শুভ্রজিৎ বড়ুয়া »
পাহাড় কাটা থেমে নেই। গড়ে ওঠছে অবৈধ বসতি। এর নেপথ্যে কাজ করেছে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী মানউন্নয়ন প্রকল্প। এ প্রকল্পে উত্তর পাহাড়তলীর লেকসিটি আবাসিকের পূর্ব পাশে গড়ে ওঠেছে প্রায় ২৬শ’ পরিবারের বসতি। গতবছর ওই এলাকায় পাহাড়ধসে দুই সহদোরের মৃত্যু হলেও থামেনি সেখানে বসতি স্থাপন। প্রকল্পটির কারণে সেখানে হয়েছে রাস্তা, আছে বিদ্যুৎ ও পানির সুবিধা। রেলওয়ের পাহাড়গুলো দখল ও কাটার পর জানে না পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থা।
সরেজমিনে দেখা যায়, লেকসিটির পূর্বে ও কনকর্ড সি-ওয়ার্ল্ডের উত্তরের সোজা একটি রাস্তা চলে গেছে। কিছুদূর যেতেই স্বাগতম জানালো বিজয়নগর ছড়ারপাড় সিডিসির ভিত্তিপ্রস্তর। পাহাড় কেটে ওখানে তৈরি করা হয়েছে রাস্তা। রাস্তাটি পূর্ব দিকে গিয়ে দক্ষিণে, আবার পূর্বে চলে গেছে। এখানে প্রতিটি ধাপে ধাপে গড়ে তোলা হয়েছে বসতবাড়ি। সেখানে দখলস্বত্বে জায়গা নিয়ে তারা বাড়ি গড়ছে, ভাড়াবাসায় থাকছে নি¤œআয়ের মানুষ। তাদের বসতিতে রয়েছে বৈদ্যুতিক মিটার ও পানির সংযোগ।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিজয়নগর এলাকায় আনুমানিক সাতশত পরিবার থাকে। এর ঠিক উত্তর পাশে জিয়া নগর, এরপরে মুজিব নগর। জিয়া নগরে রয়েছে আনুমানিক ১২ শত পরিবার ও মুজিব নগরে রয়েছে ৮ শতের বেশি পরিবার। বসতিগুলো প্রায় ২০ বছর আগে কনকর্ডের সি-ওয়ার্ল্ডে থাকতো। পরে কনকর্ড রেলওয়ের জায়গা ইজারা নেওয়ায় সেখান থেকে উচ্ছেদ করে বর্তমান বিজয়নগরের পাশের একটি জায়গায় তাদের পুনর্বাসন করে।
এ প্রসঙ্গে কনকর্ডের সহকারী মহাব্যবস্থাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ বলেন, ‘এটা অনেক আগের বিষয়। আমার কাছে সঠিক তথ্য নেই। তবে কিছুটা জানি, রেল থেকে জায়গা লিজ (ইজারা) নেওয়ার পর ওখানে যখন সি ওয়ার্ল্ড করা হচ্ছিলো, তখন সেখানে যারা থাকতো তাদের একটা জায়গায় থাকতে দেওয়া হয়েছিলো। এ বিষয়টি হয়েতো রেলওয়ে ভালো জানবে। কেননা এটি রেলওয়ের সাথে সমন্বয় করে করা হয়েছিলো। ওই সময় ওখানে পুনর্বাসন করা হয়েছিলো প্রায় ২৫০ পরিবারকে।’
এ নিয়ে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা সুজন চৌধুরী বলেন, ‘ওদিকের পাহাড়গুলো আমাদের। ওখানে অবৈধ বসতি গড়ে ওঠার বিষয়ে আমরা শুনেছি। ওখানে নাকি পাহাড় কেটে রাস্তাসহ নাগরিক সুবিধা সৃষ্টি করা হচ্ছে। এ কাজটা কারা করছে তা আমি নিশ্চিত নই। তবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের নামে অন্যের জায়গা অবৈধভাবে দখল করাটা মোটেই যৌক্তিক নয়। আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখবো। যদি কোনো সংস্থার সংশ্লিষ্টতা থাকে, তাহলে আমরা অবশ্যই তাদের কাছে চিঠি পাঠাবো এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।’
প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্থানীয় কাউন্সিলর জহুরুল আলম জসীম বলেন, ‘এটা বিশাল প্রজেক্ট। ইউএনডিপি ও এডিবির সহযোগিতায় সিটি করপোরেশন প্রজেক্টটির কাজ গতবছর শেষ করেছে। এ বিষয়ে আমার তেমন কিছু জানা নাই। তবে এ প্রজেক্টের কারণে ওখানে থাকা প্রায় ২ হাজার ৫ শতের বেশি পরিবার উপকৃত হয়েছে।’
পাহাড় কেটে এমন প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্পর্কে পরিবেশ অধিদপ্তরের মহানগরের পরিচালক হিল্লোল বিশ্বাসের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলে তার মোবাইল বন্ধ পাওয়া যায়। পরবর্তীতে সংস্থাটির উপপরিচালক মিয়া মাহমুদুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়গুলো আমার জানা নেই। আমার স্যার (পরিচালক) বর্তমানে দেশের বাইরে আছেন। উনি আগামী ১ তারিখ (জুন) আসবেন। তখন উনার সঙ্গে কথা বললে, উনি ভালো বলতে পারবেন।’
এ নিয়ে পরিবেশবিদ শরীফ চৌহান বলেন, ‘পাহাড় কাটার অধিকার কারো নাই। এটি পরিবেশ আইনেও অপরাধ। কিন্তু বিভিন্ন জায়গায় পাহাড় কাটা হচ্ছে। স্থানীয় প্রতিনিধির সুবিধা পেয়ে সেখানে বসতি গড়ে ওঠছে। তারা স্থানীয় প্রতিনিধির কারণে বিভিন্ন নাগরিক সুবিধাও পাচ্ছে। কিন্তু আমরা ভুলে যাই, বর্ষা আসলেই চট্টগ্রামে পাহাড়ধস হয়। এতে প্রায় প্রতি বছরই মানুষের মৃত্যু হয়। এটা নিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের সক্রিয় হতে হবে। সংস্থাটি প্রায় ৩ দশক ধরে জনবলের সংকট নিয়ে কাজ করছে বলে আমরা জানি। কিন্তু জনবলহীন প্রতিষ্ঠান আর কতদিন চলবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘চট্টগ্রামে অপরিকল্পিত ও যত্রতত্র পাহাড় কাটা বন্ধ করতে হবে। এ নিয়ে পাহাড় ব্যাস্থাপনা কমিটির প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট সবাইকে এক করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা। কারণ পাহাড় কাটার কারণে শুধু পাহাড়ধসে মৃত্যু নয়, পরিবেশের অনেক ক্ষতি হচ্ছে। বিষয়টি এখন আমাদের বোঝা দরকার। এছাড়া পাহাড় কাটার কারণে পাহাড়ি বালি আমাদের ড্রেনেজ ব্যবস্থা অকার্যকর করে নগরীতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি করছে।’
পাহাড় কেটে গড়ে ওঠা বসতি ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী নিয়ে কথা হয় পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার ড. মো. আমিনুর রহমান সুপ্রভাতকে বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানার মধ্যে ছিলো না। তবে ওই এলাকায় স্থানীয় কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ পেয়েছিলাম। অভিযোগ পেয়ে আমরা তাকে সর্তক করি এবং পাহাড় কেটে গড়ে তোলা একটা স্থাপনা ভেঙে দিই। তবে আপনি যে এলাকাগুলোর কথা জানিয়েছেন, সেগুলো আমার জানা ছিলো না। আমি বিষয়টি খতিয়ে দেখবো। উন্নয়ন প্রকল্পতো খারাপ না। তবে পাহাড় কেটে পরিবেশের ক্ষতি করে কোনো প্রকল্প করাতো ঠিক না। এমন কাজ যদি কেউ করে থাকে, তার বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’