নিজস্ব প্রতিবেদক :
অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যা মামলার আসামি টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশকে দুদক-এর দায়ের করা জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন মামলায় গ্রেফতার দেখানোর আদেশ দিয়েছেন আদালত। গতকাল চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ শেখ আশফাকুল আলম শুনানি শেষে এ আদেশ দেন। এ সময় অভিযুক্ত প্রদীপ আদালতে উপস্থিত ছিলেন। এর আগে আদালতে হাজির করতে গত শনিবার বেলা ১টার দিকে কক্সবাজার কারাগার থেকে প্রদীপকে চট্টগ্রাম কারাগারে আনা হয়। সোমবার (গতকাল) দুপুর সাড়ে ১২টায় চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থায় তাকে আদালতে তোলা হয়। মাত্র ১০ মিনিটের মধ্যে শুনানি শেষে তাকে আবার কারাগারে পাঠানো হয়।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) পিপি মাহমুদুল হক জানান, ‘২৭ আগস্ট জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন মামলায় সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশকে সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে গ্রেফতার দেখানোর জন্য মহানগর দায়রা জজ শেখ আশফাকুল আলমের আদালতে আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদক সহকারী পরিচালক রিয়াজ উদ্দিন। সোমবার শুনানি শেষে আদালত দুদকের মামলায় প্রদীপকে গ্রেফতার দেখানোর আদেশ দেন। একই সময় প্রদীপের পক্ষে তার আইনজীবী জামিন আবেদন করেন। ওই আবেদনের ওপর শুনানির জন্য আগামী ২০ সেপ্টেম্বর দিন ধার্য করেছেন আদালত। এছাড়া প্রদীপের আইনজীবী কারাগারে চিকিৎসার জন্য পৃথক আবেদন করলে কারাবিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন আদালত। দুদক সুত্র জানায়, ওসি পদে থাকাকালে ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জন করা অবৈধ অর্থ সরকারের চোখে বৈধ করার দায়িত্ব ছিল তার স্ত্রী চুমকি কারনের ওপর। এক বছর অনুসন্ধান করে প্রদীপ ও চুমকির তিন কোটি ৯৫ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদের খোঁজ পায় দুদক তদন্ত কমিটি। ২০১৮ সালে দুদক তদন্ত কমিটি প্রদীপ ও তার স্ত্রী চুমকির বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়টি তদন্ত শুরু করে। ২০১৯ সালের ৯ এপ্রিল তাদের সম্পদের হিসাব জমা দিতে বলা হলেও চুমকি তা জমা দেন ২০১৯ সালের ১২ মে।
দুদক কর্তৃক দায়ের হওয়া মামলার বিবরণ অনুসারে চুমকি তাদের সম্প বিবরণীতে দেখিয়েছেন যে, তার বাবা তাকে ২০১৩ সালের ১ আগস্ট চট্টগ্রাম নগরের পাথরঘাটা এলাকায় একটি ছয়তলা বাড়ি দেন। কিন্তু দুদকের তদন্তে বেরিয়ে আসে চুমকির দুই ভাই থাকলেও তারা বাবার কাছ থেকে উল্লেখযোগ্য সম্পত্তি পাননি। এফআইআরে উল্লেখ করা হয়েছে, ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ দিয়ে ভবনটি তৈরি করেছেন। এবং তা গোপন করার জন্য এটি তার শ্বশুরের নামে করেন। তার শ্বশুর সেটি তার মেয়ে অর্থাৎ প্রদীপের স্ত্রীর নামে লিখে দেন।
সূত্র জানায়, চুমকি কারণ একজন গৃহিণী। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে তিনি প্রথমবার আয়কর রিটার্ন জমা দেন। তখন থেকে তিনি ব্যবসাকে তার পেশা হিসেবে উল্লেখ করছেন। তিনি দাবি করেন, তার মাছের ব্যবসা ছিল। ২০১৩-২০১৪ এবং ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে আয়কর রিটার্নে তিনি তার মূলধন দেখান ১১ লাখ ২০ হাজার টাকা এবং আয় দেখান তিন লাখ ৮০ হাজার টাকা।
চুমকির দাবিকৃত মাছের ব্যবসার হদিস পায়নি দুদক তদন্ত কমিটি। চুমকি তার ব্যবসার কোনো লাইসেন্স বা ব্যাংক স্টেটমেন্টও দেখাতে পারেননি। ২০০২ সালে মাছব্যবসা শুরু করার জন্য বিনিয়োগের ১৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা কোথায় পেলেন, সে সম্পর্কেও কোনো দলিল দেখাতে পারেননি।
দুদক বলছে, প্রদীপের অবৈধ অর্থ গোপন করার জন্য চুমকি ভুয়ামাছের ব্যবসা দেখিয়েছিলেন। যা থেকে তিনি দেড় কোটি টাকা আয় করেন। দুদক জানায়, চুমকির স্থাবর সম্পত্তি রয়েছে চার কোটি ২২ লাখ টাকার এবং পারিবারিক ব্যয় হয়েছে ২১ লাখ ৭০ হাজার টাকার। সেখানে তার বৈধ আয় মাত্র ৪৯ লাখ ১৩ হাজার টাকা। সে হিসাবে চুমকি জ্ঞাত বহির্ভূত আয় করেছেন তিন কোটি ৯৫ লাখ টাকা।
গত ২৩ আগস্ট প্রদীপ ও তার স্ত্রী চুমকি কারণের বিরুদ্ধে দুদক চট্টগ্রাম জেলা সমন্বিত কার্যালয়-২ সহকারী পরিচালক মো. রিয়াজ উদ্দিন বাদি হয়ে চট্টগ্রাম জেলা সমন্বিত কার্যালয়-১ এ মামলা করেন।
গত ৩১ জুলাই রাতে টেকনাফের শামলাপুর তল্লাশি চৌকিতে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সাবেক সেনা কর্মকর্তা সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান। তিনি মারিশবুনিয়ার একটি পাহাড়ে ভিডিও চিত্রধারণ করে মেরিন ড্রাইভ দিয়ে কক্সবাজারের হিমছড়ির নীলিমা রিসোর্টে আসছিলেন। এ ঘটনায় গত ৫ আগস্ট কক্সবাজার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হত্যা মামলা করেন সিনহার বড়বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস। এতে ৯ জনকে আসামি করা হয়। মামলার আসামি ৭ পুলিশ সদস্য আদালতে আত্মসমর্পণ করে। পরে তাদের বরখাস্ত করা হয়। সিনহা হত্যার পর পুলিশের করা মামলার তিন সাক্ষীকে গ্রেফতার করে মামলার তদন্ত সংস্থা র্যাব। এছাড়া হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে আরও তিন এপিবিএন সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। এ নিয়ে মোট ১৩ আসামি কারাগারে এখন। অপরদিকে একই ঘটনায় টেকনাফ থানায় দুইটি ও রামু থানায়ও পুলিশ মামলা করে। সাক্ষী অপহরণের অভিযোগে অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে টেকনাফ থানায় পরে আরেকটি মামলা হয়। এ ঘটনায় এ পর্যন্ত ৫টি মামলা হয়েছে। যার চারটি তদন্ত করছে র্যাব-১৫। সাবেক মেজর সিনহা হত্যামামলা দায়ের হবার পর প্রদীপকে টেকনাফ থানা থেকে প্রত্যাহার করা হয় গত ৫ আগস্ট। গত ৬ আগস্ট প্রদীপ কক্সবাজার আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। প্রদীপ কুমার দাশ (৪৮) বোয়ালখালী উপজেলার উত্তর সারোয়াতলী গ্রামের মৃত হরেন্দ্র লাল দাশের ছেলে।