্শনিকের স্ব স্ব সমাজে এক ধরনের প্রভাব থাকে। নজরুলের কাব্য-দর্শনও আমাদের সমাজে রেখেছিল বিরাট প্রভাব। বিশ্বমানচিত্রে বাংলাদেশ নামে যে জাতিরাষ্ট্রের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এর পেছনে ছিল নজরুলের বিদ্রোহী সত্তার অনুপ্রেরণা। বাংলাদেশের মানুষ পঞ্চাশের দশক থেকে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। করেছে আন্দোলন-সংগ্রাম। এ দেশের ছাত্রসমাজের নেতৃত্বে ষাটের দশকে সংঘটিত হয়েছে প্রগতিশীল ধারার আন্দোলন। সেই ধারাবাহিক আন্দোলনের ফলে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে এ দেশের নারী-পুরুষ অংশ নিয়েছিলেন। এসবের পেছনে অবশ্যই নজরুলের বিদ্রোহী, অসাম্প্রদায়িক ও সাম্যবাদী চেতনার প্রতিফলন ঘটেছিল।