হাবিবুল হক বিপ্লব »
সকল রাষ্ট্রেই কিছু নীতিবাক্য বা স্লোগানের প্রচলন আছে। এসব স্লোগানের মাধ্যমে রাষ্ট্র যে স্পিরিটে বিশ্বাসী তা ছড়িয়ে দেবার চেষ্টা করা হয়। যেমন, বৈদেশিক সম্পর্কের ধরন বোঝাতে আমাদের স্লোগান হলো, ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়।’ এখন চাইলেই ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে এই নীতি-স্লোগানকে বিতর্কিত করা যায়। বিশ্বের সকল রাষ্ট্রই মানবিক কাজ করছে না। তাদের সাথেও কি বন্ধুত্ব? তাদের সাথেও কি বিরোধিতা বা শত্রুতা নয়? প্রশ্ন তুললে তোলা যায়। কিন্তু প্রায়োগিক সত্য হলো, বাস্তবে যাই থাকুক না কেন, (যেমন, চিরকাল পাকিস্তানের সাথে বা ইদানিং মায়ানমারের সাথে, কখনও ভারত ইস্যুতে) আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো- সকলের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন। এখন আসি মূল কথায়। যখন বলা হয় যে, ধর্ম যার যার উৎসব সবার, তখন অনেক ধর্মপ্রাণ ভাই-বোন এটি মেনে নিতে পারেন না। যারা মেনে নিতে পারেন আর যারা মেনে নিতে পারেন না তাদের মধ্যে তৈরি হয় ব্যবধান আর চাপা দ্বন্দ্ব। আমি এই স্লোগানটির ৩টি সম্ভাব্য অর্থ খুঁজে পাই। ১. এক পক্ষ ভাবেন, ধর্ম যার যার হলে উৎসবও তার তার হওয়াই যৌক্তিক। উৎসবের কারণটা যেহেতু একটি বিশেষ ধর্মের, তাই উৎসবটা ওই ধর্মের লোকেরই করা উচিত। নইলে এক ধর্মের লোক অন্য ধর্মের উৎসব করলে নিজের ধর্ম ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ২. দ্বিতীয় পক্ষের ব্যাখ্যা হলো, ধর্মীয় সিদ্ধান্ত যার যার ব্যক্তিগত। আমি যে ধর্মেরই হই না কেন, আমার বন্ধু যে ধর্মেরই হোক না কেন, আমি তার বাড়ি যাবো, তার কাছে খাবো, অবশ্যই আমার ধর্মীয় রীতির মধ্যে থেকেই খাবো। তাকে শুভেচ্ছা জানাবো, আমার বাড়িতে সে আসবে। এসবই আমার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। এভাবে আমি অন্য ধর্মের উৎসবে যেতেই পারি। এই পক্ষ মনে করে এতে নিজ ধর্মের কোনো ক্ষতি হচ্ছে না। বরং সকল ধর্মের মানুষকে আপন করে নেওয়া হচ্ছে। ৩. ওপরে বর্ণিত দুই দলের মধ্যে দ্বন্দ্ব আছে। তারা উভয়েই নিজেদের ব্যাখ্যাকেই সত্য মানেন এবং অপর পক্ষের সাথে বিষোদগার করতে বা তর্কে জড়িয়ে পড়তে পিছপা হন না।
তবে এই দুইয়ের বাইরেও একটি অর্থ আছে। সেটি অবশ্যম্ভাবী অর্থ। এটি এমন অর্থ যে, আপনি আমি মানি বা না মানি, কিছুই আসে যায় না, বরং এই স্লোগানটি বাস্তবরূপে প্রমাণিত হয়ে যায়। কীভাবে? ধরুন, সনাতন ধর্মাবলম্বী ভাই-বোনদের পূজা চলছে। প্রচুর কেনা-কেটা হবে। এত শাড়ি-গহনা-খাবার-পোশাক-বাজনা কারা বিক্রি করবে? সকল বিক্রেতাই কি হিন্দু? না। প্রায় সবাই মুসলিম। একজন পোশাক বিক্রেতা, সে হিন্দুই হোক বা মুসলমান, বছরের বিশেষ কিছু সময়ে সে বেশি বেশি বিক্রি করে। ঈদে, পূজায়, বৈশাখে ইত্যাদি। চাঁদ রাতের আগ পর্যন্ত ঈদের বিক্রিতে যেমন ধুম পড়ে যায়, পূজাতেও তেমনি সে অনেক বিক্রি করে। এই সময়গুলোতে সে বিক্রি করে হয়তো সারাবছরের ঝিমিয়ে পড়া ব্যবসাকে চাঙা করে তোলার স্বপ্ন দেখে। এই যে পূজার কেনা বেচা, এটা একজন মুসলিম ব্যবসায়ীকেও লাভ এনে দেয়। এই সময়ে বছরের অন্যান্য সময়ের তুলনায় ওই ব্যবসায়ী ভাল ভাল খান, ভালো ভালো পরিধান করেন, ঋণ মেটান, ব্যবসা বাড়ানোর পরিকল্পনা করেন, ইত্যাদি। এভাবে পূজার সময়ে মুসলিম ব্যবসায়ীও আনন্দ লাভ করেন। এই আনন্দের মানে এই না যে, তিনি মন্দিরে গিয়ে পূজা দিলেন। কিন্তু পূজার সময়ের ‘বাই-প্রোডাক্ট’ হিসেবে হলেও তার মনে শান্তি এলো। এভাবে তিনি এই উৎসবে শামিল হলেন। ঈদের সময়ে একজন হিন্দু ব্যাবসায়ীও কিন্তু একইভাবে আনন্দিত হন। ধর্ম যার যার উৎসব সবার কথাটির বিরোধিতা করলেও কোনো ব্যবসায়ীই কি অন্য ধর্মের উৎসবের সময়ে বসে থাকেন? থাকেন না। এভাবে উৎসব সবার হয়ে যায়।
ঈদ আসে। ছুটি আসে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকুরিরত ভাই-বোনেরা ছুটি পান। বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া, যেমন নন স্টপ সার্ভিসের জায়গাগুলোতে, এক ধর্মের উৎসবে অন্য ধর্মের কর্মচারীদের রেখে দেওয়া হয় সেবার স্বার্থে, এমন ক্ষেত্র ছাড়া, সব ধর্মের মানুষই ছুটি পান। ছুটি মানেই আনন্দ। পূজা আসে। প্রতিষ্ঠানে ছুটি আসে। এই ছুটির আনন্দ শুধু একটা ধর্মের লোক নেন কী? কোনও হিন্দুই ঈদের নামাজ পড়তে আসবেন না, কোনো মুসলিমও পূজা দেবেন না। কিন্তু ছুটি ঠিকই কাটান সবাই। এই ফাঁকে নিজের পরিবারের কাছে যান। ভাল মন্দ খাওয়া তো স্বাভাবিক হয়ে যায়। পূজোর ছুটিতে মুসলিম বাবা যখন ছুটি পান, তখন তিনি ভাবেন, বাড়ির পাশের বন্ধুরা যখন নতুন নতুন জামা পড়বে পূজায়, তখন ছোট্ট বাচ্চা কার কী উৎসব তা বুঝবে না, নতুন একটা জামা পেলে সেদিন তারও ভাল লাগবে। তাই সেও নতুন জামা কেনে সন্তানের জন্য। পাশের বাড়িতে আনন্দ উৎসবের জন্য এ বাড়ির কর্তাও ভাবেন, আমার বাড়িতেও কিছু আয়োজন হোক না! ছুটি মানেই ফাঁক পেলে ঘুরতে যাওয়া। পর্যটনের পালে হাওয়া লাগা। এই পূজার ছুটিতে বান্দারবান, কক্সবাজারে প্রচুর লোকের সমাগম হবে, তারা সবাই হিন্দু নন। তাদের বেশিরভাগই মুসলিম। নাহ, তারা কিন্তু পূজা দিচ্ছেন না, বরং পূজা উপলক্ষে সরকারের দেওয়া ছুটিতে আনন্দ উপভোগ করছেন মাত্র। কিন্তু তাতে কি উৎসব সকলের হওয়া বাকি থাকে? যারা ‘উৎসব সকলের’ বললে রেগে যান সেই ব্যক্তিরাও অন্য ধর্মের উৎসব উপলক্ষে ছুটি কাটাবেন। তাই নয় কি?
পূজার জন্য যে নৌকায় উঠবে মূর্তি, সেই নৌকা কি শুধু হিন্দুদেরই? মাঝি নৌকা চালান, নৌকা ভাড়া দেন, রোজগার করেন, পেট চালান, তিনি পূজা করেন না নৌকায় বসে, জীবিকার খোঁজ করেন। ঈদে যে পশু কোরবানি হয়, তার সব কি মুসলিমের ঘরের পশু? এত পশু যে পাশের দেশ থেকে আসে, সব কি মুসলিমের ঘর থেকে আসে? যে ডেকোরেশন পূজায় করে, তার সব কি হিন্দু ডোকেরেশন হাউস থেকে ভাড়া হয়? যে হিন্দু পরিবার গরু পালে তারা কোরবানি করছেন না। যে মাঝি নৌকা ভাড়া দিয়েছেন পূজার জন্য তিনিও পূজা করছেন না, যে ব্যবসায়ী কাপড় বিক্রি করেছে পূজার সময়ে হিন্দুর কাছে তিনিও পূজা করছেন না। যে ডেকোরেশন হাউস, সাউন্ড-সিস্টেম বা আলোকসজ্জা ভাড়া দিচ্ছে, তারাও পূজা করছেন না। কিন্তু একটা উৎসব উপলক্ষে অর্থের একটা প্রবাহ কিন্তু ঠিকই তৈরি হচ্ছে। ছুটি সবাই পাচ্ছি, নিচ্ছি। এভাবে অন্য ধর্মের আয়োজনে যাই বা না যাই, দেশে যে উৎসব তৈরি হয়েছে তাতে আমরা ঠিকই শরীক হচ্ছি। সেটা জেনে বা না জেনেই। এলাকার নেতা থেকে শুরু করে দেশের নেতা, সবাই নেতা হয়েছেন সকল ধর্মের মানুষের ভোট নিয়েই, কেবল এক ধর্মের ভোটে নয়। তাই তিনি সবার নেতা। তাই সবার আনন্দে তাকে শুভেচ্ছা জানানো তার কাজ। যিনি পুলিশ তিনি মুসলিম হলেও, পূজার অনুষ্ঠানে নিরাপত্তা দিতে দাঁড়িয়ে যান। দুটো মিঠা মুড়কি তিনিও খান। অন্যায় নয়। যিনি ধর্মমন্ত্রী, তিনি সকল ধর্মের মানুষের অধিকারের ব্যাপারই দেখেন, তাদের আয়োজনেও তাকে যেতে হয়। সবচেয়ে কট্টর ইসলামী দলের কেউও যদি ধর্মমন্ত্রী হন (মাথা খাটান), তাকেও কিন্তু পূজার সময়ে ভাবতে হয়, পূজায় পরিদর্শনে যেতে হয়। উৎসবের দোলা লাগে না কোথায়?
নকশী কাঁথার মাঠে পড়েছিলাম, পাশাপাশি দুইগ্রামের মধ্যে লড়াই হয়। দুই গ্রামের মাঝে বিল। ওই গ্রামের গৃহবধু যখন কলসিতে পানি নেয়, তখন যে ঢেউ তৈরি হয় তা এই শত্রু গ্রামেও এসে দোলা দেয়। এই গ্রামের পাখিরা সকাল হলে ওই গ্রামেও খেতে যায়, সন্ধ্যায় ফিরে আসে। তাই বলে সেই পাখি ওই গ্রামের হয়ে যায় না। উৎসবের দোলাও তাই। পূজার ছুটিতে ছুটি পেয়ে মুসলিম বোন আসবে বোনের বাড়ি, মুসলিম ভাগ্নে আসবে খালার বাসায়। পূজা তারা করছেন না, তার ধারে কাছেও তারা নেই। তবে এই বেড়ানোর আনন্দ তাদের মাঝে আনন্দ তৈরি করেছে। দেশের অনেক মানুষ যখন একই সাথে আনন্দিত হয়, তখন তাকে বলে উৎসব। এই উৎসবে অনেকে অনেকভাবে যুক্ত হয়ে যাই আমরা। এভাবে ধর্ম যারই হোক না কেন, উৎসবটা সবারই হয়ে যায়। নিজের ধর্মকে সম্পূর্ণ ঠিক যায়গায় রেখেই আমরা উৎসবে শামিল হয়ে যাই। এই তৃতীয় অর্থের অবতারণা, সেটি আমাদের সামাজিক চিত্র। সেই প্রায়োগিক ও বাস্তবিক অর্থে বলা যায় যে, ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার।’