হাফেজ মুহাম্মদ আনিসুজ্জমান »
আল্লাহ্ তাআলাই যতো প্রশংসা, স্তুতি ও গুণগানের প্রকৃত অধিকারী যিনি সত্য, পবিত্র ও চিরঞ্জীব। তাঁর পবিত্রতা ও কৃতজ্ঞতা, যিনি প্রতিযুগে তাঁর নির্ভুল দ্বীন’র নির্মল অবকাঠামো অবিকৃত রাখতে তাঁর হাবীবের উম্মতের শেষ যমানায় শতাব্দীর মুজাদ্দিদ সক্রিয় রাখেন।
আল্লাহ্ এক, অদ্বিতীয়। তিনি ছাড়া কোন উপাস্য নাই। তাঁর সমকক্ষ কেউ নাই, কিছু নাই। কোন কিছুর প্রতি তাঁর মুখাপেক্ষিতা নাই। বরং সকল সৃষ্টিই তাঁর মুখাপেক্ষী। আমাদের কর্ণধার, শাফাআতকারী হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম) আল্লাহ্র বান্দা ও তাঁর রাসূল। যাঁর পরে কোন নবী আসবেন না।
আমরা আখেরী বা সর্বশেষ নবীর উম্মত। আমাদের নবীর মাধ্যমে নবী আগমনের ধারা সমাপ্ত হয়। আল্লাহ্র ওপর ঈমান আনার স্বরূপ তাঁর কুদরতের সত্তাকে সিফাত বা তাঁর মৌলিক গুণাবলীসহ বিশ্বাস করা। যেভাবে আল্লাহ্র ‘তাওহীদ’ বা একত্বের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে হয়, ঈমানের মৌলিক ভিত্তির অপরিহার্য আরেকটি স্তম্ভের প্রতিও বিশ্বাস আনতে হয়, তা হলো রিসালত। তাওহীদ ও রিসালতÑউভয়টির ওপর নিঃসন্দেহে বিশ্বাস ছাড়া কেউ মুমিন দাবি করা বাতুলতা। রাসূলের সত্তার প্রতি যেমন ঈমান আনা একজন মুমিনের জন্য অপরিহার্য তেমনি তাঁর মৌলিক গুণাবলীর প্রতিও ঈমানÑবিশ্বাস অপরিহার্য। আমাদের নবী শুভাগমনের মাধ্যমে রিসালতের ধারার পরিসমাপ্তি ঘটে। তাঁর গুণাবলীর মধ্যে সর্বশেষ নবী হওয়াও স্বীকার্য। এটার অস্বীকৃতি কুফরী। পবিত্র কুরআনেই বর্ণিত, ‘মুহাম্মদ তোমাদের লোকদের মধ্যে কারো ‘পিতা’ পরিচয়ে অভিষিক্ত নন; হ্যাঁ, তাঁর পরিচয়, আল্লাহ্র রাসূল ও নবীকুলের সর্বশেষ। আর আল্লাহ্ প্রত্যেক বিষয়ে অবগত।’ (৩০:৪০) এ আয়াতে এ বিশ্বাস অকাট্যভাবেই ধারণ করতে বলা হয়েছে যে, তাঁর পরে আর কোন নবী আসবেন না, তিনিই সর্বশেষ নবী। তাঁকে নবী বলে বিশ্বাস করা যেমন প্রতিটি মুমিনের জন্য ফরয, তদ্রƒপ, শেষ নবী হিসাবে বিশ্বাসও অপরিহার্য।
আমাদের শেষ নবীর ওপর অবতীর্ণ আসমানী কিতাব পবিত্র কুরআন সর্বশেষ ঐশী কিতাব, তাঁর প্রদর্শিত শরীয়তও চূড়ান্ত বিধান। হযরত ঈসা (আ.) কিয়ামতের পূর্বে পুনরাবির্ভূত হলেও তিনি আমাদের নবীরই শরীয়ত তথা কুরআনÑসুন্নাহ মোতাবেক ফায়সালা দেবেন। নবীর ধারা বন্ধ হয়ে গেলেও শয়তানের প্ররোচনা ও প্রভাব ক্বিয়ামত পর্যন্ত থাকবে। আর শয়তানের কুমন্ত্রণায় বিপথগামী জ্ঞানÑপাপীরা কুরআন সুন্নাহর ভুল ব্যাখ্যা ও শরীয়তের আহ্কাম বিকৃতি করে মানুষকে শুধু বিভ্রান্তই করবে না, সাধারণ মানুষের সরলতার সুযোগে অনেক শঠ ও চতুর ভ- নবীও দাবি করবে। আল্লাহ্র দ্বীনকে আল্লাহই রক্ষা করবেন। তাই, উম্মতের ক্রান্তিকালে তাদের সহায়তাদানে আল্লাহ্ তাঁর অনুগ্রহপুষ্ট কোন বান্দাকে সহায়ক হিসাবে দাঁড় করাবেন, যাঁরা যুগে যুগে এ দ্বীনকে বিকৃতি, বিস্মৃতি থেকে রক্ষা করতে যুগসংস্কারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন।
দ্বীন’র সংস্কার মানে নতুন কাঠামো তৈরিও নয়, ধর্মের মৌলিক বিষয়ে পরিবর্তন সাধনও নয়। বরং এর মৌলিক অবকাঠামোতে যদি আগাছা বা পরগাছার মত অবাঞ্ছিত কোন বিষয়, এর উদ্দেশ্য পরিপন্থি অনাহূত কিছু এতে অপরিহার্য হয়ে অনুপ্রবেশ করে, তা দূরীভূত করে আগাছা সাফ করার মত এর মৌলিকত্ব পরিস্ফুটন করাও মুজাদ্দিদ বা সংস্কারকের কাজ। অনুরূপ দ্বীন’র বৈধ কোন পুণ্যকাজ বা সওয়াব’র আমল যদি কৌশলে বর্জন করার ক্ষেত্রে ব্যাপক অরাজকতা আনে, বা ‘মানÑয়ে আনিল খাইর’ (কল্যাণের কাজ প্রতিহত বা বিলোপ) সাধনে তৎপরতা বৃদ্ধি পায়, তার যথাযথ ও সময়োচিত পদক্ষেপে এগুলোর পুনঃ প্রতিষ্ঠার নামও তাজদীদ বা পুনঃ সংস্কার সাধন। মনে রাখতে হবে, সংস্কারক বা মুজাদ্দিদ কোন নতুন ধর্মের প্রবর্তক নন। তিনি আখেরি নবীরই উম্মত হয়ে তাঁরই দ্বীন’র পরিচর্যার যথোচিত ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন।
ইসলামী শরীয়ায় হালালকে হারাম বা হারামকে হালাল করা কারো নিজস্ব অধিকার ভুক্ত নয়। অবৈধকে বৈধ বলা যেমন অপরাধ, অনুরূপ বৈধ বিষয়কে অবৈধ বলে প্রচার করাও অপরাধ। এ ক্ষেত্রে ধর্মীয় সংস্কারক বা দ্বীন’র মুজাদ্দিদকে অবশ্যই গভীর ধর্মীয় জ্ঞানÑসম্পন্ন হওয়া জরুরি। আর অধিকাংশ ইলমে দ্বীনে প্রজ্ঞাবান, লব্ধÑপ্রতিষ্ঠ সমকালীন আলিমগণের নিকট তাঁর জ্ঞানগত ইমেজ নিদ্বির্ধায় গ্রহণযোগ্যও হওয়া চাই। এ লক্ষ্যেই ধর্মীয় জ্ঞানের চর্চা ও সঠিক গবেষণা অব্যাহত রাখাও জরুরি। এমন একটি শ্রেণি যদি সমাজে না থাকে, তবে যুগের সকলেই মহাপাপী সাব্যস্ত হবে। এজন্য ইলমে দ্বীন অর্জন ও চর্চার সাধনা অব্যাহত রাখা ফরদ্বে কিফায়া। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘অতএব, তাঁদের প্রতিটি জনগোষ্ঠীর একটি অংশ কেন বের হয় যাতে তারা দ্বীনি বিষয়ে গভীর উপলব্ধি অর্জন করে নিত। আর ফিরে এসে নিজের সম্প্রদায়কে সচেতন করতে সক্ষম হতো। যাতে তারা দ্বীনি বিষয়ে সতর্ক হতে পারত।’ (৯:১২০) দ্বীনি বিষয়ে তাজদীদ বা সংস্কারকর্মে দরকার দ্বীনের খুঁটিনাটি বিষয়েও সূক্ষাতিসূক্ষ জ্ঞান ও চুলচেরা বিশ্লেষণ ক্ষমতা। জাতির ক্রান্তিলগ্নে মুজাদ্দিদ মুমিন জনগোষ্ঠীর প্রতি করুণাময়ের মূর্ত করুণা হয়ে দেখা দেন। এ প্রসঙ্গে উম্মতের কা-ারী প্রিয়নবী ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ্ তাআলা প্রতি শতাব্দীর প্রারম্ভে এ উম্মতের জন্য এমন কাউকে প্রেরণ করেন, যিনি তাদের জন্য তাদের দ্বীনকে সংস্কার করেন’। ইমাম বায়হাকী ও হাকেম এ হাদীস নিজ নিজ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছেন। এর বর্ণনাকারী হযরত আবু হুরায়রা (রাদ্বি.)। জামে সগীর প্রণেতা একে সহীহ্’র অন্তর্ভুক্ত করেন।
এ মাসের শেষ দিকে ওফাতপ্রাপ্ত দু’জন কালজয়ী মহাপুরুষ’র কথা আমরা জানি, যাঁরা এ উপমহাদেশ’র কিংবদন্তি, মহান সংস্কারক। একজন ইমামে রাব্বানী মুজাদ্দিদে আলফেসানী শাইখ আহমদ সরহিন্দি (রাদ্বি.) মোগল স¤্রাট আকবর যখন দোর্দ- প্রতাপ খাটিয়ে আল্লাহর দ্বীন ইসলামের তাওহীদ তথা এক আল্লাহ্র ক্ষমতা ও সার্বভৌমত্বকে প্রকারান্তরে চ্যালেঞ্জই করে বসল, তখন ইমামে রাব্বানী (রাদ্বি.) প্রচ- রাজদ্রোহ নিয়ে মোগল স¤্রাটের মুখোমুখি হতে বাধ্য হলেন। এটা ছিল তাওহীদ বিষয়ক সংস্কার। জাগতিক দৃষ্টিকোণে রাজরোষের সামনে আকবর’র মত স¤্রাটের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো ছিল চূড়ান্ত ঝুঁকি। তিনি শুধু ঝুঁকি গ্রহণই করেননি; বরং এতে তিনি পূর্ণ সফলকাম হন। সফর’র ২৮ তাঁর ওরস মুবারক। তাঁর ‘তাজদীদ’ তাওহীদ সংক্রান্ত বিশ্বাসে। অপরজন হলেন ইসলামী দুনিয়ার কিংবদন্তী আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা ফাযেলে বেরেলভী (রহ.)। পূর্বে উল্লেখ হয়েছে, আক্বীদার মৌলিক দু’টি দিক রয়েছে। তাওহীদ ও রিসালত। আল্লাহর কুদরতের অবমাননা যেমন কুফর তেমনি রাসূলের মানহানিও নিঃসন্দেহে কুফর যদি তা হয় দ্বীনÑধর্মের ছদ্মাবরণে, তবে তা আরো ভয়ঙ্কর। ভারতবর্ষে এমনি কিছু জ্ঞানপাপী রাসূলের শানÑমানে অবমাননা করত সাধারণ মুসলমানকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে। তাই এ দ্বীন’র রূপরেখা শুদ্ধ রাখতে এ আ’লা হযরত’র কলমযুদ্ধ তরবারীর চেয়েও শাণিত হয়ে ওঠে। ইসলামের মৌলিক আকীদার সুরক্ষা ও শানে রিসালতের মর্যাদা সুমন্নত রাখতে তিনি আমরণ সংগ্রাম করেন, লিখে যান ঈমানÑআকীদার অতন্দ্র প্রহরীর মত অসংখ্য অমূল্য গ্রন্থাদি। সত্তরোর্ধ্ব বিষয়ে তিনি সহ¯্রাধিক প্রামাণ্য কিতাব প্রণয়ন করেন। এ মাসের ২৫ তারিখ তাঁর ওফাত হয়।
লেখক : আরবী প্রভাষক,
জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলীয়া মাদ্রাসা। খতিব : হযরত খাজা গরীব উল্লাহ শাহ (র.) মাজার জামে মসজিদ।