মো. সাঈদ হাসান »
“থ্রি জিরো” বা “তিন শূন্য” তত্ত্বটি হলো ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রস্তাবিত একটি ধারণা, যেখানে তিনটি প্রধান লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে: শূন্য দারিদ্র্য, শূন্য বেকারত্ব এবং শূন্য কার্বন নিঃসরণ। এই তিনটি লক্ষ্য পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত এবং এদের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই একটি টেকসই এবং উন্নত বিশ্ব গড়ে তোলা সম্ভব বলে তিনি মনে করেন।
“থ্রি জিরো” তত্ত্বের মূল বিষয়গুলো হলো:
শূন্য দারিদ্র্য :
সমাজের সকল মানুষের জন্য মৌলিক চাহিদা পূরণ, যেমন – খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা।
শূন্য বেকারত্ব :
সকল সক্ষম মানুষের জন্য কাজের সুযোগ তৈরি করা, যাতে তারা আত্মমর্যাদা ও স্বাবলম্বিতা অর্জন করতে পারে।
শূন্য নেট কার্বন নিঃসরণ :
পরিবেশের উপর মানুষের কার্যকলাপের ক্ষতিকর প্রভাব কমিয়ে আনতে কার্বন নিঃসরণ শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা।
এই তিনটি লক্ষ্য অর্জনের জন্য ড.ইউনূস সামাজিক ব্যবসা এবং উদ্ভাবনী পদ্ধতির উপর জোর দিয়েছেন। তার মতে, এই তিনটি লক্ষ্য অর্জনের মাধ্যমে একটি শোষণ ও দূষণমুক্ত বিশ্ব গড়ে তোলা সম্ভব, যেখানে মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে একটি সুস্থ সম্পর্ক বিদ্যমান থাকবে।
শূন্য দারিদ্র্য :
দারিদ্র্যকে প্রাচীনকাল থেকে মানব সভ্যতার এক অনিবার্য বাস্তবতা হিসেবে দেখা হলেও ড. ইউনূস এই দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে একমত নন। তিনি মনে করেন, দারিদ্র্য কোনো স্বাভাবিক অবস্থা নয়; বরং এটি ত্রুটিপূর্ণ অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোর সৃষ্টি। তার মতে, ন্যায়সঙ্গত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা গেলে দারিদ্র্য সম্পূর্ণ দূর করা সম্ভব। তিনি বিশ্বাস করেন, একসময় দারিদ্র্য অতীতের বিষয় হয়ে যাবে এবং মানুষ এটিকে শুধু জাদুঘরে দেখতে পাবে।
বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্য বিমোচনে তার ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্প ও সামাজিক ব্যবসা নীতি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। বাংলাদেশ ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তার এই উদ্যোগ দারিদ্র্য নিরসনে কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। প্রায় ১৪ কোটি মানুষ ক্ষুদ্রঋণের সুবিধা নিয়ে দারিদ্র্েযর অভিশাপ থেকে মুক্তি পেয়েছে, যা তার মডেলের সাফল্যের অন্যতম প্রমাণ।ক্ষুদ্রঋণ ও সামাজিক ব্যবসা শুধুমাত্র আর্থিক সহায়তার একটি পদ্ধতি নয়, বরং এটি স্বপ্ন দেখার, উদ্যোগ নেওয়ার এবং সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নেওয়ার একটি শক্তিশালী মাধ্যম।
শূন্য বেকারত্ব :
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের শূন্য বেকারত্ব রূপকল্প বেকারত্ব সংকট মোকাবিলার অনন্য দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করেন, যা শুধু কর্মসংস্থান তৈরি করার ওপর নয়, বরং মানুষের আত্মনির্ভরশীলতা, সৃজনশীলতা এবং উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার সামর্থ্য বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব দেয়। তার মতে, বেকারত্ব দূর করার প্রচলিত ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে এমন একটি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, যেখানে প্রত্যেকেই নিজেকে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে সক্ষম হবে এবং কোনো ব্যক্তি চাকরির অভাবে কষ্ট পাবে না।
এই রূপকল্পের অন্যতম প্রধান ভিত্তি হলো সামাজিক ব্যবসার ধারণা, যেখানে ব্যবসার মূল লক্ষ্য হবে শুধু লাভ অর্জন নয়, বরং কোনো সামাজিক সমস্যার সমাধান করা। এই ধরনের ব্যবসা লাভজনক হলেও এর মুনাফা মালিকদের মধ্যে ভাগাভাগি করা হয় না; বরং তা পুনরায় বিনিয়োগ করা হয় নতুন কর্মসংস্থান তৈরিতে এবং আরও বেশি মানুষকে আর্থিকভাবে স্বনির্ভর করে তোলার জন্য। এই ধারণার মধ্য দিয়ে তিনি দেখিয়েছেন যে, ব্যবসা কেবল মুনাফার জন্য পরিচালিত হওয়ার পরিবর্তে দারিদ্র্য বিমোচন, বেকারত্ব হ্রাস এবং আর্থসামাজিক উন্নয়নের একটি শক্তিশালী মাধ্যম হয়ে উঠতে পারে।
উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার এই পথকে সহজ করার জন্য ক্ষুদ্রঋণ ও আর্থিক অন্তর্ভুক্তির ওপর তিনি বিশেষ গুরুত্ব দেন। প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থার বাইরে থাকা দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে অর্থায়নের সুযোগ সৃষ্টি করে দিলে তারা ছোট পরিসরে ব্যবসা শুরু করতে পারবে, যা একদিকে তাদের দারিদ্র্য বিমোচনে সহায়তা করবে, অন্যদিকে স্থানীয় পর্যায়ে নতুন কর্মসংস্থান গড়ে তুলবে।
শূন্য নেট কার্বন নিঃসরণ :
শূন্য নেট কার্বন নিঃসরণ (Net Zero Carbon Emission) মানে হলো, কোনো ব্যক্তি, সংস্থা বা দেশের কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ এবং কার্বন অপসারণের পরিমাণ সমান হওয়া। সহজ ভাষায়, বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইড বা অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণের পরিমাণ যত হবে, ততটাই কার্বন শোষণ বা অপসারণের ব্যবস্থা করা হবে, যাতে সামগ্রিকভাবে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ একই থাকে।
আরও সহজভাবে, যদি কোনো দেশ বা সংস্থা এক বছরে ১০০০ টন কার্বন নিঃসরণ করে, তবে তাদের কার্বন নিঃসরণ কমাতে হবে এবং একইসাথে ১০০০ টন কার্বন শোষণ বা অপসারণের ব্যবস্থা করতে হবে। এর মাধ্যমে তারা ‘শূন্য নেট কার্বন নিঃসরণ’ এর লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে।
পৃথিবী রক্ষায় কার্বন নিঃসরণ শূন্যের ঘরে নামিয়ে আনার আহ্বান জানিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘শূন্য বর্জ্যের নীতি মানুষের ভোগে লাগাম দেবে; যা একান্ত জরুরি, কেবল তাই মানুষ ব্যবহার করবে। তাতে কোনো বর্জ্য অবশিষ্ট থাকবে না। এটা সেই জীবনধারা, যেখানে কোনো জীবাশ্ম জ্বালানি মানুষ ব্যবহার করবে না। মানুষের চাহিদা মেটাবে কেবল নবায়নযোগ্য জ্বালানি। নতুন এই অর্থনীতি গড়ে উঠবে প্রাথমিকভাবে শূন্য ব্যক্তিগত লাভের নীতিতে, অর্থাৎ সামাজিক ব্যবসা হবে এর ভিত্তি।
‘থ্রি-জিরো থিউরি’ জনপ্রিয় ও কার্যকর একটি মডেল
‘থ্রি-জিরো থিউরি’ আর্থিক স্বাধীনতা, কর্মক্ষম জনশক্তি তৈরি এবং পরিবেশ উন্নয়নে বর্তমান পৃথিবীতে সবচেয়ে জনপ্রিয় ও কার্যকর একটি মডেল। । আর তা অর্জনে প্রয়োজন তারুণ্য, প্রযুক্তি, সুশাসন ও সামাজিক ব্যবসা। গ্রামীণ ব্যাংক ও ক্ষুদ্রঋণ ধারণার প্রবর্তক, শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিশ্বজুড়ে আলোচিত তার এই থ্রি-জিরো তত্ত্বের জন্য।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুসের ‘থ্রি- জিরো থিউরি’ টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট-এসডিজি অর্জনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) অর্জনে বদ্ধপরিকর। এবারের এসডিজি-১৭ মূল লক্ষ্য হচ্ছে, টেকসই উন্নয়নের জন্য বৈশ্বিক অংশীদারত্ব উজ্জীবিত করা ও বাস্তবায়নের উপায়গুলো শক্তিশালী করবে। টেকসই উন্নয়নের সব সূচকে অভীষ্ট অর্জনের ক্ষেত্রে ‘থ্রি জিরো থিউরি’ অনুঘটন হিসেবে কাজ করবে ।
ড. ইউনূসের মতে, সমাজের উন্নয়ন এমনভাবে হওয়া উচিত যাতে পরিবেশকে ধ্বংস না করে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এটি একটি বাসযোগ্য স্থানে পরিণত হয়। তাই পৃথিবীকে বসবাস উপযোগী করে গড়ে তোলার জন্য আমাদের শুধু তিনটি শূন্য অর্জন করতে হবে। এ জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস-আদালত, মসজিদ থেকে মন্দির সর্বস্তরে সভা সেমিনারের মাধ্যমে এই থিউরিটাকে সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যর মাধ্যমে সচেতনতা করতে হবে। থ্রি-জিরো থিউরির মাধ্যমে এমন একটি টেকসই উন্নয়ন করতে হবে, যার মাধ্যমে এমন একটি টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন করতে হবে, যার ফলে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থ রক্ষা পায় এবং প্রাকৃতিক ভারসাম্য (ইকোলজিক্যাল ব্যালান্স) ও মানুষের আর্থসামাজিক সাম্য বজায় থাকে।
আধুনিক চ্যালেঞ্জের মুখে, কৃষিক্ষেত্রে টেকসই ও সামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে ‘থ্রি জিরো তত্ত্ব’ কৃষি ও সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে যুগান্তকারী সমাধান হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। ড. মুহাম্মদ ইউনুসের থ্রি জিরো তত্ত্বের ধারণা বাংলাদেশ তরুণদের ক্ষমতায়ন, প্রযুক্তির ব্যবহার, সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে কৃষি খাতে একটি নতুন বিপ্লব ঘটানোর সম্ভাবনা রাখে। এই মডেলের মাধ্যমে শূন্য দারিদ্র্য, শূন্য বেকারত্ব এবং শূন্য কার্বন নিঃসরণের লক্ষ্য অর্জনের প্রচেষ্টা চলতে পারে। এভাবে, এই মডেলটির সমন্বয়ে দেশ সার্বিক উন্নয়নে একটি নতুন পথ তৈরি করবে এবং ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়নের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে। এই তত্ত্বের মাধ্যমে ড. ইউনূস একটি সমতাভিত্তিক ও স্থিতিশীল পৃথিবীর ধারণা তুলে ধরেছেন, যেখানে অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং পরিবেশগত সুরক্ষা একসঙ্গে চলবে।
আমরা যদি সত্যি সত্যিই এ পৃথিবীকে বাসযোগ্য করতে চাই, আগামী প্রজন্মের জন্য এ গ্রহকে নিরাপদে রেখে যেতে চাই, তাহলে ড.মুহাম্মদ ইউনূসের ‘তিন শূন্য’ বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই।
লেখক: উপপ্রধান তথ্য কর্মকর্তা, আঞ্চলিক তথ্য অফিস, চট্টগ্রাম।
পিআইডি ফিচার