সাধন সরকার »
স্বাধীনতার ৪৮ বছর অতিক্রমের পরেও রাজনীতিতে ইতিবাচক সংস্কৃতির ধারা এখনো কেন জানি গড়ে ওঠেনি! কিন্তু পিছনে ফিরে তাকালে দেখতে পাই ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯-র গণঅভ্যুত্থান ও সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধে তরুণদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ও নেতৃত্বের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। যুগে যুগে তরুণেরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তাদের নেতৃত্বের গুণে কাক্সিক্ষত ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা করেছে। আমাদের দেশে ষাট-সত্তর দশকের রাজনীতির লক্ষ্য ছিল জনগণের ও দেশের জন্য কল্যাণকর কিছু করা। কিন্তু স্বাধীনতার আরও পরের দিকে অর্থাৎ ১৯৭৫ সালে জাতির জনকের মৃত্যুর পর দীর্ঘ সামরিক শাসন এবং তারপর পালাক্রমে শীর্ষ দুই দলের দেশ পরিচালনার রাজনীতিতে তেমন কোনো গুণগত পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়নি। বাংলাদেশে গণতন্ত্র এখনো খুব যে ভালো অবস্থানে রয়েছে তেমনটি বলার কোনো কারণ নেই। গণতন্ত্রের বিকাশ ও প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের জন্য প্রয়োজনীয় সময় এদেশের রাজনীতিতে আসেনি, একথা বলা যাবে না। দরকার ছিল দীর্ঘ রাজনৈতিক ক্রিয়াকর্মের ভিতর দিয়ে অগ্রসর হওয়া এবং নিজেদের কর্মকা-ের মূল্যায়ন করা। কিন্তু তা হয়নি।
জানুয়ারি, ২০২০ সালে প্রকাশিত হয় যুক্তরাজ্যের ইকোনমিস্ট গ্রুপের গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্ট (ঊওট)- এর নবম ‘বৈশি^ক গণতন্ত্র সূচক-২০১৯’। এতে অন্তর্ভুক্ত ১৬৫ টি সার্বভৌম দেশ ও ২ টি অঞ্চলের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৮০ তম। অর্থাৎ বাংলাদেশ ‘হাইব্রিড’ তথা সংকরধারার গণতান্ত্রিক দেশের শ্রেণিভুক্ত। সহজ কথায় বলতে হয়, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা খুব একটা ভালো নয়। বলা হচ্ছে, বাংলাদেশ উন্নতি ও অগ্রগতির অনেক দিক দিয়ে বিশে^ ‘রোল মডেল’। তাই যদি হয় তাহলে এর পুরোভাগে রয়েছে তরুণদের অংশগ্রহণ। তবে রাজনীতির গুণগত পরিবর্তনের ক্ষেত্রে এদেশ অনেক পিছিয়ে। অন্যান্য সেক্টরে তরুণদের অংশগ্রহণ থাকলেও কেন রাজনীতিতে তরুণদের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না ? বেসরকারি এক তথ্য মতে, দেশের অর্ধেকের বেশি তরুণ-তরুণী রাজনীতিতে তাদের অনাগ্রহের কথা প্রকাশ করেছে। যা দেশের জন্য অশনিসংকেত!
দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলের বৈশিষ্ট্য হলো- নীতিহীনতা, গণতান্ত্রিক চর্চার অভাব, ক্ষমতার অপব্যবহার, কলোটাকার প্রভাব, দুর্নীতিবাজদের প্রশ্রয়, সহনশীলতা ও সুশাসনের অভাব ইত্যাদি। সহনশীলতা গণতন্ত্রের প্রাণ। এটির অভাবে রাজনৈতিক দলগুলো যেন পরস্পরে কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি করে চলেছে! এমনকি জাতীয় সংকটকালীন মুহূর্তেও দলগুলোকে একে-অপরের সাহায্যে এগিয়ে আসতে দেখা যায় না।
রাজনীতিতে গুণগত ও ইতিবাচক পরিবর্তনে এবং দেশের মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা অর্জনে এখন তরুণ নেতৃত্ব আবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে। তরুণেরা এখন ভবিষ্যৎ নয়, তরুণেরা জাতির বর্তমান হতে চায়। এখন তারা দেশের জন্য কিছু করতে চায়। এই তরুণদের হাত ধরে স্বৈরাচার পতনের ডাক এসেছিল। এই তরুণ-তরুণীরা শাহবাগে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ঐক্যের সূচনা করেছিল। রাজনীতি হলো প্রবহমান নদীর মতো। ভালো মানুষ বা তরুণরা নেতৃত্বে না আসলে রাজনীতির জায়গা ফাঁকা থাকবে না। খারাপ নেতৃত্বের দ্বারা তা পূর্ণ হয়ে যাবে। তরুণ নেতৃত্ব যে আসছে না তা নয়, কিন্তু তারা টিকতে পারছে কই! এখানে থাকতে হলে যে অনিয়ম ও শৃঙ্খলহীনতাকে মেনে নিয়ে থাকতে হয়! তৃণমূল থেকে জাতীয় সব ক্ষেত্রে এই একই হাল। বিভিন্ন সময় দেখা যায় তরুণ-তরুণীরা খেলাধুলা, বিনোদন, পরিবেশ, অর্থনীতি ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করে। কিন্তু যখনই দেশের রাজনীতির কথা আসে তখন বলে ওঠে ‘এই প্রসঙ্গ বাদ থাক’। তরুণ-তরুণীদের মাথায় অনেক প্রশ্ন খেলা করে, দেশের রাজনীতিতে কি সুদিন ফিরবে ? নেতিবাচক রাজনীতির কি অবসান হবে ? দলগুলোর অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক চর্চা কি বাড়বে ? কবি আবুল হাসানের কাব্যগ্রন্থের মতো বলতে হয় ‘রাজা যায় রাজা আসে’। কিন্তু বাস্তবে সুদিন আর ফিরে না। বিশ^বিদ্যালয়ে দেখা যায়, যারা ভালো রেজাল্ট করে কিংবা যাদের মধ্যে একটু দেশপ্রেম ও মানবতাবোধ লক্ষ্য করা যায় তারা রাজনীতিতে আসতে চায় না। এখন ছাত্র রাজনীতিতে অছাত্ররাই বেশি। নেতিবাচক কর্মকা-ের জন্য তাদের বদনামও হচ্ছে। দলীয় ব্যবস্থাপনা এমন এক জায়গায় পৌঁছেছে যে ছাত্র-ছাত্রীরা আজ নিজের মতামতটুকুও প্রকাশ করতে ভুলে যাচ্ছে!
সম্প্রতি কমনওয়েলথ ‘বিশ^ মানবসম্পদ উন্নয়ন সূচকের’ আদলে বৈশি^ক যুব উন্নয়ন সূচক বা ইয়ূথ ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্সে (ওয়াইডিআই) রাজনীতিসহ অন্যান্য কয়েকটি সূচকে বাংলাদেশ নিচের সারিতে অবস্থান করছে। এই সূচকে বলা হয়েছে, রাজনীতিতে তরুণদের অংশগ্রহণ কমছে। সড়ক দুর্ঘটনা ও ধর্ষণবিরোধীর মতো জাতীয় ইস্যুতে সর্বস্তরের মানুষের মানববন্ধনেও এখন হামলা হয়! বর্তমানে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা মিলিয়ে যে পরিবেশ তা মোটেই তরুণদের রাজনীতিতে আকৃষ্ট করে না। রাজনীতিতে আকৃষ্ট করার মতো ‘রোল মডেল’ তরুণদের সামনে এখন আছে বলে মনে হয় না।
শাসক গোষ্ঠী বা নীতিনির্ধারকরা চায় না এদেশের শিক্ষিত তরুণ-তরুণীরা রাজনীতিতে আসুক! কেননা পরিবর্তনকে অনেকে ভয় পায়। দিন দিন রাজনীতি ব্যবসায়ীদের হাতে চলে যাচ্ছে। স্বার্থের রাজনীতি ও দলীয় প্রভাবের রাজনীতি এখন দৃশ্যমান। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সমাজ যখন রাজনৈতিকভাবে অসচেতন হয়, তখন তা সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য কখনো শুভ হতে পারে না। দার্শনিক জর্জ বার্নাড শ’ এর কথায় বলতে হয়, ‘নতুন কিছু করাই তরুণদের ধর্ম’। সত্যিই তরুণেরা নতুনের পূজারি। অনেক সময় আক্ষেপ করে বলতে শোনা যায়- মেধাবীরা রাজনীতিতে না আসলে রাজনীতি মেধাশূন্য হয়ে যাবে। কল্যাণকর রাজনীতির চর্চায় তরুণেরা নেতৃত্ব দিতে চায়। একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গঠন ও কার্যকর গণতন্ত্রের ভিত্তি মজবুত করতে হলে এবং রাজনীতিতে ইতিবাচক ও যোগ্য নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় তরুণ নেতৃত্বের অংশগ্রহণ সবার আগে জরুরি। এই তরুণদেরকেই এখন সব অন্যায়ের প্রতিবাদ ও মুক্তিযুদ্ধের শক্তির পক্ষে অবস্থান নিয়ে কাজ করতে হবে। সংস্কৃতির বিকাশ সাধন এবং উন্নয়ন স্থায়ী করতে হলে রাজনীতিতে তরুণদের সম্পৃক্ত করতে হবে। আর এ দায়িত্ব নীতিনির্ধারকদেরই নিতে হবে।
লেখক : পরিবেশকর্মী, কলামলেখক