রাজিব শর্মা »
বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র ও পুণ্ডরীক ধামের অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর জামিন আবেদন না-মঞ্জুরের পর গতকাল নগরীর আদালত প্রাঙ্গণ এবং কোতোয়ালী মোড় ও আশেপাশের এলাকায় বিক্ষোভের ঘটনায় এক আইনজীবী নিহত ও চার আলোকচিত্র সাংবাদিকের গাড়ি ভাঙচুরের খবর পাওয়া গেছে।
রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় গ্রেফতার বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র ও পু-রীক ধামের অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর জামিন আবেদন না’মঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন আদালত।
গতকাল দুপুরে চট্টগ্রাম ৬ষ্ঠ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক কাজী শরীফুল ইসলাম শুনানি শেষে এ আদেশ দেন।
আসামিপক্ষের আইনজীবী স্বরূপ কান্তি নাথ বলেন, ‘আমার মক্কেলকে নির্দোষ দাবি করে জামিনের আবেদন করা হয়েছে। কিন্তু আদালত জামিন নামঞ্জুর করে তাকে হাজতে প্রেরণ করেন। এই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে।’
সিএমপির অতিরিক্ত উপকমিশনার (প্রসিকিউশন) মফিজুর রহমান বলেন, নিউ মার্কেটে পতাকাকে ঘিরে দায়েরকৃত মামলায় জামিনের আবেদন করা হলে আদালত তা নামঞ্জুর করেন। আসামিপক্ষের আইনজীবীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত ডিভিশনের আদেশ দেন। একই সঙ্গে চিকিৎসা ও ধর্মীয় রীতিনীতি পালনে যাতে কোনো অসুবিধা না হয়, কারাবিধি অনুযায়ী সে ব্যবস্থা নিতে জেল সুপারকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সোমবার বিকেলে ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে চিন্ময় কৃষ্ণকে আটক করেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) এর গোয়েন্দা বিভাগ। এরপর সেদিন মধ্যরাতে তাকে চট্টগ্রামে আনা হয়।
এদিকে, বাংলাদেশ সনাতন জাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে গ্রেফতারের পর আদালত না মঞ্জুর করে হাজতে প্রেরণের নির্দেশ দেয়ার পর পরই ত্রিমুখী সংঘর্ষে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় চট্টগ্রাম আদালতসহ কোতোয়ালির বিভিন্ন এলাকা।
গতকাল দুপুর ১২টার পর থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত চট্টগ্রাম আদালত প্রাঙ্গণে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন সনাতনীরা। তাদের দাবি পুলিশ-আইনশৃঙ্খলাবাহিনীসহ স্থানীয়রা তাদের উপর হামলা করেন। অন্যদিকে আদালতের বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত আইনজীবীরা দাবি করেন ‘ইসকনের’ সদস্যরা তাদের অর্ধ শতাধিক গাড়িতে ভাঙচুরসহ হামলা করেন।
হামলা ও ভাঙচুরের বিষয়ে অতিরিক্ত পাবলিক পসিকিউটর সরোয়ার হোসেন লাভলু বলেন, ‘ইসকন ও দুষ্কৃতকারীরা আমার গাড়িতে হামলা করেছে। আমি একজন অতিরিক্ত পাবলিক পসিকিউটর। আমি জাতির জন্য কাজ করছি। আমি জাতির কাছে আমার গাড়ি ভাঙচুরের বিচার চাই। ইসকনদের বিচার চাই।’
অন্যদিকে বিকাল ৪ টার দিকে ইসকনকে নিষিদ্ধসহ নানা মন্তব্য করে আদালতের প্রধান ফটকের বিপরীতে পাথরঘাটা সেবক কলোনি রোডে রঙ্গম কনভেনশন এলাকায় বিক্ষোভ করেন আইনজীবী ও স্থানীয়দের একটি অংশ।
সংঘর্ষে আইনজীবী নিহত, আহত অর্ধ শতাধিক
এদিকে আদালতে সংঘর্ষের ঘটনায় সাইফুল ইসলাম আলিফ নামে একজন আইনজীবী নিহত হয়েছেন। চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা আলিফকে মৃত ঘোষণা করেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেন চমেকের জরুরি বিভাগ।
দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনায় আহত বর্তমানে নগরীর বিভিন্ন স্থানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রয়েছে।
চমেকে ভর্তিকৃত আহতরা হলেন শ্রীবাস দাশ, শারকু দাশ, ছোটন, সুজিত ঘোষ, উৎপল ও এনামুল হক। এছাড়া লালদিঘীতে সংঘর্ষের ঘটনায় আহত হয়ে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৯ জন। তবে এই ১৯ জনের সকলেই আশঙ্কামুক্ত বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের চিকিৎসক।
চার সাংবাদিকের গাড়ি ভাঙচুর
আদালত এলাকায় পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে যাওয়া চার সাংবাদিকের মোটর সাইকেল ভাংচুরের অভিযোগ পাওয়া গেছে। চিন্ময় কৃষ্ণ ব্রহ্মচারীর জামিন না’মঞ্জুরকে ঘিরে সৃষ্ট অপ্রীতিকর ঘটনা চলাকালে চার ফটো সাংবাদিক আমাদের সময়ের আবু সাঈদ মোহাম্মদ তামান্না, দেশ রূপান্তরের আকমাল হোসেন, বিডিনিউজের সুমন বাবু ও সারা বাংলার শ্যামল নন্দীর পার্কিং করে রাখা মোটর সাইকেল ভাংচুর করেন দুর্বৃত্তরা।
চট্টগ্রামে ৬ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে নগরীতে ৬ প্লাটুন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) মোতায়েন করা হয়েছে। বিজিবির এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
ইসকনের প্রতিবাদ
এদিকে বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেপ্তারের ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে ইসকন বাংলাদেশ। গতকাল এক বিবৃতিতে এ প্রতিবাদ জানায় ইসকন। সেই সঙ্গে তারা দেশের বিভিন্ন স্থানে সনাতনী সম্প্রদায়ের ওপর হামলা ও সহিংসতার প্রতিবাদ জানিয়েছে। ইসকন বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক চারুচন্দ্র দাস ব্রহ্মচারী এ প্রতিবাদ জানান।
প্রিজনভ্যান থেকে চিন্ময় কৃষ্ণের বার্তা
বিক্ষোভকারীদের প্রিজনভ্যান আটকে রাখার কারণে, পুলিশ যখন হিমসিম খেয়ে পড়েন, তখন প্রিজন ভ্যানের ফটক দিয়ে বিক্ষোভকারী সনাতনীদের উদ্দেশ্যে হ্যান্ডমাইকে বক্তব্য রাখেন গ্রেফতারকৃত চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারী।
বক্তব্যে সনাতনীদের চলমান আট দাবি চালিয়ে যেতে বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন,‘সবাই আমার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনুন, আমরা রাষ্ট্র এবং সরকারের বিরুদ্ধে নই। ৫ আগস্টের অভ্যুত্থানে যে রাষ্ট্র নির্মাণের আশা করা হয়েছে আমরা সনাতনীরা তার অংশীদার। সুতরাং রাষ্ট্র অস্থিতিশীল হয় এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নষ্ট হয় আমরা এমন কিছু করবো না। আবেগকে সংযত করে, আবেগকে শক্তিতে পরিণত করে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করবেন এবং আমাদের আট দফা দাবি মৌলিক দাবি। এটি কোন অযৌক্তিক দাবি নয়। এ দফা সফল না হওয়া পর্যন্ত আপনারা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। কিন্তু দয়া করে, রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা এবং পরস্পরের প্রতি সৌহাদ্যপূর্ণ অবস্থান রাখবেন। এটি আমি সবার কাছে আশা করছি।’
উল্লেখ্য, ৩১ অক্টোবর নগরীর চান্দগাঁও মোহরা ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ফিরোজ খান বাদি হয়ে কোতোয়ালি থানায় চিন্ময় কৃষ্ণসহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে মামলা দায়ের করেন বিএনপির নেতা ফিরোজ খান। পরে বিএনপির শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে কেন্দ্রীয় কমিটির নির্দেশ মতে চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপি ফিরোজ খানকে অব্যাহতি দেন। দায়েরকৃত এ মামলার অন্য আসামিরা হলেন অজয় দত্ত (৩৪), লীলা রাজ দাস ব্রহ্মচারী (৪৮), গোপাল দাস (৩৮), কথক দাস (৪০), প্রকৌশলী অমিত ধর (৩৮), রনি দাস (৩৮), রাজীব দাস (৩২), কৃষ্ণ কুমার দত্ত (৫২), জিকু চৌধুরী (৪০), নিউটন দে (৩৮), তুষার চক্রবর্তী (২৮), মিথুন দে (৩৫), রুপন ধর (৩৫), রিমন দত্ত (২৮), সুকান্ত দাস (২৮), বিশ্বজিৎ গুপ্ত (৪২), রাজেশ চৌধুরী (২৮), হৃদয় দাস (২৫)। যাদের মধ্যে ইতিপূর্বে দুইজনকে গ্রেফতার করেন কোতোয়ালি থানা পুলিশ।