দেশপ্রেম

কে. এম. ওমর ফারুক

জামিল হোসেন একথালা পান্তাভাতে গোটা দুই মরিচ-পেঁয়াজ ডলে কয়েক লোকমা মুখে পুরে চিবুতে থাকেন। গোলপাতার ভাঙা ছাউনির ফুটো দিয়ে সূর্যের আলো সরলরেখায় এসে ছোট্টঘরের ভেতর এমনভাবে পড়েছে যেন ছাউনিতে কতোগুলো উন্নতমানের টর্চলাইট সাজানো হয়েছে। কিছুটা আলো তার গায়ে পড়ে যেন বিদ্রুপের হাসিতে ফেটে পড়ছে। জামিল হোসেন কিছুটা উদ্বিগ্ন ভাবনায় ডুবে আনমনা হয়ে পড়েন।

গরগর কইরা শীতকাল শ্যাষ অইয়া গ্যালো, সামনে বসন্তকাল। এরপরেই শুরু অইবো ঝড়বৃষ্টি! বসন্তের মধ্যে যদি ঘর সারাইবার না পারি তাইলে সব আমার গা দিয়া যাইবো। এ্যাতো কষ্ট কইরা খোঁড়াইয়া খোঁড়াইয়া মানুষের বাড়ি যাইয়া, হাডের দিন হাডে যাইয়া তসবি-টুপি বেইচা যা পাই তাতে আমার খাওনও অয় না! লাঠিতে ভর দিয়া বেশি সময় হাঁটতেও পারি না। বাম পাওডা যদি নষ্ট না অইতো তাইলে কী আইজ এই হাল অইতো! গায় খাইটা টাহা জমাইয়া ঘরডা সারতে পারতাম। মানুষের ধারে এই রহম ঠ্যালা-গুঁতা খাইয়া জীবন পার করোন লাগতো না।

এরই মধ্যে ডাকহরকরা এসে ঝুলি থেকে একটা হলুদখামের চিঠি বের করে ডাক দিলে জামিল সাহেব তাড়াতাড়ি হাত ধুয়ে চিঠিটা হাতে নেন। খামের ওপর চেয়ে দেখেন বন্ধু কামাল হোসেন শহর থেকে চিঠি পাঠিয়েছে। দেশ স্বাধীনের দুবছর পরে বন্ধু সপরিবারে গ্রাম ছেড়ে শহরে গেছে, আজ অবধি এমুখো হয়নি। শুধু ডাক চিঠিতে যোগাযোগ করে। জামিল হোসেন তাড়াতাড়ি খামটা খুলে দেখেন গোটা কয়েক হাজার টাকার নোট আর একটা চিঠি। চিঠিতে লেখা :

প্রিয় বন্ধু জামিল,

আসসালামু আলাইকুম। আমি জানি তোমার অবস্থা খুব খারাপ! আমি তোমাকে কতোবার বললাম আমার কাছে আসো, তবুও তুমি আসলে না। আগামী একুশে ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে বিশাল একটা অনুষ্ঠান করতে যাচ্ছি। উক্ত অনুষ্ঠানে অবশ্যই তোমার উপস্থিতি কামনা করছি। তাই তুমি দ্বিধা না করে আমার চিঠি হাতে পাওয়া মাত্রই এই ঠিকানায় রওয়ানা করবে, যাতে আগেভাগে পৌঁছাতে পারো। অবশ্যই তোমার উপস্থিতি চাই। আল্লাহ হাফেজ।

ইতি তোমার বন্ধু

কামাল হোসেন

বন্ধুর আমন্ত্রণ পেয়ে জামিল হোসেন হ্যাঁ-না করতে করতে সপ্তাখানেক পরে রওয়ানা হলেন শহরের দিকে।

এদিকে কামাল হোসেন পথের দিকে চেয়ে থাকে, কখন বন্ধু জামিল হোসেন আসে। অপেক্ষা করতে করতে অনুষ্ঠানের দিন চলে আসলো, কিন্তু বন্ধুর আসার কোনো খোঁজখবর নাই। আগে চিঠির উত্তর দিতো, কিন্তু এবার কোনো উত্তরও দিলো না। কামাল হোসেন চিন্তা করতে থাকে আল্লাহ না করুক বন্ধুর কোনো অঘটন ঘটলো না তো! আমার বন্ধু বেঁচে আছে তো! কী হলো বন্ধুর? তাহলে কী আর কোনোদিন ওকে দেখতে পাবো না? আর কোনোদিন ওর চিঠি পাবো না? এরকম ভাবতে ভাবতে কামাল হোসেনের মনটা মলিন হয়ে যায়।

আজ একুশে ফেব্রুয়ারি। সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেলো। পিঁপড়ের মতো দলে-দলে লোকজন এসে জড়ো হয়েছে। এমন সময় লাঠিতে ভর করে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে গেটের দিকে আসছেন এক পাওয়ালা এক বৃদ্ধ। মুখভর্তি সাদা দাড়ি, সাদা উসকোখুসকো চুলগুলো কিছুটা বাগে আনার জোর চেষ্টা করে চলেছে। জীর্ণশীর্ণ শরীরে মাংস ঝুলে পড়া গালে মোলায়েম প্রাপ্তির কিছুটা হাসি লাগানো। পরনে পুরোনো লুঙ্গি আর একটা শতচ্ছিন্ন সাদা পাঞ্জাবি। তবে বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। কাঁধে ঝোলানো একটা কাপড়ের পুটলি। গেটের দারোয়ান একবার তার স্বভাব আর পরিচ্ছন্নতা দেখে আরেকবার তার কাঁধের ঝুলি। উসকোখুসকো চুলদাড়ি আর ছেঁড়া পোশাক। বৃদ্ধ লোকটি গেটের সামনে আসতেই দারোয়ান আচমকা পথ আটকে বললো ভেতরে ঢোকা যাবে না। বৃদ্ধ লোকটি বললো :

‘এইডা কি কামাল হোসেনের বাড়ি?

হ্যাঁ, তাতে তোমার কী?

আমি তার লগে দ্যাহা করবার আইছি।

স্যার এখন অনেক বিজি আছেন, তুমি পরে আসো।

হে আমারে আইসতে কইছে।

দারোয়ান চিৎকার করে বললো, আরে যাও! কোত্থেকে কোন ভিক্ষুক আসছে স্যারের সাথে দেখা করবে! দূরে যাও, বলছি না স্যার এখন কারো সাথে দেখা করবে না?

দূর থেকে কামাল হোসেন দারোয়ান আর বৃদ্ধ লোকটির অবস্থা দেখতে পেয়ে দারোয়ানকে ডেকে বললো তাকে ভেতরে ঢুকতে দাও। এতো লোক আসছে আর একটা ভিক্ষুক আসলে সমস্যা কী!

এই বলে তিনি নিজ কাজে মনোযোগ দেন। দারোয়ান বৃদ্ধ লোকটিকে ঢুকতে দিলে সে গিয়ে অনুষ্ঠানের ভেতর ঢোকে। অনুষ্ঠানে উপস্থিত সকলেই তার পরিচ্ছন্নতায় কিছুটা অবাক হয়, আবার ছেঁড়া পোশাক, চুলদাড়ি আর কাপড়ের ঝুলি দেখে বিরক্তও হয়। ইতিমধ্যে কয়েকজনের শুরু হয় উত্যক্ত করা। একজন তাকে ইংরেজিতে বিভিন্ন প্রশ্ন করে। উত্তর না দিতে পারলে বলে, বাপের জনমে কোনোদিন ইংরেজিতে কথা বলেছো? একজন বলে, তোমাকে দাওয়াত করলো কে? বৃদ্ধ বললো; আম্নেগো যে দিছে হে আমারেও দিছে। বৃদ্ধের কথায় ওরা জোরে হেসে বলে গ্রামের খ্যাত কইত্তা আইছে! একজন পুটলি ধরে বলে এটাতে কী আনছো? পঙ্গু পা দেখে বলে, কোথায় কী কুকাম করতে গিয়ে পঙ্গু হয়েছো?

এভাবে আরও অনেক হেনস্তা করতে লাগলো। এসব শুনে বৃদ্ধ  অশ্রুসক্ত চোখে ওদের দিকে একপলক তাকিয়ে কারো কোনো প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে মঞ্চের সামনে চলে গেলো। মঞ্চে একজন ভাষণ দিচ্ছিল ইংরেজি এবং বাংলা মিশিয়ে। তার ভাষণ শুনে রাগে-ক্ষোভে নিজেকে সামলাতে না পেরে কাঁপতে কাঁপতে মেঘের গর্জনে চিৎকার দিয়ে বলে উঠলো, থামো, এইডা কী অইতাছে? দেশটা কী মগের মুল্লুক পাইছো তোমরা? তখন সবাই থ হয়ে তার দিকে চেয়ে রইলো। একজন দৌড়ে এসে তাকে ধরলো এখান থেকে বের করে দিতে। বৃদ্ধ ঝাড়ি দিয়ে বললো, আরে ছাড়ো! আমি কোনো ভিক্ষুক না, ভিক্ষা করবার লাইগা আমি আহিনাই। বলেই সে মাইকের মাউথের কাছে গিয়ে বললো, এইহানে আমি বিনা দাওয়াতে আহি নাই। আর ভিক্ষা করবার লাইগাও আহি নাই। আম্নেগো বিরক্ত করোনের লাইগা মাফ চাই। এইহানে আসোনের পর থাইকা আম্নেরা আমারে ম্যালা কিছু জিগাইছেন, আমি তার জবাব দেওনের লাইগা আম্নেগো একটু বিরক্ত করলাম। আম্নেরা আমারে ইংরেজিতে ম্যালা কিছু জিগাইছেন, আমি জবাব দিতে পারি নাই দেইখা কইছেন, বাপের জনমে কোনোদিন ইংরেজিতে কথা কইছো! আমারে কইছেন গ্রামের খ্যাত! গ্রামের খ্যাত অইলেও আমি আমার মায়ের ভাষায় কতা কই। জন্মের পর আমার মা আমারে এই ভাষাই শিখাইছে। এই ভাষায় আমি আমার মা’র গন্ধ পাই, এই ভাষায় আমি আমার মা’রে দ্যাখতে পারি। এই ভাষায় আমি দ্যাহি মায় আমারে ডাকতাছে, কইতাছে : বাবা জামিল, আয় বাবা এহন কয়ডা খাইয়া ল। খ্যালোনের ম্যালা সময় অইবো। আমি গ্রাইম্যা খ্যাত অইলেও  আম্নেগো মতোন আরাক দ্যাশের ভাষা হাওলাত কইরা কতা কই না। ১৯৫২ সালে আমার ভাইরা এই খ্যাত ভাষা রক্ষার লাইগাই শহীদ অইছিল। কিন্তু আম্নেরা! আম্নেরা আইজকার এই দিনেও বিদ্যাশের ভাষায় ভাষণ দিতাছেন! তাইলে পশ্চিমারা রাষ্ট্রভাষা উর্দু অবে বইলা কী দোষ করছিল? আম্নেগো কি শরম লাগে না? আম্নেরা আমারে জিগাইছেন, কী কুকাম হরোনের লাইগা আমার পাও কাইট্টা দিছে! হ আমি কুকামই হরছিলাম। যুদ্ধের কালে আমার মতোন গ্রাইম্যা খ্যাত আর ভিক্ষুকরা যদি পশ্চিমাগো লগে যুদ্ধ না হরতো তাইলে আইজ আম্নেগো মতোন ইংরেজগো দালাল জন্মাইতো না। আমি যদি করকাম না হরতাম তাইলে আমার মায়রে অরা পশুর মতো গুলি করতে পারতো না, আমার বাজানরে অরা অইরম রাইফেল দিয়া পিডাইয়া বেহুঁশ কইরা গুলির উপার গুলি কইরা মারতে পারতো না! অই শব্দগুলা আইজও আমার কানে বাজে! এহনও আমি ঘুমের মইধ্যে বাজান বাজান কইয়া কাইন্দা উঠি। অরা আমার বুবুজানরেও ছাড়ে নাই! হায়েনার মতোন খাবলে খাবলে খাইছে! হ্যাগো বাঁচাও বাঁচাও চিক্কার আইজও মনেঅয় আমি স্পষ্ট শোনতাছি। আমি যদি ওই কুকামডা না হরতাম তাইলে আমার এতো সুন্দার পরিবারডা হারাইতাম না। আমি হারাইতাম না আমার এতো সুখের জীবনডা। আমি যদি খালি যুদ্ধে না যাইতাম, পশ্চিমাগো বিরুদ্ধে দল না বানাইতাম তাইলে আইজ আমার এই হাল অইতো না। কিন্তু  না, আমার ধারে আমার জীবনেরতা দ্যাশ ম্যালা বড়ো, আমার পরিবারেরতা আমার দ্যাশ বড়ো, আমার ভাষা বড়ো। আমি আমার দ্যাশরে ভালোবাসি। আম্নেগো মতোন আমি মা’রতা খালারে বেশি দরদ দ্যাহাই না। আগে আমার দ্যাশ আপন তারপর বাইরের জগৎ।

সেখানে উপস্থিত সবাই বৃদ্ধের দিকে অপলক চেয়ে তার কথা শুনছিল আর তাদের গাল বেয়ে বেয়ে অশ্রু ঝরছিল।

তারপর সে পুটলি থেকে একটা হলুদখামের চিঠি বের করে বললো, আমি কোনোদিন এই শহরে আসবার চাইনাই। খালি এই চিঠির মালিকরে একবার দ্যাহোনের লাইগা আইছি। এই চিঠির মালিকের লগে বিশটা বচ্ছর কাডাইছি। এই চিঠির মালিক ছাড়া আমার আর আপন কেউ নাই।  আইজ পঞ্চাশ বছর ধইরা অরে দেহি না। আমার বন্ধুডারে একবার দ্যাহোনের লাইগা এইহানে আইছি। একথা বলতেই পেছন থেকে বন্ধু কামাল হোসেন দৌড়ে এসে ‘জামিলরে’ বলে বুকে জড়িয়ে ধরে কান্না জুড়ে দেয়। কেঁদে কেঁদে বলে, আর কইও না বন্ধু। আমি আর সইতে পারি না, ওই কথা আর মনে করাইও না বন্ধু।

কিছুক্ষণ পর একটু থেমে বলে, তোমারে এতোদিন পরে দেইক্ষা আমি চেনতে পারি নাই, তুমি অনেক বদলাই গ্যাছো, আমারে মাফ কইরা দ্যাও। মাফ কইরা দ্যাও বন্ধু। জামিল কান্নাচাপা কণ্ঠে বললেন, তুমিও অনেক বুড়া অইয়া গ্যাছো, অনেক বদলাই গ্যাছো, আমিও তোমারে চিনি নাই বন্ধু।

যারা জামিল হোসেনকে বিদ্রুপ করেছিল তারা সবাই নিজেকে আড়ালে নিয়ে মুখ লুকাতে লাগলো আর নিজেদের দোষ দিয়ে বলতে লাগলো, হায় এ কী করলাম আমরা! যাঁদের এত বড় ত্যাগের বিনিময়ে এই বাংলাদেশ আসলো আজ তাদেরই একজনকে আমরা উত্যক্ত করলাম! একজন মুক্তিযোদ্ধাকে অপমান করলাম! সত্যিই তো আমরা মায়ের চেয়ে খালাকে বেশি মায়া দেখাচ্ছি! সত্যিই তো আমরা বিদেশের দালালি করছি! আমরা এদেশের সবকিছু ভোগ করে দেশপ্রেমিক হতে পারিনি! আমরা বড়োই অপরাধী! আজকে আমরা একজন মুক্তিযোদ্ধাকে যতœ করতে পারিনি! আমাদের এ মুখ কোথায় লুকাবো! আজ মুক্তিযোদ্ধা ভিক্ষুকের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে আর আমরা রাজার মতো আরাম-আয়েশ করছি! তারপর তারা দৌড়ে এসে বীর মুক্তিযোদ্ধা জামিল হোসেনকে জড়িয়ে ধরে কান্নাজুড়ে দিলো! নিজেদের দোষ স্বীকার করে ক্ষমা চাইতে লাগলো আর বলতে লাগলো, এমনটা আর কখনো কারো সাথে করবো না, আর কখনো ইংরেজি নিয়ে বড়াই করবো না। আমরাও দেশকে ভালোবাসবো, দেশের যে কোনো প্রয়োজনে আমরা নিজেদের বিলিয়ে দেবো। তাদের কান্না এবং আকুতি-মিনতি দেখে জামিল হোসেনের মনও গলে যায় এবং ক্ষমা করে দেন।

জিতে যায় বীর মুক্তিযোদ্ধা জামিল হোসেনের দেশপ্রেম।