হাবিবুল হক বিপ্লব »
উৎসবের মধ্য দিয়ে নতুন বছরের আগমনকে স্বাগত জানানোর সূচনা প্রায় চার হাজার বছর আগে। প্রাচীন ব্যাবিলনে মার্চের শেষের দিকের মহাবিষুব-এর পর (মার্চ মাসে সূর্য যখন বিষুবরেখাকে অতিক্রম করে, তখন তাকে বলা হয় মহাবিষুব) নতুন চাঁদ উঠলে তাকে নতুন বছরের সূচনা বিবেচনা করা হতো। প্রাচীন যুগ থেকে সভ্যতার যুগে পদার্পণের পর বিশ্বে আধুনিক ধারার বর্ষপঞ্জি তৈরি হতে থাকে। সাধারণত কৃষিজীবন কিংবা জ্যোতির্বিদ্যার সাপেক্ষে বছরের প্রথম দিনটি নির্ধারিত হতো। মিসরে নতুন বছরের সূচনা হতো নীল নদের বাৎসরিক বন্যা সাপেক্ষে। চীনা নববর্ষের প্রথম দিনটি নির্ধারিত হতো মকরক্রান্তির পর ওঠা দ্বিতীয় নতুন চাঁদের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে। তবে বর্ষ গণনায় এখন বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করা হয়ে থাকে। এর বাইরে কোনও বর্ষপঞ্জির ভিত্তি ধর্মীয়, কোনটার ভিত্তি আবার লুনার সাইকেল। চীনা বর্ষপঞ্জির ভিত্তি চাঁদের আবর্তন ও সৌর বর্ষ । উদযাপনের সংস্কৃতিতেও রয়েছে ভিন্নতা। বালিনিজরা পুরো দিন একেবারে নীরব থেকে নতুন বছরকে স্বাগত জানিয়ে থাকে। বার্মিজরা আবার তিন-চারদিন ধরে পানি উৎসবের মধ্য দিয়ে নববর্ষ উদযাপন করে। সমাজের প্রবীণ ব্যক্তিদের গায়ে পানি ঢেলে আশির্বাদ গ্রহণের রীতি পালন করে থাই জনগণ। প্রাচীন ব্যাবিলনে নববর্ষ আকিতু নামক ধর্মীয় উৎসবের মধ্য দিয়ে নববর্ষ উদযাপন করতো প্রাচীন ব্যাবিলনের মানুষেরা। আকিতু শব্দটি এসেছে বার্লি বা যবের সুমেরীয় নাম থেকে। ব্যাবিলনে তখন নববর্ষ উদযাপন করা হতো ১১ দিন ধরে। প্রতিদিনই ভিন্ন ভিন্ন রীতির উৎসব পালন করা হতো। নববর্ষের পাশাপাশি আতিকুকে অশুভ সমুদ্র দেবী তিয়ামাতের বিরুদ্ধে ব্যাবিলনীয় আকাশ দেবতা মার্ডুকের পৌরাণিক বিজয় হিসেবেও উদযাপনের সংস্কৃতি ছিল। এর নেপথ্যে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও ছিল। ওই সময়ে নতুন রাজাকে মুকুট পরানো হতো কিংবা বিদ্যমান শাসকের কথিত দৈব আদেশের প্রতিকী নবায়ন হতো।
খ্রিস্টীয় নববর্ষ: আদি রোমান দিনপঞ্জিকায় ১০টি মাস অন্তর্ভুক্ত ছিল। এক বছরে দিনের সংখ্যা ছিল ৩০৪। প্রথা অনুযায়ী মহাবিষুবের সময় প্রতিটি নতুন বছর শুরু হতো। সে সময় ১ মার্চকে নববর্ষের প্রথম দিন হিসেবে উদযাপন করা হতো। খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতকে রোমের প্রতিষ্ঠাতা রোমুলাস এই বর্ষপঞ্জি তৈরি করেছিলেন। পরবর্তীতে রাজা নুমা পম্পিলিয়াস রোমান দিনপঞ্জিকায় জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাস যুক্ত করেছিলেন। তকে কয়েক শতক ধরে সূর্যের গতির সঙ্গে এ দিনপঞ্জিকার সামঞ্জস্য হচ্ছিলো না। খ্রিস্টপূর্ব ৪৬ অব্দে সম্রাট জুলিয়াস সিজার তৎকালীন প্রখ্যাত জ্যোতির্বিদ ও গণিতবিদদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সংকট নিরসনের সিদ্ধান্ত নেন। তৈরি হয় জুলিয়ান বর্ষপঞ্জি। সংস্কারের অংশ হিসেবে রোমান প্রারম্ভ দেবতা ‘জানুস’কে সম্মান জানিয়ে ১ জানুয়ারিকে বছরের প্রথম দিন হিসেবে নির্ধারণ করেন সিজার। প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী জানুসের দুই মুখ ছিল এবং তা দিয়ে তিনি অতীত ও ভবিষ্যত দেখতে পেতেন। রোমানরা জানুসের প্রতি বিভিন্ন জিনিস উৎসর্গ করে, একে অপরের সঙ্গে উপহার আদান-প্রদান করে, লরেল গুল্মগুচ্ছ দিয়ে ঘর সাজিয়ে, উচ্চস্বরে আয়োজিত পার্টিতে অংশ নিয়ে রোমানরা নববর্ষ উদযাপন করতো। মধ্যযুগীয় সময়ের এসে ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে ১ জানুয়ারিকে নববর্ষের প্রথম দিন থেকে বাদ দেওয়া হয়। এ সময় ইউরোপের কোথাও ২৫ ডিসেম্বর, কোথাও ১ মার্চ আবার কোথাও ২৫ মার্চ নববর্ষ উদযাপন করা হতো। তবে ১৫৮২ সালে গ্রেগরিয়ান দিনপঞ্জিকা অনুযায়ী ১ জানুয়ারিকে আবার নতুন বছরের প্রথম দিন হিসেবে উদযাপন করা হয়। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ১ জানুয়ারিকে বছরের প্রথম দিন হিসেবে উদযাপন করা হয়ে থাকে।
লুনার নিউ ইয়ার-চীন:চীনের মানুষেরা লুনার নববর্ষ উদযাপন করে ১৫ দিনে ধরে। পাশাপাশি ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনামসহ কয়েকটি এশীয় দেশেও পালন করা হয় এ নববর্ষ। এটি ‘স্প্রিং ফেস্টিভ্যাল’ বা বসন্তকালীন উৎসব নামেও পরিচিত। শীতকালের শেষের দিকে এবং বসন্ত শুরু হওয়ার আগে আগে এ উৎসব শুরু হওয়ার কারণে এমন নামকরণ করা হয়েছে। ঐতিহ্যবাহী লুনিসোলার নামক চৈনিক দিনপঞ্জিকা অনুযায়ী লুনার নববর্ষ পালন করা হয়ে থাকে। এ পঞ্জিকা দিয়ে চাঁদের আবর্তন ও সৌর বর্ষের সময় নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। ক্লিমসন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ইয়ি উ মনে করেন, ‘লুনার নববর্ষের তারিখ প্রতি বছরই পরিবর্তিত হয়।’ উ বলেন, নতুন চাঁদ দেখার ভিত্তিতে চীনা লুনার ক্যালেন্ডারের তারিখ অনুযায়ী ২১ জানুয়ারি থেকে ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত যেকোন একটি দিনকে নববর্ষের প্রথম দিন হিসেবে উদযাপন করা হয়ে থাকে। জোডিয়াক সাইকেলে থাকা ১২টি পশুর যেকোনও একটির নামে প্রতি বছর নববর্ষের নামকরণ করা হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ২০১৮ সালের লুনার নববর্ষের নাম ছিল দ্য ইয়ার অব দ্য ডগ। লুনার নিউ ইয়ার এর প্রথম দিন থেকে উদযাপন শুরু হয় আর ১৫-তম দিনে লণ্ঠন উৎসবের মধ্য দিয়ে তা শেষ হয়।
রোশ হাশানাহ-ইসরায়েল:বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থাকা ইহুদিরা সেপ্টেম্বর অথবা অক্টোবরে রোশ হাশানাহ (ইহুদি নববর্ষ) পালন করে থাকে। রোশ হাশানাহ’র অর্থ হলো ‘হেড অব দ্য ইয়ার’ বা ’বছরের মাথা’। দিনটিকে বিবেচনা করা হয় আনন্দ, আত্মদর্শন ও আরও একটি বছর শেষ করার উদযাপনের সময় হিসেবে। হিব্রু ক্যালেন্ডারের সপ্তম মাস তথা তিশেরির প্রথম দুই দিন ইহুদি নববর্ষ উদযাপিত হয়ে থাকে। ইহুদি উপসনালয় সিনাগগে শফার বা রামের শিং বাজানো, খেজুর, বিট ও আনারের মতো ফলগুলো খাওয়ার মধ্য দিয়ে ঐতিহ্য পালন করা হয়। প্রত্যেক ফল খাওয়ার পেছনেই বিশেষ অর্থ রয়েছে। যেমন-প্রার্থনার পর মধুতে পরিপূর্ণ আপেল খাওয়াটা জনপ্রিয় একটি ইহুদি ঐতিহ্য। প্রাচীনধারার ইহুদিরা বিশ্বাস করতেন, আপেলের মধ্যে নিরাময়ের বৈশিষ্ট্য রয়েছে আর মধু হলো মিষ্টি একটি নতুন বছরের প্রতীক।
নওরুজ-ইরান:নওরুজ মানে হলো নতুন দিন। ১৩ দিন ধরে ইরানের প্রায় ৭ কোটি ৫০ লাখ ও আফগানিস্তানের প্রায় ৩ কোটি মানুষ নওরুজের জন্য প্রকৃতির পুনর্জন্মকে উদযাপন করে থাকে। বসন্তের শুরুতে নওরুজ পালিত হয়। এটি পার্সিয়ান নববর্ষ নামেও পরিচিত। ইতিহাসের সবচেয়ে পুরনো উদযাপনগুলোর একটি এটি। প্রায় ৪ হাজার বছর ধরে উদযাপিত হয়ে আসছে নওরুজ। ভ্রমণবিষয়ক লেখক ও ট্রাভেলার্স আর্কাইভ নামক ম্যাগাজিনের ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর ক্লিমেনস সেহি বলেন, ‘জার্মানিতে এটিকে বড়দিনের মতো করেই উদযাপন করা হয়। ইরানে পরিবারগুলো একত্রিত হয় ও একে অপরকে উপহার দেয়। আর যুক্তরাষ্ট্রে এটি অনেকখানি ব্ল্যাক ফ্রাইডের মতো করে উদযাপন করা হয়, কারণ কেনাকাটা ও নতুন পোশাক পরিধানকে এক্ষেত্রে গুরুত্ব দেওয়া হয়। নওরুজ উপলক্ষে নতুন সূচনার অনুভূতি থেকে ঘর-বাড়ি ধোঁয়া-মোছা ও পরিষ্কার করা হয়।
বাংলা নববর্ষ ও দিওয়ালি: বাংলাদেশে ১৪ এপ্রিল আর ভারতে ১৫ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ উদযাপন করা হয়ে থাকে। বাংলা পঞ্জিকার প্রথম মাস বৈশাখের প্রথম দিনে পালিত হয় এ নববর্ষ। শুভ নববর্ষ বলে বাঙালিরা একে অপরকে শুভেচ্ছা জানান। রাস্তায় রাস্তায় আযোজিত হয় বৈশাখী মেলা। বের হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। ভ্রমণবিষয়ক লেখক ও ট্রাভেলার্স আর্কাইভ নামক ম্যাগাজিনের ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর ক্লিমেনস সেহি লিখেছেন, ফসলের মৌসুমের শুরুতে বাংলা নববর্ষ উদযাপিত হয়। বাঙালিরা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করে থাকে। আর শিখ সম্প্রদায়ের মানুষ নেচে-গেয়ে ও ধর্মীয় গ্রন্থ পাঠ করে নববর্ষকে স্বাগত জানায়।’ এদিকে ভারতসহ বিশ্বজুড়ে থাকা শিখ, হিন্দু ও জৈনরা দিওয়ালি উদযাপন করে থাকে। হিন্দু নববর্ষের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে দিওয়ালি উদযাপন করা হয়ে থাকে। হিন্দু লুনার বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকে নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ের কোনও দিনে দিওয়ালি হয়ে থাকে। পাঁচদিন ধরে এ উৎসব স্থায়ী হয়। পার্সিয়ান নতুন বছরের মতো করে দিওয়ালির সময়ও ঘর-বাড়ি পরিষ্কার করা হয়। পরিধান করা হয় নতুন পোশাক।
হিজরি নববর্ষ: মুসলিম দিনপঞ্জিকার প্রথম মাস মহররমের প্রথম দিনে ইসলামী নববর্ষ বা হিজরি নববর্ষ পালন করা হয়ে থাকে। মহানবী হযরত মোহাম্মদ (স.) এর মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করার দিনটিকেই বছরের সূচনা হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। মুসলিম দিনপঞ্জিকা অনুযায়ী সূর্যাস্তের মধ্য দিয়ে দিনের শুরু হয়। চাঁদ দেখার ভিত্তিতে নববর্ষের আগমন ঘটে। হিজরি নববর্ষের প্রথম দিনটিতে মুসলিম বিশ্বে ছুটি ঘোষণা করা হয়ে থাকে।
ইথিওপিয়ান নববর্ষ: ইথিওপিয়ান নববর্ষ স্থানীয় ভাষায় একুটাটাশ নামে পরিচিত, যার অর্থ ‘গিফট অব জুয়েল’ বা জহরতের উপহার। বর্ষা শেষে সেখানে নববর্ষের আগমন ঘটে। ১১ সেপ্টেম্বর নেচে-গেয়ে ও একে অপরকে ফুল দিয়ে নতুন বর্ষকে আমন্ত্রণ জানায় ইথিওপিয়ানরা। খাবারদাবারের আয়োজনটাও হয় চোখে পড়ার মতো।