অরূপ পালিত
ভরাপূর্ণিমার জোয়ারে সমুদ্রের জলে আনচান করছে শাপলাপাতা মাছ। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মনে হয় সন্তান জন্ম দিতে এত কাছে আসা। আবার চলে যাবে সন্তানের মায়া ছেড়ে ভাটার টানে। নিয়তি এটাই। পৃথিবীতে শুধু মানুষেই একমাত্র সন্তানের মায়ায় আবদ্ধ হয়। জোছনার আলোর চকচকে আভায় মনে হয় চারদিক দিনের মতো স্বচ্ছ। ঢেউয়ের উন্মুক্ত নৃত্য আর উত্তপ্ত চুম্বন দেখতে মাঝরাতে ঘুম ভেঙে কেউ ভুল করে সমুদ্রের সামনে এসে দাঁড়ায়। সমুদ্রকন্যা নিজেই লজ্জা পেয়ে যাবে। সমুদ্রকন্যার উত্তাপ দেহে শরীর ভিজিয়ে চোখ বুজে একটুখানি দাঁড়ালে ঢেউয়ের আহত আওয়াজ শুনে আহাজারি করবে নিজের আহত হৃদয়।
জেলেপাড়ার সাহানার ছোট ছেলে নিলু। কেরোসিনের কুপি জ্বালিয়ে বসে আছে মা’র আশায়। মাকে অনেকদূর থেকে আসতে দেখে নিলু খুশিতে চিৎকার দিয়ে উঠলো।
: মা এসেছে, মা এসেছে।
মাও ছেলের দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে বললো, বাবা নিলু, তোকে আগুন না ধরতে মানা করেছিলাম না। বাতি ধরিয়েছিস কেন?
: ঘরের ভেতর অন্ধকার। একলা আমার ভয় করে মা।
তাড়াতাড়ি বাতিটি নিবিয়ে ফেল। তেলের অনেক দাম বাপ। ঘরের ভেতর পা ফেলেই সাহানা বাতিটি ফুঁ দিয়ে নিবিয়ে দেয়। ছেলেটার উদ্দেশ্য সাহানা বলে, ও বাপ, গরিবের আন্ধারের আলো হচ্ছে ওই চাঁদ। ওই নীলদরিয়ায় দিকে দেখ। পানির মধ্যে চাঁদের আলোখানি কীভাবে চিকচিক করছে। কী সুন্দর আলো তাই না, বাপ?
: জানি না। তুমি আগে আমারে খাবার দাও। খিদে পাইছে।
কেন নিলু! তোর বাপ দুপুরে আসে নাই?
: না।
হারামজাদা কোথায় খাই পড়ে রইলো আল্লাহই জানে। ছেলেটা আজ সারাদিন না খেয়ে থাকলো যে!
: ও মা, বাবা আসার আগে তুমি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। ঘুমিয়ে পড়লে তোমাকে আর বাবা মারবে না।
অবুঝ ছেলেটার কথা শুনে সাহানার চোখ ভিজে ওঠে।
আজকে মা-বাবা কেউ নেই বলে।
সাহানার মনে পড়ে সেই ভয়াল ঘুর্ণিঝড়ের কথা।
সাহানার বাবা সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে আর ফিরেনি। মহেশখালীর সোনাদিয়া চ্যানেল সংলগ্ন সাগরের পাশে ঝুপড়িতে বসবাস সাহানার মা-বাবার। যুবতী মেয়েটিকে বিয়ে করার জন্য সবাই একপায় খাড়া। সাহানার বাবা জসিমের এক কথা, মাইয়ারে বিয়ে দেবে যার বসতভিটা আছে, তারে। নিজেও এক ভাদাইম্যা। মেয়েকে অমন বিয়ে দিয়ে আর চোখের জল ফেলতে চাই না। হঠাৎ করে সাত নম্বর বিপদ সংকেত। সাগরের চারপাশ অন্ধকারে ঢেকে গেছে। রাতে জলোচ্ছ্বাস হবে শুনে ঝুপড়ির সবাই আশ্রয়কেন্দ্রে চলে যায়। সাহানা সারারাত বাপের জন্য কান্না করে। আল্লাহকে ডাকে। সকালে শোনা যায়, সাগরে অনেক ট্রলার ডুবে গেছে। হয়তো কেউ জীবিত নেই।
সাহানার বাবা ট্রলার নিয়ে সাগরের বুকে ডুবে যায়। কত মরদেহ সাগরের বুক থেকে কূলে ভেসে আসছে। শুধু সাহানার বাবার লাশ আসে নাই।
আশেপাশের স্থানীয়রা পুলিশকে জানায়। এক জেলেকে জীবিত অবস্থায় বাঁকখালীর নদীর মোহনা সংলগ্ন সাগর থেকে উদ্ধার করা হয়েছে, মাথায় প্রচ- আঘাত। সে স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। ঠিকানা বলতে পারছে না। হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। স্থানীয়রা ধারণা করছে, অনেক জেলে হয়তো জীবিত থাকতে পারে। উদ্ধারের জন্য থানা থেকে ট্রলার পাঠিয়েছে। গভীর সমুদ্রে স্থানীয় পুলিশ দুদিন অভিযান চালিয়েছে। পাঁচজনের লাশ উদ্ধার করেছে। অনেক লাশ বিকৃত হয়ে গেছে। সেখানে সাহানার বাবার লাশ আর উদ্ধার করা যায়নি।
একমাস পরে জেলেরা সবাই কুড়িয়ে পাওয়া ছেলেটাকে সাথে নিয়ে আবার সমুদ্রে যেতে থাকে। তাকে সবাই মফিজ ম-ল বলে ডাকে।
জেলেরা সবাই সাহানার মাকে বলে, ছেলেটি খুব ভালো। তারও কেউ নেই। তোমাদের একজন অভিভাবক হবে। ওকে মেয়ে বিয়ে দিলে তোমার মেয়ে সুখে থাকবে।
মুরব্বিদের সবার মতে বিয়ে হয়ে যায় সাহানার সাথে মফিজের। সাহানার মা-ও বছরের মধ্যে সাহানাকে ছেড়ে পরপারে চলে যায়। একা হয়ে যায় সাহানা। দিনে দিনে মফিজ যেন কেমন হয়ে যায়। বাজার থেকে মাঝরাতে ফিরে।
আগে কোন সময় মদ খেত না। এখন সে নিয়মিত মদ খায়। সংসারের প্রয়োজনে হাতখরচ চাইলে কখনও কখনও সাহানাকে নিতম্বরের মাঝ বরাবর সজোরে লাথি মারে। সন্তানের মুখের দিকে থাকিয়ে সাহানা সব সহ্য করে। আর লজ্জায় মুখে কাপড় গুঁজে সে অবারিত অশ্রু ঝরায়। সংসার সচল রাখতে সাহানাও এখন বড়সাহেবের বাসায় কাজ করে।
নিলু মাকে বলে, ও মা আজকে কি গরুর মাংস আনছ?
না রে বাপ। ইলিশমাছের ঝোল আর এক টুকরা লেজ দিয়েছে।
: মা আমার খিদে পায়ছে, আমি খেয়ে নি।
না রে বাপ। তুই ছোট মানুষ। হাতে খাইলে গলায় কাঁটা লাগবে। আমি কাঁটা খুলে খাইয়ে দিব।
: ও মা, তুমি সেদিন বলছিলে আমার বাবা ইলিশ মাছ ধরে বাজারে বিক্রি করে। কোনদিন তো একটা ইলিশ মাছ আনতে দেখি নাই। মালিকরে বলে আমাদের জন্য একটি মাছ আনতে বলো না।
বাবা রে ইলিশ মাছ হলো বড়লোকের মাছ। ওইগুলো খাওয়া তো দূরে থাক। দেখতে হলে বড় বড় বাজারে যাইতে হইবো। সেখানে চকচকে আলো জ্বালিয়ে ঠান্ডার মধ্যে এই মাছ সাজিয়ে রাখতে হয়। অনেক রাত হয়েছে। এখন আর কথা বলিস না। তোর বাপ আসার আগে চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে নে।
: ও মা ,তুমি সব সময় ঘুমানোর সময় মাথার নিচে দা রাখ কেন?
সাহানা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ছেলেকে তো বলতে পারছে না সবকিছু। কিছু একটা বলে ছেলেকে বুঝ দেয়। বাপরে বিষধর সাপ আছে আশেপাশে। যে কোন সময় ঘরে ঢুকে কামড় দিতে পারে। যদি আসে এক কোপে কেটে ফেলব।
আজকে কিছুক্ষণ আগেও টেবলেট জইল্যা সাহানাকে একা পেয়ে গায়ের জোরে জড়িয়ে ধরতে চেষ্টা করে। জইল্যা সাহানাকে বলে, তুই ভাদাইম্যার ঘর থেকে বেরিয়ে আমার ঘরে আয়। আমার কোন কিছুর অভাব নাই। রাজরানি করে রাখবো তোকে জীবনভর।
কোমর থেকে দা বাইর করে সাহানা জানান দেয়, বেশি আগাইস না কইলাম। মাথা থেকে ঘাড় আলাদা করে দিব।
জইল্যা গরম হয়ে সাহানাকে হুমকি দেয় : তুই ভাদাইমার ঘর ছেড়ে বেরিয়ে না আসলে তোকে আমি তুলে নিয়ে যাবো। দেখি আমায় কোন শালায় আটকায়।
সাহানা ছেলেকে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে ভাবে, গরমে ছেলেটা ঘেমে গেছে। এখন যে বাসায় কাজ করে, সে বাসায় পুরো ঘর ঠান্ডা আছে। ওই বাসার টমি কুকুরটা পর্যন্ত ঠান্ডা বাতাস ছাড়া ঘুমায় না।
গরমে ছেলেটা মা মা করছে। সাহানা ছেলেকে হাতপাখার বাতাস করছে। চোখ বুজে উঠতে মফিজের চিৎকার। দরজায় লাথি মেরে বলে, ওই হারামজাদি দরজা খোল।
সাহানা ভয়ে চমকে ওঠে। মফিজ অনেক রাত পর্যন্ত তাকে অত্যাচার করবে। কাল সকালের জন্য সাহানার ভারি চিন্তা হয়। কাল আবার ভোর ছয়টায় কাজে যেতে হবে। সাহেবের নাকি আবার কাল থেকে আটটায় অফিস।