সুপ্রভাত ডেস্ক »
নভেম্বর রামুর রশিদনগর এলাকায় ট্রেনের ধাক্কায় একইভাবে মৃত্যু হয় মোটরসাইকেল আরোহী আরও দুই যুবকের।”
চট্টগ্রামের দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথে ট্রেন চলাচল শুরুর পর গত ২০ মাসে দুর্ঘটনায় ৩০ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে বলে রেলওয়ে পুলিশের তথ্যে জানা গেছে।
২০ মাসে ৩০ জনের মৃত্যু
উন্নয়ন, যোগাযোগ আর পর্যটনের নতুন দিগন্ত উন্মোচনের প্রতিশ্রুতি নিয়ে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত সরাসরি রেলসংযোগ নির্মাণ হয়েছিল। কিন্তু উদ্বোধনের দুই বছরেরও কম সময়ের মধ্যে ১০৩ দশমিক ৫৭ কিলোমিটারের এই রেলপথ এখন পরিণত হয়েছে মৃত্যুর করিডরে। গত ২ আগস্ট দুপুরে চট্টগ্রাম- কক্সবাজার রেলপথের রামুর রশিদনগরের ধলিরছড়া রেলক্রসিংয়ে যাত্রীবাহী একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা আটকে যায়। প্রায় ৭০ কিলোমিটার গতির ঢাকাগামী কক্সবাজার এক্সপ্রেস ট্রেনের ইঞ্জিন অটোরিকশাটিকে ধাক্কা দিয়ে প্রায় এক কিলোমিটার টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যায়। ট্রেন থামার পর দুমড়েমুচড়ে যাওয়া অটোরিকশাটি ছিটকে পড়ে বেশ দূরে। এ ঘটনায় পাঁচজন নিহত হন। খবর টিবিএসের। এর আগে, গত ৭ এপ্রিল কক্সবাজারের ঈদগাঁও উপজেলার পালাকাটা এলাকায় অরক্ষিত রেলক্রসিং পার হওয়ার সময় ট্রেনের ধাক্কায় মারা যান এক মোটরসাইকেল আরোহী। এছাড়া, গত বছরের ৯
রেলপথের লেভেল ক্রসিংয়ে টেনের ধাক্কায় এবং রেললাইন পার হতে গিয়ে ট্রেনে কাটা পড়ে এসব মৃত্যু হয়। লেভেল ক্রসিংয়ে প্রতিবন্ধকতা বা ব্যারিয়ার না থাকা এবং পর্যাপ্ত গেটম্যান না থাকার কারণে এসব দুর্ঘটনা ঘটছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। শুধু মানুষ নয়, হাতির প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে নতুন এ রেলপথে। হাজারো কোটি টাকার প্রকল্প, কিন্তু নিশ্চিত হয়নি নিরাপত্তা
রেলওয়ের তথ্যমতে, চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত এই রেলপথ নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ১১ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা। নির্মাণকাজ শেষে আনুষ্ঠানিকভাবে ট্রেন চলাচল শুরু হয় ২০২৩ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে।
প্রথমে এক জোড়া ট্রেন চললেও এখন চলছে চার জোড়া ট্রেন। প্রকল্পটি সমাপ্ত না হলেও ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে। কিন্তু পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি ।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ৭২টি লেভেল ক্রসিংয়ের মধ্যে ৫৬টিতে কোনো ব্যারিয়ার ও গেটম্যান নেই । অরক্ষিত এসব ক্রসিংয়ের দুপাশে পথচারী ও চালকদের জন্য সতর্কতামূলক সাইনবোর্ড বসিয়েই দায় সেরেছে কর্তৃপক্ষ।
গত আগস্টে যেখানে পাঁচজনের প্রাণহানি ঘটে, সেই ধলিরছড়া রেলক্রসিংও ছিল এমন একটি অরক্ষিত গেট ।
রেলওয়ের চট্টগ্রাম বিভাগীয় প্রকৌশলী আবু রাফি মোহাম্মদ ইমতিয়াজ হোছাইন বলেন, দোহাজারীচট্টগ্রাম রেলপথের লেভেল ক্রসিংগুলোর মধ্যে কিছু ম্যান-গেট ও কিছু আনম্যান-গেট আছে। যানবাহন চলাচলের পরিমাণ কম থাকায় গেটম্যান থাকে না। যানবাহন চলাচল বাড়লে সেগুলো বিবেচনা করা হবে।চ
উন্মুক্ত রেলসেকশনগুলোতে প্রাণঘাতী ঝুঁকি
দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত নতুন রেললাইনে মোট ৯টি সেকশন রয়েছে। এর মধ্যে ১৭ কিলোমিটার দীর্ঘ ইসলামাবাদ-রামু সেকশনে সবচেয়ে বেশি অর্থাৎ ১৭টি লেভেল ক্রসিং। কিন্তু গেট ও গেটম্যান রয়েছে মাত্র একটিতে। বাকি ১৬টিতে কোনো ব্যারিয়ার ও গেটম্যান নেই ।
রামু-কক্সবাজার সেকশনে ৮টি লেভেল ক্রসিংয়ের মধ্যে মাত্র একটিতে গেটম্যান আছে। ১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ ডুলাহাজারাইসলামাবাদ সেকশনের ১২টি লেভেল ক্রসিংয়ের মধ্যে মাত্র একটিতে গেটম্যান আছে। ১১ কিলোমিটার দীর্ঘ চকরিয়াডুলাহাজারা সেকশনে ৯টি ক্রসিংয়ের মধ্যে ৩টিতে গেটম্যান আছে।
হারবাং-চকরিয়া সেকশনের ৪টির মধ্যে ২টিতে, লোহাগাড়া হারবাং সেকশনের ৫টির মধ্যে ১টিতে, সাতকানিয়ালোহাগাড়া সেকশনের ৮টির মধ্যে ৩টিতে, দোহাজারীসাতকানিয়া সেকশনের ৮টির মধ্যে ৪টিতে এবং হাসিমপুরুদোহাজারী সেকশনের ১টিতেও গেটম্যান নেই। এগুলো উন্মুক্ত অবস্থায় রয়েছে।
রেলওয়ের কর্মকর্তা বলছেন, ক্রসিংয়ে গেটম্যান ও ব্যারিয়ার থাকবে কিনা, তা শ্রেণি অনুসারে নির্ধারিত। যানবাহন চলাচলের পরিমাণ ও সড়কের প্রশস্ততা হিসাব করে শ্রেণি নির্ধারণ করা হয়। ৭২টি ক্রসিংয়ের মধ্যে মাত্র ১৬টিওও ওওরি শ্রেণির, এগুলোতে গেটম্যান ও ব্যারিয়ার থাকবে। বাকি ৫৬টি স্থি শ্রেণির হওয়ায় সেখানে কেবল সতর্কতামূলক সাইনবোর্ড বসানো হয়েছে।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের রেলপথ পরিদর্শন অধিদপ্তরের (জিআইবিআর) অনুমোদনক্রমে এই শ্রেণি নির্ধারণ বা পরিবর্তন হয়। এর আগে রামুর দুর্ঘটনাস্থলের ক্রসিংগুলোও ছিল স্থি শ্রেণির, যেখানে কোনো ব্যারিয়ার বা গেটম্যান ছিল না।
রামুর স্থানীয় বাসিন্দারা ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপককে চিঠি দিয়ে ব্যারিয়ার ও সতর্কতা ব্যবস্থা স্থাপনের দাবি জানিয়েছেন। কিন্তু সেই চিঠির কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।
হারবাং এলাকার এক বাসিন্দা বলেন, রেললাইনটি আমাদের গ্রামের মাঝ দিয়ে গেছে। ট্রেন কাছাকাছি না এলে শব্দ শোনা যায় না। ফলে আমরা সবসময় আতঙ্কে থাকি ।
শুধু মানুষ নয়, রেললাইনে হাতির মৃত্যুঘটনাও ঘটেছে। ট্রেন চলাচল শুরু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত একাধিক হাতি মারা গেছে বলে জানা যায়।
‘একটি সিগন্যাল বাঁচাতে পারে প্রাণ’
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দোহাজারী কক্সবাজার রেলপথে ট্রেনের হুইসেল শুনে তাড়াহুড়ো করে মানুষ সরে যান। অরক্ষিত অবস্থার কারণে রেলপথটি বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। বাজার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও হাসপাতালেও যেতে হয় রেলপথ অতিক্রম করে। রেলপথটির কিছু স্থানে বাঁক থাকায় দূর থেকে ট্রেন আসছে কি না, তা দেখা যায় না।
দুর্ঘটনা এড়াতে ক্রসিংগুলোতে সিগন্যালিং সিস্টেম স্থাপনের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ ভবিষ্যতে এই রেলপথে ট্রেনের সংখ্যা আরও বাড়বে, ফলে ঝুঁকিও বাড়বে বলে মনে করছেন তারা।
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক মাহমুদ ওমর ইমাম বলেন, ‘ক্রসিংয়ে যানবাহন চলাচলের সংখ্যার বিষয়ে সঠিকভাবে জরিপ করা হয়েছে কিনা, তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। তারা ঠিকভাবে কাজ করছে কিনা, তত্ত্বাবধান হয়েছে বলে মনে হয় না।’
তিনি বলেন, ‘বেশি যানবাহন চলাচলকারী ব্যস্ত লেভেল ক্রসিংয়ে অবশ্যই প্রতিবন্ধকতা দিতে হবে, সার্বক্ষণিক গেটম্যান রাখতে হবে। দূর থেকে ট্রেন দেখা যায় না, এমন বাঁকও রয়েছে।
রেলপথের সিগন্যালিং সিস্টেম তুলনামূলক স্বল্প ব্যয়ী ও সহজ উল্লেখ করে তিনি বলেন, “রেলপথে সিগন্যালিং সিস্টেম স্থাপন করতে হবে। রেল ট্র্যাকে এটি করা সহজ। দুপাশে সিগন্যাল বাতি থাকবে, যখন ট্রেন যাবে তখন ঘণ্টা বাজবে ও লাল বাতি জ্বলবে। প্রকল্পের মধ্যে এটি কেন যুক্ত করা হয়নি, তা বোধগম্য নয়।চ
কর্তৃপক্ষও স্বীকার করেছে দুর্বলতা, পর্যালোচনার আশ্বাস
দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ও রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক মো. সবুক্তগীণ বলেন, ‘প্রকল্পে আরও বেশি ক্রসিং ছিল। ইতোমধ্যে ৪৬টি ক্রসিং আমরা নিরাপত্তার স্বার্থে আন্ডারপাসে রূপান্তর করেছি।’
তিনি বলেন, ‘প্রকল্প চলাকালে বিভিন্ন সময়ে এসব ক্রসিংয়ে যানবাহন চলাচলের জরিপ করা হয়েছিল। রেলের নির্ধারিত ম্যানুয়াল অনুসারে এবং জিআইবিআরের অনুমোদনক্রমে ক্রসিংয়ের গেটম্যান ও ব্যারিয়ার নির্ধারণ করা হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সমস্যা হয় যখন এলজিইডি (স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর), পৌরসভা বা ইউনিয়ন পরিষদ অনেক সময় রাস্তা প্রশস্ত বা পাকা করে, কিন্তু আমাদের কিছু জানায় না। তবুও আমরা দুর্ঘটনার পর প্রকৌশলীদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করেছি। কোন ক্রসিংয়ে গেটম্যান ও ব্যারিয়ার লাগবে, তা বিবেচনা করে তারা সুপারিশ করবেন। এটি জিআইবিআরে পাঠানো হবে।’
সিগন্যাল সিস্টেমের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘স্টেশনকে কেন্দ্রে করে কিছু সিগন্যাল আছে। তবে এটি ভালো পরামর্শ। সিগন্যাল ও ঘণ্টা দেওয়া গেলে মানুষ দূর থেকে বুঝতে পারবেন, ট্রেন আসছে। এটি বিবেচনা করা হবে।’
তবে যতক্ষণ পর্যন্ত এসব ব্যবস্থা না নেওয়া হচ্ছে, ততক্ষণ রেলপথের পাশে বসবাসকারী মানুষদের ভরসা কেবল চোখ, কান আর ভাগ্যের ওপরেই। প্রতিটি ট্রেনের হুইসেলে পথচারীরা ছুটে সরে যান, মায়েরা সন্তানকে আঁকড়ে ধরেন, আর চালকরা প্রার্থনা করেন যেন তাদের গাড়ি রেললাইনে থেমে না যায়।
কক্সবাজার রেললাইন নির্মাণ হয়েছিল উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি হিসেবে। কিন্তু এখন তা মনে করিয়ে দিচ্ছে এক ভয়াবহ সত্য-নিরাপত্তাহীন উন্নয়ন মানেই অপেক্ষমাণ এক মর্মান্তিক বিপর্যয়।