হাফেজ মুহাম্মদ আনিসুজ্জমান »
আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু’র জন্যই সমস্ত গুণগান ও সমুদয় স্তুতি, সমগ্র সৃষ্টি জগত যাঁর অনুগ্রহে লালিত, পালিত, যাঁর নির্দেশনায় পরিচালিত। মহান সে পালনকর্তার কৃতজ্ঞতা জানাই, যিনি আমাদের জন্য উপকারী বস্তুগুলোকে হালাল করেছেন, আর ক্ষতিকর বস্তুকে হারাম করেছেন। তাঁর পবিত্রতা জ্ঞাপন করি, যিনি তাঁর ইবাদত বন্দেগীর জন্য পবিত্রতার শর্ত আরোপ করেছেন।
আমাদের সমস্ত উপাসনা আল্লাহ্র জন্য, যাঁর ইবাদতে কারো অংশীদারিত্ব নাই। তিনি ছাড়া আর কোন উপাস্য নেই। আমাদের হাদীয়ে মাহ্দী, প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহ্র প্রিয়তম বান্দা ও তাঁর শ্রেষ্ঠতম রাসূল। এ আক্বীদাÑবিশ্বাসই মুক্তির মূলমন্ত্র।
ইতোপূর্বে বলা হয়েছিল, মাহে রজব, শা’বান ও রমাদ্বান হল ইবাদত বন্দেগীর বিশেষ মওসুম। মাহে রজব আল্লাহ্র দুয়ারে হাজির হওয়ার মাস, মাহে শা’বান দানশীল মালিক আল্লাহ্র নৈকট্যে উপনীত হওয়ার মাস এবং মাহে রমাদ্বান সে মহান রাজাধিরাজ প্রভুর সাক্ষাতে, একান্ত প্রভুধ্যানে নিমগ্ন হওয়ার মাস। মাহে রজব নেকীর বীজ বপনের মাস, শা’বান এতে পানি সেচনের এবং মাহে রমাদ্বান ফসল কর্তনের মাস। এ থেকে বুঝা যায় যে, মাসত্রয়ের মাঝে রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক, অবিচ্ছেদ্য যোগসূত্রিতা যা বান্দাকে নিরবচ্ছিন্ন ইবাদতের ধারায় আল্লাহ্র একান্ত ভাবনায় বিভোর করে রাখে। তাই, এ মওসুমকে অগ্রাহ্য নয়, বরং আরাধ্য প্রভুর সম্পর্ক অটুট রাখতে, আরো নিবিড় করতে, চাই অধিক নিষ্ঠা, অকৃত্রিম প্রেমÑবিশ্বাস।
সন্দেহ নেই যে, আমরা নফস’র কুমন্ত্রণায়, পাপের কালিমায় কলুষিত হয়ে গেছি। তথাপিও দয়াময় প্রভুর করুণা, অনুগ্রহ ও ক্ষমাপ্রাপ্তি হতে নিরাশ হতে পারি না। সর্বময় ক্ষমতার মালিক, রাহ্মান রাহীম সেই আল্লাহ্ তাআলাই তাঁর রহমত হতে নিরাশ হওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। তিনি ইরশাদ করেন, ‘হে হাবীব (দ.) আপনি তাদেরকে বলে দিন, হে আমার ওই সব বান্দা, যারা পাপ করত নিজেদের আত্মার ওপর যুলুম করেছে (বা অনাচার করেছে), তোমরা আল্লাহ্র রহমত হতে নিরাশ হয়ো না। নিঃসন্দেহে, আল্লাহ্ (শির্ক ব্যতীত) সমস্ত গুনাহ্ ক্ষমা করে দেবেন। নিশ্চয়, তিনি তো ক্ষমাশীল, দয়াময়। (৩৯:৫৩) হাদীসে কুদসীতে বলা হয়েছে, ‘আমার রহমত আমার গযবের ওপর প্রবল’। তাই, আল্লাহ্র কাছে কৃত অপরাধের ক্ষমাপ্রাপ্তির লক্ষ্যে আগত মাস ও পরবর্তী মাস আল্লাহ্র বান্দাদের জন্য বিশেষ সুযোগ। এ সুযোগ কাজে লাগানোই হল বুদ্ধিমানের পরিচয়। শা’বান নামকরণের তাৎপর্য বর্ণায় রাসূলে আকরাম (দ.) ইরশাদ করেন, ‘শা’বানকে শা’বান নামকরণ এ জন্যই করা হয়েছে, মাহে রমযানর মধ্যে অবারিত কল্যাণ ও বরকত রয়েছে, সেগুলো হাসিলের জন্য মাহে শা’বান বিভিন্নমুখী দুযার খুলে দেয়’। হযরত আনাস বিন মালিক (রাদ্বি.) এ হাদীসে বর্ণনা করেছেন, গুনিয়াতুত্ তালিবীন কিতাবে এটি সংকলিত আছেন।
মাহে রজব ও মাহে রমাদ্বানÑএ মহান মাসদ্বয়ের মাঝখানে হওয়ায় মাহে শা’বানের মহিমা ও তাৎপর্য অতি ব্যাপকতা পেয়েছে। আলমাগরিবী (রাহ্.)র সূত্রে রূহল বয়ান কিতাবে উক্ত হয়েছে, আমাদের কাছে এ মাস অতি উত্তম হওয়ার কারণ, হারাম মাস সমূহের অনন্য মাস রজব এবং মাহে রমাদ্বানের মাঝখানে হয়েছে। এ মাসে বান্দাহ্র আমল, জীবন ও মৃত্যুর মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বণ্টন করা হয়। এ মাসের মধ্যে অধিকহারে নফল রোযা রাখতে আমাদের প্রিয়নবী অতি যতœবান। আগেও বলা হয়েছে, শা’বান শব্দে আরবী পাঁচটি বর্ণে পাঁচটি বিষয়ের ইঙ্গিত প্রচ্ছন্ন। শীনÑএ ‘শরফ’, আইনে ‘উলুও’, বাÑতে ‘বিরর’, আলিফÑএ ‘উলফত’ এবং নূনে ‘নূর’। যথা, মর্যাদা, উন্নতি, নেকী, অনুরাগ ও আলো। এসব আমাদের প্রত্যাশিত।
আমরা জানি, মাহে রমাদ্বানে মাসব্যাপী রোযা পালন প্রত্যেক সুস্থ বয়ঃপ্রাপ্ত মুমিন পুরুষ ও (হায়েযÑ নেফাস থেকে পবিত্র মুমিন) নারীর ওপর ফরয। যে নির্দেশনা সুরা বাকারার ১৮৩ ও ১৮৫তম আয়াতের মধ্যে বিদ্যমান। এটা আমাদের জন্য অবশ্য করণীয়, বাধ্যতামূলক, অলঙ্খনীয় আল্লাহ্র অমোঘ বিধান। এগার মাস আমরা কৃচ্ছ সাধনার এ কষ্টকর কাজটি অপরিহার্য নয় বলে নিয়মিত পালন করিনি। স্বভাবতঃ আচানক পালন করতে কষ্টের পরিমাণ বেশি বলে অনুভূত হওয়া স্বাভাবিক। তাই উম্মতের সহজতার লক্ষ্যে পূর্ববর্তী মাসে রোযা রাখার প্রতি তাদের প্রাণিত করতে নবীজি এ মাসে অধিকহারে নফল রোযা নিজেই পালন করতেন। এ প্রসঙ্গে হযরত আবু হুরায়রা (রাদ্বি.) বর্ণিত হাদীস শরীফে প্রিয়নবী (দ.) ইরশাদ করেন, ‘তোমরা মাহে রমাদ্বানের রোযার জন্য মাহে শা’বানের রোযার নিজেদের দেহ পবিত্র করে নাও’। তাই, বলা যায় শা’বান মাহে রমাদ্বানের প্রাকÑপ্রস্তুতির মাস। এটি মাহে রামদ্বানের উপক্রমণিকার মাস। হযরত উসামা বিন যায়েদ (রাদ্বি.) বর্ণিত হাদীস হতে জানা যায়, নবীজি মাহে শাবানে যে অধিকহারে নফল রোযা রাখতেন, তেমনি অন্য কোন মাসে দেখা যেত না। রমাদ্বানের সংলগ্নতাই এ বৈশিষ্ট্যের মূল কারণ।
মাহে শা’বানের অন্যতম ও প্রধান আকর্ষণ শবে বরাত। গত মাসে বিশেষ রাত ছিল শবে মে’রাজ। আগামী মাসের অত্যুজ্জ্বল মহিমার জৌলুশ হল শবে ক্বদর। শবে বরাত হল এ মাসের পঞ্চদশতম রাত, অর্থাৎ মধ্য শাবানের রাত। যে রাতকে ‘ভাগ্য রজনী’ রূপে দেখেন উম্মতের নরÑনারী। বছরব্যাপী কাকে কত রিয্ক দেয়া হবে, কারা আসন্ন বছর মৃত্যুবরণ করবে, কারা জন্মগ্রহণ করবে, এমনকি কারা কারা এ বছর হজ্ব পালন করবেন ইত্যাদি ভাগ্যলিপি বা তাকদীর’র লেখা প্রস্তুত হয় রাতটিতে। এ রাতে আল্লাহ্ তাআলা উপযাচক হয়ে পাপীÑতাপী বান্দাদেরকে ক্ষমা ঘোষণার জন্য প্রথম আসমানে তাঁর কুদরতের তাজ্জাল্লী বর্ষণ করেন, আর অসংখ্য বান্দাদের ক্ষমা করে দেন।
এতদূর পর্যন্ত হাদীস শরীফে বলা হয়েছে যে, অধিক সংখ্যক মেষপালক গোত্র বনু কলব মেষগুলোর পশম সংখ্যার চেয়েও অধিক বান্দাদেরকে আল্লাহ্্ গাফুর ও রাহীম ক্ষমা করে দেবেন। (তিরমিযী, ইবনে মাজা দ্র.) আমাদেরকে এ সুযোগ লুফে নিতে তৎপর থাকতে হবে। পরবর্তী বছর পর্যন্ত আমরা কে থাকবো, কে চলে যাবো, তা কেউ জানি না। বারে বারে সুযোগ হাতছাড়া করা হবে হতচ্ছারার প্রকৃতি’।
রজব মাসের চাঁদ উদিত হলে আল্লাহ্র রাসূল এ দুআ পড়তেন, ‘আল্লাহুমা বাÑরিক লানা ফী রাজাবা ও শা’বান, ওয়া বাল্লিগনা শাহ্রা রমাদ্বান’ অর্থাৎ হে আল্লাহ্ রজব ও শাবান মাসে আমাদের জন্য বরকত (সমৃদ্ধি) দাও, আর আমাদেরকে পবিত্র মাহে রমাদ্বানে পৌঁছিয়ে দাও’। এ দুআতে একটানা মাসত্রয়ের উল্লেখ আছে, আছে ধারাবাহিকতা, আছে বিশেস পর্বের যোগসূত্রিতা। যার প্রভাব একজন ধর্মভীরু মুমিনের হৃদয়ে অনুভূত হয় নিঃসন্দেহে। এ মাসদ্বয়ে মাহে রমাদ্বানের আগমনী সূর মুমিনের অনুরণিত না হয়ে যায় না।
পাপÑপঙ্কিলতার ক্লেদাক্ত অনুভূতি হতে পবিত্র, পরিচ্ছন্ন হতে ক্ষমা প্রার্থনা ও তাওবার বিকল্প নেই। আল্লাহ্র কাছে ক্ষমা যদি বিশুদ্ধ চিত্তে চাওয়া হয়, তবে তিনি যে ক্ষমা করতে উদগ্রীব। গত সপ্তাহের খুৎবায় পবিত্র কুরআন মজীদের একটি আয়াত সংকলিত ছিল, যাতে প্রার্থনার বিশেষ বচনগুলো উক্ত রয়েছে। যার অর্থ, ‘হে আমাদের পালনকর্তা, ক্ষমা করে দিন আমাদেরকে, আর আমাদের ওই ভ্রাতৃবর্গকে, যাঁরা আমাদের অগ্রবর্তী হয়েছেন ঈমানসহকারে। আর আমাদের অন্তরে তাঁদের জন্য কোন বিদ্বেষ রেখো না যাঁরা ঈমানদার। হে আমাদের প্রতিপালনকারী, নিশ্চয় তুমি অতি দয়ার্দ্র, করুণাময়’। (সুরা হাশর :১০) আল্লাহ্র কাছে চাইলে তিনি খুশিই হন। সবাই তাঁর কাছে যাচনাকারী। ইরশাদ হয়েছে, ‘আসমানÑযমীনে যারাই আছে সবাই তাঁর কাছে প্রার্থনা করে। প্রতিদিন তিনি স্বতন্ত্র বিষয়ে রত আছেন’। (৫৫:২৯)
লেখক : আরবী প্রভাষক,
জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলীয়া মাদ্রাসা।
খতিব : হযরত খাজা গরীব উল্লাহ শাহ (র.) মাজার জামে মসজিদ।
























































