নিজস্ব প্রতিবেদক »
চট্টগ্রামে প্রতি বছরই অতিবৃষ্টিতে পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটে। যে চট্টগ্রামের পাহাড়, নদী-সমুদ্রঘেরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দিকে পুরো দেশ তাকিয়ে থাকে, সেই চট্টগ্রামের পাহাড়ের সুরক্ষা নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই। তাই ধসেপড়া পাহাড়ের বালি ও মাটিতে ভরাট হয় নালা, খাল ও নদী। প্রকৃতির ক্ষতি ছাড়াও জলাবদ্ধতায় দুর্ভোগ পোহাতে হয় নগরবাসীকে।
পাহাড়ধসের ঘটনা প্রবাহ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০০৭ সাল থেকে প্রতি বছরই পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটছে এখানে। তখন থেকেই একটি বিভাগীয় পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটিও কাজ করছে। এ কমিটি ১৬ বছরে ২৬টি পাহাড়কে ঝুঁকিপূর্ণ বলে ঘোষণা করে। অন্যদিকে ২০০৭ সাল থেকে চলতি বছর পর্যন্ত প্রায় ২৩টি পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটে। এর আওতায় ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় ছাড়া আরও বেশ কিছু নতুন পাহাড়ও যুক্ত হয়েছে। এসব সত্ত্বেও পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি বরাবরের মতো এবারও পাহাড়ে অবৈধ দখলরোধে বিভিন্ন ঘোষণা ও বর্ষায় উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করলেও পাহাড় সংরক্ষণে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেনি।
চলতি বছরের ৩ আগস্টের টানাবৃষ্টিতে নগরের দুটি জায়গায় পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে টাইগারপাস এলাকায় একটি পাহাড় ও বিশ্বকলোনি কাঁচাবাজার এলাকায় বেশ কয়েকটি পাহাড় ধসে পড়ে। এতে কেউ হতাহত না হলেও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ২০০৭ সালের ১১ জুন ভারী বর্ষণে নগরের লেডিস ক্লাব, কুসুমবাগ, কাছিয়াঘোনা, ওয়ার্কশপঘোনা, মতিঝর্ণা, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাসহ প্রায় সাতটি এলাকায় পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটে। ওইদিন ভোরে অল্প সময়ের ব্যবধানে এসব পাহাড়ধসে নারী-শিশুসহ ১২৭ জনের মৃত্যু হয়। ২০০৮ সালের ১৮ আগস্ট নগরীর লালখানবাজার মতিঝর্ণা এলাকায় পাহাড়ধসে চার পরিবারের ১২ জনের মৃত্যু হয়। ২০১১ সালের ১ জুলাই টাইগারপাস এলাকার বাটালি হিল পাহাড়ের প্রতিরক্ষা দেয়াল ধসে ১৭ জনের প্রাণহানি ঘটে। ২০১২ সালের ২৬ ও ২৭ জুন পাহাড়ধসে ২৪ জনের প্রাণহানি ঘটে। ২০১৩ সালে মতিঝর্ণায় দেয়ালধসে দুজন, ২০১৫ সালের ১৮ জুলাই বায়েজিদ এলাকার আমিন কলোনিতে একই ঘটনায় তিনজন, ২১ সেপ্টেম্বর বায়েজিদ থানার মাঝিরঘোনা এলাকায় মা-মেয়ে এবং ২০২২ সালের ১৭ ও ১৮ জুন চারজনের মৃত্যু হয়। সর্বশেষ ঘটনায় নগরীর আকবর শাহ থানাধীন ১ নম্বর ঝিলে রাত ২টায় (১৭ জুন) দুই বোন এবং ১৮ জুন ভোর ৪টায় বিশ্বকলোনি লেকসিটির পূর্বে বিজয় নগরে দুই ভাইয়ের মৃত্যু হয়।
এ প্রসঙ্গে পরিবেশ অধিদফতর-চট্টগ্রামের পরিচালক হিল্লোল বিশ্বাস বলেন, পাহাড়ধসের ঘটনার পরও একই পাহাড় থেকে মাটি ধসে পড়তে থাকে। এজন্য আমরা বারবারই বলি, পাহাড়ের মালিকানায় যারা রয়েছেন তারা যেন তা সুরক্ষার জন্য রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ করেন। আবার রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ করতে গেলে পাহাড়ের মাটিও কাটা পড়ে। তাই আমাদের কাছে আবেদন করে জেনে নিতে হবে কতটুকু ও কিভাবে পাহাড় কাটা হবে। আমাদের স্পেশালিস্টরা তাদের সে পরামর্শ দেবেন।’
এ নিয়ে নগর পরিকল্পনাবিদ আশিক ইমরান বলেন, ‘চট্টগ্রামের পাহাড়গুলোর অবস্থা খুবই খারাপ। আর দশ-পনেরো বছর পর পাহাড়গুলো থাকবে কিনা সন্দেহ। বহু বছর ধরে পাহাড়ের অবৈধ দখল নিয়ে কাজ করার কথা থাকলেও প্রভাবশালীদের জন্য কেউ কিছু করতে পারছে না। এতে প্রতি বছর পাহাড়ধস হচ্ছে। পাহাড়ের মাটি ও বালি ড্রেনে-খালে পড়ে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। তাই এখনই পাহাড়গুলো সংরক্ষণের কার্যকরী উদ্যোগ নিয়ে তা বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন।’
কিভাবে পাহাড়গুলো সুরক্ষিত করা যায় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা নিয়ে আমরা একটি প্রস্তাব দিয়েছি। বাইরের দেশের দিকে তাকালে দেখা যাবে, তারা পাহাড় সংরক্ষণে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়ে তা বাস্তবায়ন করেছে। বিশেষ করে মালয়েশিয়ায় পাহাড়গুলো সংরক্ষণের জন্য একটি সরকারি সংস্থা কাজ করে। ওদের ওখানে কোনো ব্যক্তিমালিকানায় পাহাড় নেই। আমাদেরও এ ধরনের উদ্যোগ নিতে হবে। এছাড়া পরিবেশ অধিদফতরের জনবলসহ আধুনিক সরঞ্জাম, বিশেষ করে ড্রোন দিয়ে পাহাড়গুলো সংরক্ষণের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।’