নিজস্ব প্রতিবেদক »
যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচনমুখী সংস্কার শেষ করে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দীন আহমেদ। নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন জারি রাখার জন্য নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
বিশ্ব গণতন্ত্র দিবস উপলক্ষ্যে মঙ্গলবার (১৭ সেপ্টেম্বর) বিকেলে নগরীর আলমাস মোড়ে চট্টগ্রাম বিভাগীয় বিএনপি আয়োজিত কেন্দ্রঘোষিত ‘গণতন্ত্রের শোভাযাত্রা’ পূর্ব সমাবেশে তিনি এ আহ্বান জানান।
সমাবেশ শেষে শোভাযাত্রা বের হয়। কর্মসূচিকে ঘিরে বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মীর সমাগম ঘটে। সমাবেশস্থলসহ আশপাশের এলাকা লোকে লোকারণ্য হয়ে ওঠে। সালাউদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বে শোভাযাত্রাটি আলমাস হয়ে কাজীর দেউরী, লাভ লেইন, জুবলী রোড়, নিউ মার্কেট, কোতোয়ালী হয়ে লালদিঘি পাড়ে এসে শেষ হয়।
সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে সালাউদ্দীন আহমেদ বলেন বলেন, ‘নির্বাচনমুখী যাবতীয় জরুরি সংস্কারের দায়িত্ব এ সরকারের আছে, বুঝলাম। কিন্তু সব সংস্কার বাস্তবায়নের দায়িত্ব একমাত্র নির্বাচিত সরকারের। সুতরাং নির্বাচিত সরকারের কোনো বিকল্প নেই। আপনারা সংবিধান সংশোধনের জন্য পরামর্শ নিতে পারেন, কিন্তু সেই সংবিধান সংশোধন করবে নির্বাচিত পরবর্তী পার্লামেন্ট।’
তিনি বলেন, ‘সুতরাং অন্তর্বর্তী সরকারের মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা এবং উপদেষ্টাবৃন্দদের আহ্বান জানাই, যতদ্রুত সম্ভব নির্বাচনমুখী সংস্কার সাধন করুন এবং গণতান্ত্রিক নির্বাচনের একটি রোডম্যাপ আপনারা ঘোষণা করুন। তাহলে এদেশের মানুষ আশ্বস্ত হবে যে, বাংলাদেশ সত্যিই প্রকৃত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরে যাবে।’
সাড়ে নয় বছর পর চট্টগ্রামে আসা সালাউদ্দীন নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেন, ‘সবাই ধৈর্য্য ধরুন। সবাই সুশৃঙ্খল থাকুন। গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রাম জারি রাখুন। যতদিন পর্যন্ত এ অন্তর্বর্তী সরকার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরে যাবার ঘোষণা না দেয়, ততদিন এ আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।’
তিনি বলেন, ‘১৯৭১ সালে এই কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার যুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছিলেন আমাদের মহান নেতা শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। ১৯৭৫ সালে বাকশাল পরবর্তী সময়ে দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র ফিরিয়ে এনেছিলেন আমাদের নেতা জিয়াউর রহমান। নয় বছর স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন আমাদের নেত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। আমরাই বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তন করি বাংলাদেশে। ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রবর্তন আমরা করেছিলাম, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের নেতৃত্বে, বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে।’
‘সেই কেয়ারটেকার সরকার বিলুপ্ত করে শেখ হাসিনা বাংলাদেশে নতুনভাবে স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদী শাসনের প্রবর্তন করে। অন্তহীন সংগ্রাম, ত্যাগ-তিতিক্ষা, রক্ত-শ্রম এবং প্রাণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ পুনরায় স্বাধীনতা অর্জন করেছে। এই স্বাধীনতা, এই গণতন্ত্রের জন্য যারা যুদ্ধ করেছে, বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য যারা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছে, তাদের মধ্যে বাংলাদেশে প্রথম শহিদ রংপুরের সাঈদ, দ্বিতীয় শহিদ চকরিয়া-পেকুয়ার সন্তান, আমার সন্তান ওয়াসিম।’
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে বিএনপির নেতাকর্মীদের অবদান তুলে ধরে সালাউদ্দীন বলেন, ‘বন্ধুগণ, যদি আপনারা মনে করেন, সবকিছু এমনি এমনি এসেছে, তাহলে এটা ভুল কথা। মোট ৪৮৫ জন শহিদের মধ্যে এ গণঅভ্যুত্থানে, এ গণবিপ্লবে ৪২২ জন শহিদ বিএনপির নেতাকর্মী। ১১৩ জনের বেশি ছাত্রদলের নেতাকর্মী। এ আন্দোলন-সংগ্রামে সাতশ’র বেশি মানুষ গুম-খুনের শিকার হয়েছে, যার মধ্যে ৪২৩ জন শুধু বিএনপির নেতাকর্মী। দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামে প্রায় ২৭০০ মানুষ বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছে, বিচার বর্হিভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে, তার মধ্যে শত, শত মানুষ বিএনপির নেতাকর্মী।’
‘এত রক্ত, এত ঘাম, এত প্রাণ, এত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমরা অর্জন করেছি বাংলাদেশে নতুন স্বাধীনতা দিবস, বাংলাদেশের নতুন গণতন্ত্র দিবস। বাংলাদেশের মানুষ গণতন্ত্রকে ছিনিয়ে নিয়ে এসেছে। কিন্তু গণতন্ত্র, এই নতুন স্বাধীনতা, এই বিজয়কে যদি আপনারা অর্থবহ করতে চান, তাহলে ধৈর্য্য ধরতে হবে।’
নেতাকর্মীদের উদ্দেশে তিনি আরও বলেন, ‘আন্দোলন জারি রাখতে হবে, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকে মোকাবিলা করতে হবে। সুতরাং চলমান এ আন্দোলন, যদি সত্যিকারভাবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা না হবে, ততদিন চালু রাখতে হবে। প্রকৃত গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যতদিন পর্যন্ত একটি রাজনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠিত না হবে, সংসদ প্রতিষ্ঠিত না হবে, ততদিন পর্যন্ত আমরা রাজপথে এ আন্দোলন অব্যাহত রাখব।’
‘বাংলাদেশে গণহত্যাকারীর আর কোনোদিন জায়গা হবে কি না, শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের, গণহত্যাকারীদের কোনো রাজনীতি চলবে কি না, কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের এখানে তাঁবেদারি চলবে কি না’– সমবেতদের উদ্দেশে এসব প্রশ্ন করে ছুঁড়ে দেন সালাউদ্দীন।
এর পর তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে যদি গণহত্যাকারীদের রাজনীতি চলে, তাহলে বাংলাদেশ আবার পরাধীন হবে। যদি সত্যিকারভাবে স্বাধীন, সার্বভৌম, গণতান্ত্রিক, বৈষম্যহীন, যদি সাম্যভিত্তিক একটি রাষ্ট্র নির্মাণ করতে চান, যদি আইনের শাসনের রাষ্ট্র নির্মাণ করতে চান, তাহলে শহিদের রক্তের প্রতি সম্মান দেখিয়ে আমাদের পরস্পরের অধিকারের প্রতি স্বীকৃতি দিতে হবে। কেউ আইনের চেয়ে বড় নন।’
চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক এরশাদ উল্লাহ’র সভাপতিত্বে ও সদস্য সচিব নাজিমুর রহমানের পরিচালনায় সমাবশে বক্তব্য দেন- দলটির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবুল খায়ের ভূঁইয়া, জয়নাল আবেদীন ফারুক ও গোলাম আকবর খোন্দকার, কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও কর্মসূচির সমন্বয়কারী মাহবুবের রহমান শামীম, কেন্দ্রীয় সহ সম্পাদক মীর মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন, জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য সরওয়ার জামাল নিজাম এবং সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক শাহাদাত হোসেন।
সমাবেশে মীর মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘আমাদের নেতা তারেক রহমান বলেছিলেন, প্রয়োজনীয় সংস্কারের জন্য এ সরকারকে কিছুটা সময় দেবেন। কিন্তু কোনো গোষ্ঠী যদি মনে করে, অনির্বাচিত সরকার অনির্দিষ্টকাল রেখে নিজেদের ফায়দা হাসিল করবে, বাংলাদেশের জনগণ সেটা মেনে নেবে না, নেবে না, নেবে না।’
শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘হাছান মাহমুদ, নওফেলরা নিরাপদে বর্ডার পার হয়ে যায়, আর মুরগি কবিরকে ধরে আপনারা মানুষকে বোঝাবেন না যে, আপনারা সন্ত্রাসীদের ধরছেন। বিচারপতি মানিক কিভাবে জামিন পায়? বেগম খালেদা জিয়াকে বছরের পর বছর জামিন না দিয়ে কারাবন্দি রাখা হয়েছে আর গ্রেফতারের পর মানিক জামিন পেয়ে যায়।’
সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন- বিএনপির কেন্দ্রীয় শ্রম সম্পাদক এ এম নাজিম উদ্দিন, সাবেক সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আবুল হাশেম বক্কর, কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ভিপি হারুনুর রশীদ, কক্সবাজার জেলার সভাপতি, সাবেক হুইপ শাহজাহান চৌধুরী, খাগড়াছড়ির সভাপতি, আব্দুল ওয়াদুদ ভুঁইয়া, কেন্দ্রীয় সহ গ্রাম সরকার সম্পাদক বেলাল আহমেদ, সদস্য সাচিং প্রু জেরী, জালাল উদ্দীন মজুমদার, মশিউর রহমান বিপ্লব, হুম্মাম কাদের চৌধুরী।