ধুলোর নিচে শহর

জুয়েল আশরাফ »

বিকেল পাঁচটার দিকে মেহেরগাঁও বাজারে একটা অস্থিরতা দেখা দেয়। গ্রামের মানুষজন বলতে শুরু করে, বড়সরকার ফিরতেছে নাকি?
কেউ কেউ হাসে, কেউ মুখ কালো করে, কেউ বলে, ফিরলে কী হবে? আগের মতো আদর পাইব?
বড়সরকার তৌফিক হাসান। শহরে বাস, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের বড় কর্মকর্তা। এই গ্রামে তার পৈতৃক ভিটা। গ্রামে সে প্রায় বারো বছর আসেনি। শেষ এসেছিলেন মায়ের জানাজায়। বাবার মৃত্যুর পর তিনিই হলেন ভিটেমাটি আর জমিজমার মালিক। কিন্তু সেসব দেখভালের ভার পড়েছিল তার মামাতো ভাই আনিসের ওপর।
আনিস একজন শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত গোছের মানুষ। স্থানীয় হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক। বয়স পঞ্চাশ পেরিয়েছে, গলায় সবসময় একটা পুরোনো টুপি ঝুলে থাকে। সেই টুপির ভেতরেই লুকিয়ে থাকে তার স্নায়বিক অস্থিরতা। তৌফিক হাসান ফিরে আসে এক শুক্রবার সকালে। কালো গ্লাসের গাঢ় রঙের টয়োটা গাড়ি, পাশে একজন ড্রাইভার, পেছনে দুটো বড় লাগেজ। গেট খুলে দেয় আনিস।
ভাইসাব, এতোদিন পর?
অফিস থেকে ছুটি পেয়েছিলাম। ভাবলাম, বাড়িটার একটু খোঁজ নিই।
বাড়ির ঘরগুলো ধূলায় ঢেকে আছে। বাথরুমে কল নষ্ট। রান্নাঘরে ইঁদুরের বাসা। তৌফিক বিরক্ত হন না। তিনি বরং আনিসের ছেলেকে কাছে ডাকেন।
তোমার নাম কী?
আলভি।
পড়াশোনা করো?
করি। ইলেকট্রিকাল ডিপ্লোমা।
তৌফিক মাথা নাড়েন। এরপর ঘর পরিস্কারের লোক, ইলেকট্রিশিয়ান, প্লাম্বার সব ঠিক করে ফেলেন।
তিনদিন পর বাজারে গুঞ্জন ছড়ায়, তৌফিক নাকি পুরো বাড়ি ভেঙে ফেলে নতুন দোতলা বানাবেন।
ভাই, বাড়ি তো ঠিকই আছে,- এক চায়ের দোকানে কেউ বলে।
ঠিক আছে মানে? শহরের লোকেরা আধুনিক চায়। পুরান মাটির ঘরে গন্ধ লাগে ওদের।
আচ্ছা, আনিস স্যার কি বলে এইসব?
আনিস কিছু বলে না। বরং রাতে স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার স্ত্রীর নাম সালমা। রোগা, শান্ত নারী। সালমা এক রাতে বলে, আপনি তো ওর সব কাজ সামলাইছেন, তবু আজকাল খটকা লাগতেছে।
খটকা? কিসের?
আমার মনে হয় বড়সরকার কিছু লুকাইতেছে।
আনিস হাসে। বলে, শহরের লোকেরা অনেক কিছুই লুকায়। আমরা কী বুঝব?
তৌফিকের পরিবর্তন চোখে পড়ে আনিসের। সে এখন খুব সকালে হাঁটে। হাটে গিয়ে বয়স্ক লোকদের সঙ্গে কথা বলে। একজন দিনমজুরকে এক দুপুরে বাড়িতে ডেকে মাছভাত খাওয়ায়। এমনকি এক রাতে গ্রামে ঘোষণা দেয়, পুরনো পুকুরটার পাশে একটা প্রাথমিক বিদ্যালয় তৈরি করব।
এক সন্ধ্যায় আনিস দেখে, তৌফিক চুপিচুপি পুরনো গোয়ালঘরের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। ঘাড় নিচু, চোখে অস্বস্তি।
ভাই, সব ঠিক আছে?
তৌফিক চমকে উঠে বলে, হ্যাঁ, সব ঠিক। একটা সময় এই জায়গায় আমি খুব সময় কাটাতাম।
তাও তো বহু আগের কথা।
তৌফিক কোনো জবাব দেয় না। চলে যায়।
এরপর একদিন আনিস দেখতে পায়, তৌফিক বাড়ির দালানের নিচে মাটি খোঁড়াতে শুরু করেছে।
এটা কী হচ্ছে?
টিউবওয়েল বসানো হবে।
কিন্তু যেখানে টিউবওয়েল বসানো হচ্ছে, সেটি ছিল আগে পুরনো একটি কাঠের ঘরের জায়গা। আনিস বলল, আপনি তো জানেন, ওখানে আগে জাহাঙ্গীর কাকার চাষের সরঞ্জাম রাখা হতো।
হ্যাঁ, কিন্তু সেই ঘর তো এখন নেই।
রাতে আনিস বিছানায় শুয়ে থাকতে পারে না। তার সন্দেহ জন্মায়। স্মৃতিতে ফিরে আসে সেই সময়, যখন তৌফিক কিশোর ছিল আর আনিস তরুণ। একবার হঠাৎ করেই নিখোঁজ হয়ে যায় একজন গৃহপরিচারিকা রহিমা। তার বয়স ছিল মাত্র ষোলো। সে আনিসদের বাড়িতে কাজ করত, কিন্তু কিছুদিন পর চলে যায় তৌফিকদের বাড়িতে। সেই বছরই সে উধাও হয়। তৌফিক তখন হঠাৎ ঢাকায় চলে যায়। সবাই ধরে নেয়, রহিমা হয়তো পালিয়েছে। কিন্তু রহিমার মা এখনও মাঝে মাঝে এসে কাঁদে।
আনিস এবার সাহস করে তৌফিককে বলে, রহিমা আপা কি আজও তোমার স্বপ্নে আসে?
তৌফিক ফ্যালফ্যাল করে তাকায়। তারপর শান্ত গলায় বলে, তুমি কিছু জানো?
জানি না। কিন্তু আঁচ করতে পারি।
তৌফিক বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার ঠিক আগের রাতে নিজে থেকে আনিসকে ডাকে।
তুমি এই গ্রামে থেকেছ, জানো কতটা অন্যায় লুকিয়ে থাকে মাটির নিচে?
আনিস বলে, আমি শুধু জানি, সময় সব প্রকাশ করে দেয়।
কিন্তু আমি সময়ের আগেই স্বীকার করছি। রহিমার মৃত্যুর জন্য আমি দায়ী। একরাতে রাগের মাথায় ধাক্কা দিয়েছিলাম, মাথা দেয়ালে লেগে যায়। এরপর বাবার সাহায্যে তাকে পেছনের কুয়ায় চাপা দেই।
তোমার বাবা জানতেন?
হ্যাঁ। তিনি চেয়েছিলেন সব মুছে দিতে। কিন্তু আমি পারিনি ভুলে থাকতে।
আনিস স্তব্ধ হয়ে যায়। পরদিন সকালে পুলিশ আসে। আনিস নিজেই ফোন করেছিল। তৌফিক হাসিমুখে পুলিশের সঙ্গে গাড়িতে ওঠে। একরকম আত্মসমর্পণ। গ্রামে হাহাকার পড়ে যায়, এ কী করল বড়সরকার?
তৌফিক যাবার আগে বলে যায়, বাড়ির জমি দিয়ে স্কুলটা করে দিও। ওটাই আমার প্রায়শ্চিত্ত।
আনিস দাঁড়িয়ে থাকে গেটের সামনে। তার ছেলে আলভি এসে বলে, বাবা, তুমি কি তখনও কিছু জানতা?
জানতাম না। শুধু বোঝার চেষ্টা করতাম।
ছেলের চোখে একটু অন্যরকম চাহনি। শ্রদ্ধা ও ভয় একসঙ্গে।
এক বছর পর আনিস একটি নতুন স্কুল উদ্বোধন করে। নাম রাখে, ‘রহিমা মেমোরিয়াল স্কুল’। গ্রামের মাটি ধুয়ে-মুছে ফেরত আসে এক সত্য, আর নতুন একটি ভবিষ্যতের বীজ বোনে।
তৌফিক আজও কারাগারে। কিন্তু তার মুখে যে প্রশান্তি, তা দেখে কেউ কেউ বলে, বড়সরকার এবার সত্যিই মানুষ হইছে।