মাছুম আহমেদ »
চরম শত্রুর সঙ্গে পরম সন্ধি! ধর্ষণের শিকার নারীকে ধর্ষকের সাথে বিয়ে দিয়ে জেলগেটের বাইরে কোলাকুলি করেছেন উভয় পক্ষের আত্মীয়-স্বজন! অতি সম্প্রতি এমন খবর প্রকাশিত হয়েছে গণমাধ্যমে। সবাই এতে খুশি। পরিবার খুশি, আদালত খুশি এমনকি রাষ্ট্রও।
অথচ ধর্ষকের ফাঁসির দাবিতে রাজপথে নেমেছে এদেশের মানুষ। জনমতের প্রতিফলন হিসেবে সরকারও আইন সংশোধন করে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড নির্ধারণ করেছেন।
সমাজে ধর্ষণ নির্মূলের উদ্দেশ্যে অপরাধীর শাস্তির মাত্রা বাড়িয়ে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান করা হলো। সেক্ষেত্রে অপরাধীর সঙ্গে ভিকটিমের বিয়ের ব্যবস্থায় অপরাধের লাগাম টানতে কোনো ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে কি-না সেটি অবশ্যই বিবেচনার বিষয়। তাছাড়া নির্যাতনের শিকার নারীর সঙ্গে একজন চরম অপরাধীর বিয়েতে জনমতে প্রত্যাশাই বা কতটা পূরণ হলো, সেটিও গুরুত্বপূর্ণ।
‘বিয়ের বিনিময়ে ধর্ষকের মুক্তি’- বিষয়টির ওপর গভীর দৃষ্টিপাতে বিয়েকে অপরাধীর সাজা হিসেবে বিবেচনা করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। ‘হয় ভিকটিমকে বিয়ে করো, নয় কারাগারে জীবন দাও’- এমন একটি পর্যবেক্ষণ হিসেবে বিষয়টি অনুধাবনের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। জীবন বাঁচাতে কিংবা জেলজীবন থেকে মুক্তির বাসনায় ধর্ষক বিয়েতে সম্মতি জানাবে এটিই স্বাভাবিক। তবে অস্বাভাবিক হবে যদি সমাজ সেই বিয়ের খবরে তৃপ্তির ঢেকুর তোলে!
বিয়ের শর্তে ধর্ষকের মুক্তিকে সমাজ যদি বাহবা দেয় তাহলে অপরাধীর জন্য সেটি প্রত্যাশিত পুরস্কার হিসেবেও দেখা যেতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, পছন্দের কোনো নারীকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে প্রত্যাখ্যাত কোনো পুরুষের ইচ্ছেকে বাস্তব করতে ‘ধর্ষণ’ একটি অস্ত্র হিসেবে তাকে প্রণোদনা যোগাতে পারে। যদি তাই হয় তাহলে সমাজে ধর্ষণের বিস্তারণ ঘটবে সন্দেহ নেই।
এটি ঠিক সব ধর্ষণের ক্ষেত্রে তো আর ‘বিয়েদণ্ড’ হচ্ছে না। ভিকটিম যদি বিবাহিতা হয়ে থাকেন তাহলে তাঁকে তো আর ধর্ষকের সাথে বিয়ে দেওয়ার প্রশ্ন উঠছে না। কিংবা নারী যদি সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন তাহলে ধর্ষকদের কার সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হবে- এমন পরিস্থিতিতে ‘বিয়েদণ্ড’ এর অবকাশ থাকছে না। যদিও এমন ঘটনায় ধর্ষকদের কেউ যদি নির্যাতিতাকে বিয়েতে সম্মতি জানায়, কে-না জানে সমাজ হয়ত সেই পুরুষকে মহানুভব হিসেবেও আখ্যা দিতে পারে! তবে এমন ‘মহানুভতা’র দৃষ্টান্ত সিনেমা-নাটকে ব্যতীত বাস্তব জীবনে দুষ্প্রাপ্য। উল্লেখ্য, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচারিত তুরস্কের একটি ধারাবাহিক ‘ফাতমাগুল’ নাটকে সংঘবদ্ধ ধর্ষকদের একজন ভিকটিমকে বিয়ে করেন। বোধ করি, দর্শকরা ওই ধর্ষককে নাটকের ‘নায়ক’ হিসেবেই নিজেদের মনে স্থান দিয়েছেন।
সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় ‘বিয়েদণ্ড’ ঘটার অবকাশ কম বলে হয়ত অপরাধীরা প্রকৃত সাজা মৃত্যুদণ্ড এড়াতে ভিকটিমকে বাঁচিয়ে না রাখার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠতে পারে। একই কথা প্রযোজ্য শিশু ভিকটিমের ক্ষেত্রেও। বিবাহিত নারীর ক্ষেত্রেও ধর্ষক একই ধরনের নিষ্ঠুর পথ বেছে নিতেও পারে। তাহলে বাকি থাকল অবিবাহিত নারী। তাঁদেরকে নির্যাতন করে বাঁচিয়ে রাখায় অপরাধীর জীবনের ঝুঁকি অপেক্ষাকৃত কম, কারণ ধর্ষককে মুক্তির বিকল্প পথ হিসেবে তখন ‘বিয়েদণ্ড’ হাতছানি দেয়।
বাংলাদেশে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবনের স্থলে আইন সংশোধন করে মৃত্যুদণ্ড করার পরও এই অপরাধ কমেনি বরং বেড়েছে। চলতি বছরের ১৩ অক্টোবর সংশোধিত আইনটি কার্যকর হওয়ার পর ১৪ অক্টোবর থেকে ২৩ নভেম্বর পর্যন্ত ৪০ দিনে মোট ১৯১টি ধর্ষণের ঘটনা শনাক্ত হয়েছে (দৈনিক কালের কণ্ঠ)। অথচ মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) এর তথ্যমতে সেপ্টেম্বরে এ সংখ্যা ছিলো ৮৬। অন্যদিকে ঢাকা মহানগর পুলিশের তথ্য অনুযায়ী কেবল ঢাকায় অক্টোবর মাসেই ৮৫টি ধর্ষণের ঘটনায় মামলা দায়ের হয়; সেপ্টেম্বর মাসে এ সংখ্যা ছিলো ৬০। পরিসংখ্যান পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয় শাস্তিকে থোরাই কেয়ার করে অপরাধীরা।
এমনটি ধারণা করাও অমূলক নয়, ধর্ষণকাণ্ডের ‘বিয়েদণ্ড’ হয়ত অপরাধের প্রণোদনা হিসেবে কাজ করেছে বলে ধর্ষণ বেড়ে গেছে। উল্লেখ্য, ধর্ষণের ক্ষেত্রে বিয়েদ-ের কয়েকটি ঘটনা সাম্প্রতিক সময়ে গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচারিত হয়েছে। এমন অবস্থায় ধর্ষণের শাস্তি হিসেবে ‘বিয়েদণ্ড’ প্রদানের ক্ষেত্রে ধর্ষকদের আরো আগ্রাসী হয়ে ওঠার আশংকাও রয়েছে।
আদালত যখন ধর্ষকের বিয়েদণ্ডকে বিবেচনায় নেন, নিশ্চয়ই একটি গভীর দৃষ্টিভঙ্গিই সেখানে অন্তর্ভুক্ত হয়। বাদি-বিবাদি যখন বিবাদ মেটাতে আবেদন করেন, আদালত হয়ত সেখানে একটি ইতিবাচক মনোভাব প্রযুক্ত করেন। কিন্তু আইনি বিধান কি সেই মনোভাবকে সমর্থন যোগায়, সাধারণ মনে এমন প্রশ্ন উঠতে পারে। সিনেমাতে প্রদর্শিত একটি মামলার রায় এখানে উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে। পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে এক দম্পতির সেপারশেন হচ্ছে আদালতে। তাদের তিন বছর বয়সী একটি কন্যাসন্তান রয়েছে। সন্তানটি কার সঙ্গে যাবে, সেটি নিয়ে আদালতে শুনানি হচ্ছে। বাবা চায় মেয়ে তার সঙ্গে থাকুক। মা নিজেও চায় সন্তান ওর বাবার কাছেই থাকুক। আত্মীয় স্বজনদের সবারই একই প্রত্যাশা। এমনকি মেয়ে নিজেও চায় বাবার সঙ্গে যেতে। কিন্তু সমস্যা হলো সবাই যেটা চায়, আইন সেটি চায় না। আইনি মতে বয়স কম হওয়ায় মেয়েটি তার মায়ের সঙ্গেই থাকা সমীচীন। এ পরিস্থিতিতে আদালত তাহলে কী রায় দেবেন। আদলত কি আইনকে সমুন্নত রাখেবন, না-কি জনপ্রত্যাশা পূরণ করবেন। পরিস্থিতি বিবেচনায় সবার কল্যাণের স্বার্থে আদালত মেয়েটিকে বাবার সঙ্গে যাওয়ারই অনুমতি দিলেন। উপযোগবাদী নীতি অর্থাৎ অধিক মানুষের জন্য অধিক সুখ উৎপাদন নীতি অবলম্বন করে আদালতের এ সিদ্ধান্তে সবাই খুশি বটে, তবে আইন সেখানে নির্ধারিত পথে চলতে পারল না।
একইভাবে ধর্ষণের ক্ষেত্রেও হয়ত বাদি-বিবাদি পক্ষ নিজেদের মধ্যে বিবাদ মেটানোর আর্জিতে আদালতকে উপযোগবাদী নীতিতে অবতীর্ণ করতে পারেন। ধর্ষককে ‘বিয়েদণ্ড’ দেওয়ার মাধ্যমে সেই নীতির প্রতিফলন ঘটে থাকতে পারে। সাম্প্রতিক একটি মামলাকে উদাহরণ হিসেবে এক্ষেত্রে বিবেচনা করা যায়। প্রবাসীর স্ত্রী পরকিয়ায় জড়িয়ে পড়েন। ‘বিয়ের প্রলোভনে’ প্রেমিকের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কও স্থাপন করেন। ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর ওই নারীর স্বামী তাকে তালাক দিলে তিনি প্রেমিককে বিয়ের জন্য চাপ দেন। কিন্তু প্রেমিক ওই নারীকে গ্রহণ করতে অস্বীকার করলে নারী দ¦ারস্থ হন আদালতের। মামলা ঠুকে দেন ধর্ষণের। সেই অভিযোগে প্রেমিককে গ্রেফতার করে আদালতে সোপর্দ করা হয়। পরবর্তীতে মামলা তুলে নেওয়ার প্রতিশ্রুতিতে আটক ব্যক্তি বিয়ে করতে রাজি হলে আদালত তাতে সম্মতি দেন এবং জামিনে মুক্ত হন ‘ধর্ষক’। এতে আদালতের সদিচ্ছার ঘাটতি নাও থাকতে পারে বটে, তবে এমন সিদ্ধান্তের ধারাবাহিকতায় সংশ্লিষ্ট অপরাধ প্রণোদিত হওয়ার অবকাশ রয়েছে।
তাছাড়া আদালত হয়ত আপাতভাবে বাদি-বিবাদি পক্ষের মধ্যে সুখ প্রতিষ্ঠা করল কিন্তু সেই সুখ কতটা টেকসই হবে সেটির নিশ্চয়তা কতটুকু। একথাও সত্য একটি স্বাভাবিক বিয়ের ক্ষেত্রেও টেকসই সুখের নিশ্চয়তা নেই। তবে, আদালতের মাধ্যমে বিয়েকে একটি দণ্ড হিসেবে বিবেচনা করা হলে সেই বিয়ের মধ্যে একটি বাধ্যবাধকতা বোধ তথা পরোক্ষ অসম্মতির একটি অনুভূতি সক্রিয় থাকতে পারে। তাতে বিয়েদণ্ডের আপাত সুখ সহজেই মুখ থুবড়ে পড়তে পারে।
তাছাড়া ধর্ষণকাণ্ড কেবল জৈবিক চাহিদা মেটানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। প্রতিশোধ পরায়ণতা, সামাজিকভাবে হেনস্তা করা, সহিংসতার মাধ্যমে নিজেকে হিং¯্র প্রতিপন্ন করে ভীতি সঞ্চারের মাধ্যমে স্বার্থসিদ্ধি করা, নারীকে বশে থাকতে বাধ্য করা তথা আধিপত্য ও কর্তৃত্ব স্থাপনের উদ্দেশ্যেও ধর্ষণ ঘটে। সুতরাং, এসব উপাদানের একটিও যদি কোনো ব্যক্তিকে ধর্ষণের মতো অপরাধে প্রযুক্ত করে তাহলে ‘বিয়েদণ্ড’ সেখানে সুখ নির্মাণ করবে এমন প্রত্যাশা বাস্তবসম্মত নাও হতে পারে। হয়ত অপরাধের এই সমস্ত মোটিভের ক্ষেত্রে আদালত ‘বিয়েদণ্ড’ কে বিবেচনা করবেন না। তবুও ধর্ষণের যে কোনো মামলায় আদালতের ‘বিয়েদণ্ড’ এর একটি নজিরও অপরাধীকে পরোক্ষ পুরস্কার প্রদান করতে পারে। অপরাধী সেই নজিরকে ভিত্তি হিসেবে দাঁড় করিয়ে মামলাকে নিজের মতো করে সাজানোর সুযোগে তৎপর হতে পারেন।
অন্যদিকে ‘বিয়েদণ্ড’ বিষয়টিকে ধর্ষণের ক্ষতিপূরণ হিসেবেও প্রতিপন্ন করা যেতে পারে। ধর্ষণে যেই ক্ষতি হয় ধর্ষক ভিকটিমকে বিয়ে করলে সেই ক্ষতি মিটে যায় এমন একটি প্রত্যক্ষণ বিয়েদণ্ডের মাধ্যমে দানা বাঁধতে পারে।
আরো গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো ধর্ষণকাণ্ডে আসলে কার ক্ষতি হয় এবং কী ক্ষতি হয়? ধর্ষণের শিকার ব্যক্তির শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি অফুরন্ত। তথাপিও গবেষণা বলে ধর্ষণকাণ্ডে সবচেয়ে বড় ক্ষতিটি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিজনিত। সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির যাঁতাকলে পিষ্ট হয় ভিকটিম ও তাঁর পরিবার। ভিকটিমকে সেখানে পণ্য হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। একটি খাদ্যপণ্যের গুণাগুণ নষ্ট হলে যেমন পণ্যটির ক্ষতিজনিত কারণে দাম নেমে যায়, তেমনি ভিকটিমের ধর্ষণজনিত ক্ষতির কারণে সমাজে মর্যাদা মারাত্মকভাবে নেতিবাচক দৃষ্টির কবলে পড়ে। অধিকন্তু পুরুষশাসিত সমাজে ধর্ষণের শিকার নারীর চেয়ে ক্ষতি বেশি বিবেচনা করা হয় তাঁর পিতা, স্বামী তথা পরিবারের। পরিবার সেই ক্ষতি পোষাতে ভিকটিমকে ধর্ষকের সাথে বিয়েতে সম্মতি জানায়। সেখানে ভিকটিমের সম্মতি আদৌ আছে কি-না সেটি হয়ত হয়ে পড়ে গৌণ। ভিকটিমকে পণ্য হিসেবে বিবেচনা করে ক্ষতিপূরণের উপায় হিসেবে ‘বিয়েদণ্ড’ নারীকে অপদস্থ আর অসম্মানের এক চরম হাতিয়ার হিসেবে গণ্য হতে পারে। আর এমন বিয়েদণ্ডে আদালতের ‘সদিচ্ছাপ্রসূত’ সায়ের ন্যায্যতা যেমন প্রশ্নাতীত নয়, একই কারণে আদালতের এমন অবস্থান অপরাধ উৎপাটনের পথে কতটা হাঁটে, এমন প্রশ্নও জনমনে উত্থাপিত হয়।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।