দেশপ্রেম

মোহীত উল আলম »

“এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি,
সকল দেশের রানি সে যে আমার জন্মভূমি।”
গীতিকার-নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের এই চরণযুগল দেশপ্রেমকে সর্বোতভাবে সংজ্ঞায়িত করে। জন্মভূমিটির নাম আমাদের জন্য বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর বড় আদরের বাংলাদেশ। আমাদের বড় ভালোবাসার বাংলাদেশ। এই দেশের প্রতি অকুণ্ঠ এবং নির্বাধ প্রেম থাকাই আমাদের সকলের জন্য পরম আরাধ্য।
কিন্তু কিসে থেকে কী হয়ে গেল! প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শ্রম ও মেধা দিয়ে তিল তিল করে গড়ে তোলা বাংলাদেশ যখন উন্নত দেশে পরিগণিত হতে এগিয়ে যাচ্ছিলো তখনই ভয়াবহ কয়েকদিনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের পরে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ দেখে পুরো জাতি স্তম্ভিত। মহাখালীস্থ সেতুভবন আর রামপুরাস্থ বাংলাদেশ টিভি ভবনের ছবি পত্রিকায় দেখে গা শিউরে ওঠে। একটি জনপ্রিয় জাতীয় পত্রিকায় একজন মহিলা সাংবাদিকের সরেজমিন প্রতিবেদন পড়ে মনে হলো যেন ট্রয়নগরীর ধ্বংসযজ্ঞ মনের চোখে দেখলাম।
এই লেখাটি লেখার সময় (২৪ জুলাই সকাল) মনে পড়ল গত পরশুই সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকারউজ্জামান সাংবাদিকদের কাছে অতিশয় বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছেন, বিভিন্ন স্থাপনা ধ্বংস করার পেছনে কী যুক্তি থাকতে পারে? সেগুলিতো দেশের তথা জনগণের সম্পদ! অর্থাৎ, দেশপ্রেমের অভাবের কথা সখেদে বলেছেন তিনি।
সরকারের দিক থেকে পরিস্থিতিকে বশে আনার জন্য লাগাতার কারফিউ ঘোষণা ও সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সকল বাহিনীকে নিয়োজিত করা হয়েছে, এবং পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে আসছে। আমেরিকার সুপ্রিম কোর্টের একজন সর্বজন শ্রদ্ধেয় বিচারপতি ছিলেন, অলিভার ওয়েন্ডেল হোমস, জুনিয়র। আমেরিকার শাসনতন্ত্রের প্রথম সংশোধনী ফ্রিডম অব স্পিচ বা বাক-স্বাধীনতার ওপর একটি মন্তব্য করতে গিয়ে তিনি ১৯১৯ সালে বলেন, সরকার যদি অনুধাবণ করে যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে, অর্থাৎ “ক্লিয়ার এ্যান্ড প্রেজেন্ট ডেঞ্জার” (পরিস্কারভাবে তাৎক্ষণিক বিপদের সৃষ্টি) তৈরি হয়েছে তখন জনগণের জানমাল রক্ষার্থে সরকার যে কোন জরুরি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ক্ষমতা রাখে। সে অর্থে বলা যায়, বর্তমান সরকারের সকল কার্যক্রম ক্লিয়ার অ্যান্ড প্রেজেন্ট ডেঞ্জার তৈরি হয়েছিলো বলেই গৃহীত হয়েছে।
বর্তমান সরকার দ্বিতীয় দফায় প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পরপরই, ২০০৯ সালের ফেবৃুয়ারি মাসের শেষের দিকে মুখোমুখি হয় বিডিআর বিদ্রোহের যেটি দমনে সরকার সফল হয়। এরপর দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার সময়, ২০১৪ সালে জামাত-শিবির ও বিএনপির লাগাতার সশস্ত্র হরতাল ও অগ্নিসন্ত্রাসের তিনমাসব্যাপী চলমান আন্দোলনকেও সরকার কঠোর হস্তে দমন করতে সফল হয়। এবং স্বাধীনতাকামী বাঙালি জনগণের দীর্ঘদিনের দাবি যুদ্ধাপরাধীদের প্রথম সারির নেতাদেরকে মৃত্যুদন্ডসহ নানান শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে সরকার নিজেকে একটি শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে যায়, সাথে থাকে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর অকুন্ঠ সমর্থন। কিন্তু তৃতীয়বার নির্বাচিত হবার পর, অর্থাৎ ২০১৮ সালের পর থেকে সরকার পদ্মা সেতু ও পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু টানেল, ও ঢাকায় মেট্রো রেল চালুর মতো অসামান্য উন্নয়ন সাফল্য অর্জন করতে থাকলেও করোনার কারণে ও বিশ্ব অর্থনীতির মন্দার কারণে অর্থনীতির ক্ষেত্রে বেসামাল অবস্থার সৃষ্টি হতে থাকে। জনজীবনে কিছুটা হলেও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিসহ নানান কারণে অস্থিরতা পরিলক্ষিত হয়। আর ২০২৪-এ নির্বাচিত হবার পর, অর্থাৎ দ্বিতীয় দফায় টানা চতুর্থবার নির্বাচিত হবার পর পত্রপত্রিকায় নানান শীর্ষ পদধারীর কর্মকর্তার হাজার হাজার কোটি টাকার লোপাটের কাহিনী জনমনে নানান রকম শংকা তৈরি করতে থাকে যা দমনে, দু:খজনকভাবে, সরকারের কার্যক্রমে দ্রততার চেয়েও শ্লথ গতি পরিলক্ষিত হয়।
আর ঠিক এ সময়ে ঘটলো কোটা আন্দোলন নিয়ে ঘটনাবলীর। বৈষম্যপ্রথা বিরোধী আন্দোলনকারীদের দাবি-দাওয়ার সপক্ষে উচ্চ-আদালত যে ঐতিহাসিক রায় দিয়েছে, এবং তার আলোকে সরকার যে সহসা প্রজ্ঞাপন জারী করেছে তার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে আদর্শগত অবস্থান থেকে নামিয়ে উপযোগিতার স্তরে ব্যবহার করার পথ রুদ্ধ করা হলো।
এটা খুবই আমলযোগ্য যে কোটাবিরোধী আন্দোলনের পেছনে সরকার-বিরোধী, দেশ-বিরোধী, মুক্তিযুদ্ধ-চেতনা বিরোধী মহল এই ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। তারা কোটবিরোধীদের ওপর ভর করে তাদের এজেন্ডা, যেটা নাকি সরকার পতনের এজেন্ডা, এগিয়ে নিতে চেয়েছিলো। মানলাম। কিন্তু এই মহলকেতো বাংলাদেশের জনজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করা যাচ্ছে না, বা যাবে না, বা আইন করেও নিষিদ্ধ করার মতো বাস্তবতা সমাজে নেই। এবং বিভিন্ন সরকারি সংবেদনশীল পদে এদের অনেকে অধিষ্ঠিত বলে খবরের কাগজে প্রায় পড়ি।
ব্যাপারটা আসলে হচ্ছে যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবাহী এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবাহী নয় এই বিভাজনটা যুগেরই কারণে এবং একটি রাষ্ট্রীয় সমাজকে তার অগ্রগমনের পথে নানান বাধ্য-বাধ্যকতাপূর্ণ ইকুয়েশন এবং কাউন্টার-ইকুয়েশনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয় বিধায় বিভাজনরেখাটি ক্রমশই অস্পষ্ট থেকে অস্পষ্টতর হবে, কিংবা নতুন রূপ পাবে। তখন আদর্শের জায়গায় বিষয়চেতনাধারীরা এসে নানান সুবিধামতো জায়গা দখল করবে। কিছু সবজি যেমন আলু, ওলকচু ইত্যাদির গায়ে গজানো শিকড়গুলো লক্ষ করে দেখবেন, কোন শিকড়টা যে কোথায় গজিয়েছে, আর কোথায় শেষ হয়েছে বোঝার উপায় নেই। ঠিক তাই অর্ধশতাব্দীর বেশি সময়ের পরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ঐতিহ্যের অধিকারীদের নিয়ে দল ও ব্যক্তিতে সেই ধরনের অষ্পষ্টতা যে সমাজে তৈরি হয় নি তাই নয়। কিছুমাত্র লাগে না, বৈবাহিক সম্পর্কগুলো দেখেন।
এই ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সর্বোচ্চ বিচক্ষণতা প্রদর্শনের প্রয়োজন ও সুযোগ আছে। সেটি হলো, সহনশীল অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক পরিকাঠামো তৈরি করা। এই দায়িত্ব পালনের অঙ্গিকার না চাইলেও সরকারি দলের পক্ষ থেকে আসতে হবে। জেনারেল ওয়াকারুজ্জামান যেমন সময়োচিত যে কথাটি বলেছেন, সবাই মিলে কাজ করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
জনমতের একটি দিক হচ্ছে যে এবারের সংকট দমনের ক্ষেত্রে প্রশাসনের কয়েকটি দুর্বলতা ধরা পড়েছে। প্রথম দুর্বলতা হলো, এটি সংকটের শুরুতেই আলোচনার মাধ্যমে সুরাহা করা যেতো। সেখানে আদালতের উছিলা দিয়ে অযথা কালক্ষেপন হয়েছে, এবং এর ফলে প্রায় দেড়শ জন লোকের মৃত্যু হয়েছে, যার মধ্যে পুলিশের কর্মকর্তা ও সদস্যরাও রয়েছেন। দ্বিতীয় দুর্বলতা হয়েছে একটি দায়িত্বশীল মহল থেকে একটি সরকার-সমর্থিত ছাত্র সংগঠনকে সংকটের প্রাথমিক দিনগুলোতে আন্দোলনকারীদের দমন করতে যেতে বলা। এটা খুবই রাজনৈতিক অবিবেচনাপ্রসূত বুম্যেরাং সিদ্ধান্ত হয়েছে।
প্রসঙ্গক্রমে বলি, গত পরশু (২২ জুলাই) সিএনএন-এ সরাসরি দেখলাম ১৩ জুলাই সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প গুলীতে আহত হবার পর সেটা নিয়ে আমেরিকার কংগ্রেসের মেম্বার্স অব হাউজ ওভারসাইট কমিটি, অর্থাৎ যে কমিটির দায়িত্ব হলো রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনে কোন শীর্ষ পদধারী ব্যক্তির কোন গাফলতি হয়েছে কিনা সেটা জেরার মাধ্যমে যাচাই করা, তাঁরা বসেছেন। দেখলাম, আমেরিকার সিক্রেট সার্ভিসের চিফ কিম্বার্লি চিটেলকে ১৫জনের সদস্য কমিটিটি সর্বমহলের উপস্থিতিতে ছয় ঘন্টা ধরে জেরা (তাদের ভাষায় গ্রিল) করেছেন। বলছেন যে আপনি বেতন নেন জনজীবনের বিশিষ্টব্যক্তিবর্গের নিরাপত্তা বিধান করার জন্য, আপনার এই ব্যর্থতার পর আমেরিকার জনগণ কেন আপনার ওপর আস্থা রাখবে! এই জেরার পরপরই কিম্বার্লি সিটেল তাঁর দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেন।
এই ধরনের জেরার সংস্কৃতিতো আমাদের তৈরি হয় নি। হাতে বন্দুক, সামনে বুক পাতা একটি ছেলে, আমি গুলি করলাম, একজন মায়ের কোল খালি হয়ে গেল, এইটা কোন বিবেচনাকর কাজ হয়নি। বঙ্গবন্ধুর “আর যদি একটা গুলি চলে”র সতর্কবাণী যেন আমরা ভুলে না যাই। অথচ এত এত সম্পত্তি নষ্ট হলো, যে সকল গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা সমূলে ধ্বংস করা হয়েছে সে সময়ে এগুলির নিরাপত্তার দায়িত্বে কারা কোথায় ছিলো আমি জানি না।
আরেকটি ছোট্ট কথা আছে, বৃটিশরা ভারত শাসন করেছিলো হিন্দু-মুসলমান ভাগাভাগি বা ডিভাইড এ্যান্ড রুল পলিসি দিয়ে। ঠিক সেরকম বাংলাদেশকে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি আর বিপক্ষের শক্তিতে আলাদা আলাদা করে অবিরত যুদ্ধ্যমান অবস্থায় রেখে দেশটাকে ক্রমে দুর্বল করে ফেললে, দু’পক্ষেরই ক্ষতি, কিন্তু লাভটা কাদের সেটিও মাথায় রাখতে হবে। হু বেনিফিটস ফ্রম আ উইকার বাংলাদেশ? কাজেই সাধু সাবধান।

লেখক: সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ।