সুপ্রভাত ডেস্ক »
অনুদান, সুদমুক্ত ঋণ, রেয়াতি ঋণ ও বাণিজ্যিক ঋণে আকারে চীন বাংলাদেশকে দুই বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ দিতে সম্মত হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিন দিনের চীন সফরের অভিজ্ঞতা তুলে ধরতে রোববার বিকালে গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে এসে এ তথ্য তুলে ধরেন সরকারপ্রধান।
তিনি বলেন, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে অনুদান, সুদমুক্ত ঋণ, রেয়াতি ঋণ ও বাণিজ্যিক– এই চার ধরনের আর্থিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি মিলেছে।
“এই চারটি প্যাকেজের আওতায় চীন বাংলাদেশকে দুই বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ প্রদানে সম্মত হয়েছে।”
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে শেখ হাসিনা বলেন, চীনের প্রিমিয়ার অব দ্য স্টেট কাউন্সিল লি চিয়াংয়ের আমন্ত্রণে তিনি ৮ থেকে ১০ জুলাই দ্বিপক্ষীয় সফরে চীন সফর করেন। ৮ জুলাই বেইজিংয়ে পৌঁছালে তাকে বিমানবন্দরে লাল গালিচা সংবর্ধনা দেওয়া হয়।
৯ জুলাই সকালে এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের (এআইআইবি) প্রেসিডেন্ট জিন লিকুন সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “আমি এআইআইবিকে বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়ন, নদী খনন, জলবায়ু পরিবর্তনসহ উপযোগী খাতে বিনিয়োগের আহ্বান জানাই।”
‘দ্য রাইজ অব বেঙ্গল টাইগার: সামিট অন ট্রেড, বিজনেস অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট অপরচুনিটিজ বিটুইন বাংলাদেশ অ্যান্ড চায়না’ শীর্ষক ব্যবসায়িক সম্মেলনে অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমার সফরসঙ্গী ব্যবসায়ী প্রতিনিধি এবং চীনের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ীরা এতে অংশগ্রহণ করেন।
“সম্মেলনে আমি চীনা ব্যবসায়ী সম্প্রদায়কে বিশ্বের সবচেয়ে উদার বিনিয়োগ ব্যবস্থার সুবিধা নিয়ে বাংলাদেশে বিনিয়োগের আমন্ত্রণ জানাই। অবকাঠামো, আইসিটি, পর্যটন, কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্প, নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ জ্বালানি খাত, জলবায়ু-সহনশীল স্মার্ট ফার্মিং, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, সবুজ প্রযুক্তি ও উন্নয়ন খাতে বৃহত্তর বিনিয়োগের আহ্বান জানাই।”
প্রধানমন্ত্রী জানান, তিনি বাংলাদেশে তিনটি বিশেষ পর্যটন অঞ্চল প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা ও সেখানে চীনের রিয়েল এস্টেট এবং হসপিটালিটি খাতে বিনিয়োগের সুযোগের কথা তুলে ধরলে চীনের ব্যবসায়ী নেতারা আগ্রহ দেখান।
“চীনে বাংলাদেশ দূতাবাস, বিআইডিএ, বিএসইসি এবং চায়না ওয়ার্ল্ড সামিট উইং আয়োজিত এ সম্মেলনে চীনের ভাইস মিনিস্টার অব কমার্স লি ফেই, চায়না কমিউনিকেশনস কনস্ট্রাকশন গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেডের চেয়ারম্যান ওয়াং টং ঝু, এইচএসবিসি চায়নার প্রেসিডেন্ট ও সিইও মার্ক ওয়াং, হুয়াওয়ের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট সাইমন লিন বক্তব্য দেন এবং তাদের আগ্রহের কথা তুলে ধরেন।’
বাংলাদেশের ১০টি কোম্পানির প্রতিনিধির সঙ্গে চীনের বিভিন্ন কোম্পানির ১৬টি সমঝোতা স্মারক ও চুক্তি সই হয় ওই সম্মেলনে।
শেখ হাসিনা বলেন, ৯ জুলাই বিকেলে তিনি চীনের পিপলস পলিটিক্যাল কনসাল্টেটিভ কনফারেন্সের (সিপিপিসিসি) জাতীয় কমিটির চেয়ারম্যান ওয়াং হুনিংয়ের সঙ্গে বৈঠক করেন। সে সময় তিনি আওয়ামী লীগ এবং চীনের কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে যোগাযোগ বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। দলীয় নেতাদের পারস্পরিক সফর বিনিময়ের ওপরও তারা একমত হন।
রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে চীনের সর্বাত্মক সহযোগিতা কামনা করার কথাও প্রধানমন্ত্রী বলেন।
তিনি জানান, সেদিন বিকালে তিনি তিয়েনআনমেন স্কয়ারে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। ১০ জুলাই সকালে বেইজিংয়ে গ্রেট হল অব দ্য পিপলে চীনের প্রিমিয়ার অব দ্য স্টেট কাউন্সিল লি ছিয়াংয়ের সঙ্গে তার দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হয়।
“প্রিমিয়ার লি ছিয়াংয়ের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের সময় বাংলাদেশ-চীনের ঐতিহাসিক সম্পর্ক, বাংলাদেশের বিভিন্ন অবকাঠামোগত প্রকল্প বাস্তবায়নে চীনের সহায়তা, বাংলাদেশের এলডিসি উত্তরণ-পরবর্তী সময়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সহযোগিতা, বাংলাদেশে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের সম্ভাবনা প্রভৃতি বিষয় আমরা আলোচনা করি।
“বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর জন্য বাংলাদেশের কৃষিপণ্য, চামড়া, ওষুধ প্রভৃতি পণ্য চীনে আরও বেশি পরিমাণে রপ্তানির অনুরোধ করি। বাংলাদেশ উৎপাদিত ৯৮ শতাংশ পণ্যের চীনে শুল্কমুক্ত প্রবেশের সুবিধা প্রদানের জন্য আমি তাকে ধন্যবাদ জানাই।”
শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য প্রণীত সাদার্ন ইন্টিগ্রেটেড ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ (এসআইডিআই) বাস্তবায়নে তিনি চীনের অবকাঠামোগত ও আর্থিক সহায়তা কামনা করলে প্রধানমন্ত্রী লি ছিয়াং ইতিবাচক সাড়া দেন।
“২০২৬ সালে বাংলাদেশের এলডিসি উত্তরণের পর সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় চীনের সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে বলে আমি আশাবাদ ব্যক্ত করি এবং এই বিষয়টিতেও চীনের সমর্থন লাভ করি।”
ওই বৈঠকের পর বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে বিভিন্ন খাতে মোট ২১টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। এছাড়া সাতটি দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার ঘোষণা করা হয়। যার মধ্যে বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির সম্ভাব্যতা যাচাই অন্যতম।
১০ জুলাই বিকেলে বেইজিংয়ে গ্রেট হল অব দ্য পিপলে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সে কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “২০১৬ সালে চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিনপিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় দুই দেশের সম্পর্ক কৌশলগত অংশীদারিত্ব পর্যায়ে উন্নীত হয়, যা দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে নতুন পর্যায়ে উন্নীত করে।”
পদ্মা সেতু, বঙ্গবন্ধু টানেলসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন বৃহদাকার অবকাঠামো বিনির্মাণে চীনা সহায়তার দেশটির প্রেসিডেন্টকে ধন্যবাদ জানানোর কথাও সংবাদ সম্মেলনে বলেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, “চট্টগ্রামের আনোয়ারায় ৮০০ একর জমিতে শিল্প বিনিয়োগ করার জন্য প্রেসিডেন্ট শি চিনপিংয়ের মাধ্যমে আমি চীনা উদ্যোক্তাদের আহ্বান জানাই। এর পাশাপাশি বাংলাদেশের ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল ও আইসিটির বিশেষায়িত অঞ্চলে চীনকে বিনিয়োগের অনুরোধ করি।
“বাংলাদেশের প্রতি চীনের অব্যাহত সমর্থনের কথা উল্লেখ করে চীনের রাষ্ট্রপতি এখানে অধিকতর বিনিয়োগের বিষয়ে আশ্বাস প্রদান করেন।”
শেখ হাসিনা বলেন, “বাংলাদেশে আশ্রিত জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিক-রোহিঙ্গাদের অবস্থা এবং তাদের সমস্যার প্রেক্ষাপট উল্লেখ করে এর সমাধানে আমি চীনের সহযোগিতা কামনা করি। রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা প্রদানের জন্য বাংলাদেশকে ধন্যবাদ জানিয়ে চীনের রাষ্ট্রপতি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সহযোগিতার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশ ও চীনের পারস্পরিক সমর্থন অব্যাহত থাকবে বলে উভয়পক্ষ আশাবাদ ব্যক্ত করি।
“আমাদের এ ফলপ্রসূ আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যেকার সম্পর্ক ‘সমন্বিত কৌশলগত সহযোগিতামূলক অংশীদারত্ব’ পর্যায়ে উন্নীত হয়।”
আগামী বছর বাংলাদেশ ও চীনের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্ণ হতে যাচ্ছে– সে কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পররাষ্ট্রনীতি ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়’, এটিকে মূলনীতি হিসেবে ধরে দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সফলভাবে তার কূটনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে চলছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা, ফিলিস্তিন সঙ্কট, মানবাধিকার, টেকসই উন্নয়ন, জাতিসংঘ প্রভৃতি ক্ষেত্রে বৈশ্বিক বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ ও চীন পারস্পরিক সহায়তার মাধ্যমে উন্নয়নের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
“শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রই নয়, ঐতিহ্যগত দিক থেকেও এশীয় দেশ হিসেবে আমাদের মধ্যে দীর্ঘ সময়ের সংযোগ রয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা এবং আধুনিক স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে গবেষণা, শিক্ষা, আইসিটি, প্রযুক্তি, সংস্কৃতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে যোগাযোগ ও সহযোগিতা বাংলাদেশ ও চীনের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে বলে আমি মনে করি।”
শেখ হাসিনা বলেন, “আমার এই সফর বাংলাদেশের কূটনৈতিক কর্মকাণ্ড একটি উল্লেখযোগ্য অংশ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।”