নিজস্ব প্রতিবেদক, কক্সবাজার »
মিয়ানমারের সামরিক জান্তা কর্তৃক রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপর বর্বরোচিত নির্যাতন, সহিংসতা, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ ও গণহত্যার ৫ বছর পূর্ণ হয়েছে। এ দিনটিকে রোহিঙ্গারা কালো দিবস আখ্যা দিয়ে ‘রোহিঙ্গা গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছেন।
গতকাল বৃহস্পতিবার কক্সবাজারের উখিয়ার বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে একযোগে সমাবেশের আয়োজন করা হয়। সকাল থেকে লোকজন কুতুপালং খেলার মাঠে জড়ো হতে শুরু করে। সমাবেশে পুরুষদের পাশাপাশি রোহিঙ্গা নারী, শিশুরাও যোগ দেয়।
পোস্টার, প্ল্যাকার্ডে গণহত্যা ও দমন-পীড়নের বিচার ও অধিকার সহকারে মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার দাবি তোলেন রোহিঙ্গারা।
এদিকে রোহিঙ্গা ঢলের ৫ বছরে রোহিঙ্গা গণহত্যা দিবসের সমাবেশে বক্তব্য রাখেন রোহিঙ্গা নেতা মাস্টার শোয়াইব, মাস্টার নুরুল আমিন, মাস্টার জুবায়ের, মোহাম্মদ ইউসুফ, মাস্টার কামাল প্রমুখ।
সমাবেশে আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যানিটির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ জোবায়ের বলেন, ‘আজকে ‘গণহত্যা’ দিবসে পালন করেছি। কারণ এদিনে মিয়ানমার জান্তা সরকার ‘গণহত্যা’ চালিয়েছে। আমরা রিফুজি হয়ে থাকতে চাই না। এখন সোনালি আরকানে ফিরতে চায়। জান্তা সরকার আমাদের নিধন করতে ৫ বার বিতাড়িত করেছে মিয়ানমার থেকে। প্রতিবারই মানবিক বাংলাদেশ আামাদের আশ্রয় দিয়েছে। এজন্য বাংলাদেশ সরকার এবং জনগণকে ধন্যবাদ জানাই।’
উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট দেশটির সেনাবাহিনী রাখাইন অঞ্চলের মংডু, বুচিথং ও রাসেথং জেলার রোহিঙ্গাদের ওপর নির্বিচারে হত্যা ও নির্যাতন শুরু করে। সে সময় বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঢল নামে। তখন সীমান্ত অতিক্রম করে প্রায় ৭ লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশের কক্সবাজারে এসে আশ্রয় নেয়। ওই দিনটিকে স্মরণে কক্সবাজারের বিভিন্ন ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা ‘রোহিঙ্গা জেনোসাইড রিমেম্বার ডে’ পালন করে আসছে।
রোহিঙ্গা ‘গণহত্যা’র পাঁচ বছর পূর্তির উপলক্ষ্যে উখিয়া টেকনাফে আশ্রিত ১, ৩, ৫, ৭, ৯, ১২, ১৩, ৮, ১৯, ২০, নম্বর ক্যাম্পসহ ২২ জায়গায় পৃথকভাবে দিবসটি পালন করেন। তারা সেখানে মিয়ানমারে গণহত্যার বিচার, দ্রুত প্রত্যাবাসনসহ কয়েকটি দাবি তুলে ধরেন।
দাবিগুলো হলো- মিয়ানমারে পার্লামেন্টে রোহিঙ্গা হিসেবে স্বীকৃতি, সীমিত সময় রাখা যাবে মিয়ানমার ট্রানজিট ক্যাম্পে, সকল রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসন করতে হবে, সেফজোন, নিজস্ব সহায়-সম্বল ফেরত, প্রত্যাবাসনের সময় বেঁধে দেওয়া, একবারে গ্রামের সব মানুষকে প্রত্যাবাসন করা, রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী হিসেবে উত্থাপন না করা। এছাড়া প্রত্যাবাসনে প্রক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘ, ওআইসি, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন, বাংলাদেশসহ দাতা সংস্থাকে অন্তর্ভুক্ত করা।
অবনতির দিকে রোহিঙ্গা শিবিরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি
দিন দিন অবনতির দিকেই যাচ্ছে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের ৩৪ রোহিঙ্গা শিবিরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। ইয়াবা পাচার, ডাকাতি, চুরি, হত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধে গত ৫ বছরে ২ হাজার ৪৩৮টি মামলায় আসামি হয়েছেন ৫ হাজার ২২৬ জন রোহিঙ্গা। আর খুন হয়েছেন ১১৫ জন।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর তথ্যমতে, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের নামে অস্ত্র মামলা হয়েছে ১৮৫টি, মাদক ১৬৩৬টি, ধর্ষণ ৮৮টি, হত্যা ১০০টি এবং অপহরণ-মুক্তিপণ আদায়ের মামলা হয়েছে ৪৯টি।
আরেকটি পরিসংখ্যান বলছে, রোহিঙ্গাদের শুরুর তিন বছরে অর্থাৎ ২০২০ সালের ২৫ আগস্ট পর্যন্ত কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বিরুদ্ধে ১২ ধরনের অপরাধে কমবেশি ৭৩১টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় আসামি হয়েছেন ১ হাজার ৬৭১ জন রোহিঙ্গা।
এর মধ্যে শুরুর বছর ২০১৭ সালে মামলা হয়েছিল ৭৬টি, আর আসামি হন ১৫৯ জন। পরের বছর ২০১৮ সালে ২০৮ মামলায় আসামি হন ৪১৪ রোহিঙ্গা। ২০১৯ সালে মামলার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২৬৩টি আর আসামি হন ৬৪৯ জন।
পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে, মানবিক বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মাঝে প্রতি বছরই অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে। শুধু ইয়াবা নয়, ভয়ংকর মাদক ক্রিস্টাল মেথ বা আইস পাচারেও জড়িয়ে পড়েছে তারা। এ ছাড়া আধিপত্য বিস্তার নিয়েও হত্যা, গুম, অপহরণ করে চাঁদা দাবিসহ নানা অভিযোগে তারা অভিযুক্ত।
স্থানীয়দেরও অভিযোগ, রোহিঙ্গারা দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে। ক্যাম্পে কয়েকটি গ্রুপ মাদক পাচারের সঙ্গে জড়িত। তারা মিয়ানমার থেকে সরাসরি ইয়াবার চালান এনে ক্যাম্পে মজুত রাখে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কড়াকড়ির মধ্যেও তারা ক্যাম্পে ইয়াবার চালান, মজুত ও লেনদেন করছে।
দায়িত্বশীল কয়েক কর্মকর্তা জানান, রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘিঞ্জি হওয়ায় সেখানে যখন-তখন অভিযান চালানো সম্ভব হয় না আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর পক্ষে। অপরাধীরা তাই সেখানে অবস্থান করে গা ঢাকা দেয়াসহ নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িত হচ্ছে। আর অধিকাংশ ক্যাম্প পাহাড়সংলগ্ন হওয়ায় কয়েকটি ডাকাতদলের তৎপরতাও বেড়েছে।
রোহিঙ্গা সংকটের দীর্ঘমেয়াদি সমাধানে চেষ্টায় অঙ্গীকার
রোহিঙ্গা সংকটের দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের চেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করেছে ঢাকার ১৪টি দূতাবাস ও হাইকমিশন। রোহিঙ্গা সংকটের ৫ বছরপূর্তি উপলক্ষে গতকাল বৃহস্পতিবার যৌথ বিবৃতিতে দেশগুলো এই অঙ্গীকারের ঘোষণা দেয়।
বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, ৫ বছর পর আমরা ২০১৭ সালের আগস্ট ও সেপ্টেম্বরের ভয়ঙ্কর ঘটনা স্মরণ করি। যা প্রায় ৮ লাখ রোহিঙ্গাকে মিয়ানমার থেকে তাদের বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য করেছিল। আমরা বাংলাদেশ সরকার, বাংলাদেশের জনগণের প্রতি তাদের উদারতা এবং রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অব্যাহত আশ্রয় দেওয়ার জন্য গভীরভাবে কৃতজ্ঞ।
বিবৃতিতে আরও উল্লেখ করা হয়, আমরা আন্তর্জাতিক মঞ্চে রোহিঙ্গাদের দুর্দশার কথা তুলে ধরেছি। পরিস্থিতি অনুকূল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায়, নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ এবং টেকসই প্রত্যাবাসন ও এই সংকটের সমাধান চাই।
আমরা মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর দ্বারা মিয়ানমারজুড়ে ক্রমবর্ধমান সহিংসতা এবং গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিবেদন উদ্বেগের সঙ্গে নোট করছি। আমরা মিয়ানমারে দায়মুক্তির সংস্কৃতির অবসানের আহ্বান জানাই।
রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত ভয়ঙ্কর কর্মকা-ের জন্য আন্তর্জাতিক জবাবদিহিমূলক উদ্যোগের প্রতি আমাদের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করছি।
আমাদের দেশগুলো রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য দায়ী কিছু ব্যক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। আমরা ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারির সামরিক অভ্যুত্থানের কারণে মিয়ানমারে রাজনৈতিক ও মানবিক সংকট সমাধানেও চাপ অব্যাহত রাখব, যেন এই সমাধানে অবশ্যই রোহিঙ্গাদেরও অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মানবিক সহায়তা, সুরক্ষা এবং শিক্ষা নিশ্চিত করতে আমরা বাংলাদেশ সরকার, জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক ও জাতীয় অংশীদারদের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ চালিয়ে যাব।
আমরা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে থাকাকালে নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপনে গুরুত্বের ওপর জোর দিই। একই সঙ্গে শর্ত সাপেক্ষে তাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনে প্রস্তুত করার প্রচেষ্টাকে সমর্থন করি। এছাড়া, আমরা কক্সবাজারের স্থানীয় সম্প্রদায়গুলোকে সমর্থন করে যাচ্ছি যারা শরণার্থীদের আতিথেয়তা দিচ্ছে।
৫ বছর পর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশের জন্য তাদের সমর্থনে সংহতিতে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়েছে। আমরা এই সংকট এবং এর কারণগুলোর দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের চেষ্টা চালিয়ে যাবো।
বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারী দূতাবাস ও হাইকমিশনগুলো হচ্ছে- অস্ট্রেলিয়ান হাই কমিশন, ব্রিটিশ হাইকমিশন, কানাডার হাই কমিশন, ডেনমার্কের দূতাবাস, ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি দল, ফ্রান্সের দূতাবাস, জার্মান দূতাবাস, ইতালির দূতাবাস, নেদারল্যান্ডস দূতাবাস, নরওয়ের দূতাবাস, স্পেনের দূতাবাস, সুইডেনের দূতাবাস, সুইজারল্যান্ডের দূতাবাস ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস।
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনের শিকার হয়ে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া শুরু করেন রোহিঙ্গারা। এরপর গত ৫ বছরে ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। এই বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার পাশাপাশি মানবিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। পাঁচ বছর পরে আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টার পরও রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তন না করতে পারায় তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে।
যেভাবে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে
আশির দশকে নাগরিকত্ব আইন প্রণয়ন করে মিয়ানমারের জান্তা সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার কেড়ে নেয়। ২০১৬ সালের অক্টোবরের শুরুর দিকে ধাপে ধাপে সামরিক প্রচারণা চালিয়ে সেখানকার বাসিন্দাদের রোহিঙ্গা বিদ্বেষী করে তোলা হয়। পরে ৯ অক্টোবর রোহিঙ্গাদের ওপর সেনা ও স্থানীয় মগদের নির্যাতন শুরু হয়।
ওই দিন থেকে কয়েক দফায় বাংলাদেশে রোহিঙ্গারা প্রবেশ করেছে। এর আগেও ১৯৭৮ ও ১৯৯২ সালে অসংখ্য রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। ১৯৭৮ ও ১৯৯২ সালে যারা বাংলাদেশে আসে তাদের কুতুপালং ও টেকনাফের নয়াপাড়ায় দুটি ক্যাম্প রাখা হয়।
কিন্তু ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট আবারও নিপীড়নের মুখে বাংলাদেশে আসতে শুরু করে রোহিঙ্গারা। এ সময় ৭ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। নতুন পুরাতন মিলিয়ে বর্তমানে বাংলাদেশে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা অবস্থান করছে।