দীপক বড়ুয়া »
আমার নাম রেখেছে বাবা তুবড়ি। মা-বাবার একটি সন্তান, আদরের। আমি নাকি বাজির মতো জ্বলি। জ্বলে সবকিছু শেষ করে দিই নিমিষে। ছোটবেলায় চটপটে, দুরন্ত ছিলাম। অসময়ে গাছে উঠে আম পেড়ে খেতাম। কারো গাছে জাম, বড়ই, কাঁচাপাকা থাকতো না। নিমিষেই শেষ করতাম খেয়ে। লেখাপড়া নেই, শুধু দুষ্টুমি। এত দুরন্তপনা দেখে আমার নাম তুবড়ি। সকলেই ওই নামে ডাকে। ওই নামেই আমাকে মানায়।
আমার বাবা জগৎহরি জলদাস। একজন জেলে এবং মাঝি। মাছ ধরে বিক্রী করে সংসার চালাতো। আগে অনিল বহদ্দারের বোটের মাঝি ছিলো। ভালো বেতন দিতো। কয়েক বছর পরে অনিল বহদ্দারকে বলে, আমি নিজে বহদ্দার হতে চাই। অনেক বছর আপনার মাঝি হিসেবে কাজ করেছি। কিছু টাকা জমিয়েছি। এবার নিজে একটা কিছু করতে চাই। অনিলবাবু বড়ো মনের মানুষ। সব সময় মানুষের উপকার করে। বাবার কথায় উত্তর দেয়, ঠিক আছে করো।
খুশিতে বাবা নাচতে থাকে। একটু থেমে অনিলবাবুকে বলে,
– একটি সমস্যা আছে।
– কী সমস্যা?
– বহদ্দার হবার মতো টাকা আমার নেই। শহরে একজন আড়তদার থেকে টাকার ব্যবস্থা করে দেবেন? না হলে কীভাবে বহদ্দার হবো।
অনিল বহদ্দার কী যেন ভাবে। খানিক পরে উত্তর দেয়,
– দিতে পারি একটি শর্তে।
– কী শর্ত বলুন, শত শর্তে আমি রাজী আছি। তবু আমি বহদ্দার হয়ে রাঙাবালি যেতে চাই দাদা।
– শর্ত হলো যার গদি থেকে টাকার ব্যবস্থা করে দেবো, তাঁর সাথে বেঈমানী করবে না। তাদের বাবার সঙ্গে অনেক বছর ধরে ব্যবসা করছি। একটা টাকাও আমার থেকে পাবে না। তাঁরা দু ভাইয়ের ছেলেরা এখন ব্যবসা করে। আমি বড়োভাইয়ের ছেলের সাথে করি, তোমাকে ছোট ভাইয়ের একমাত্র ছেলের থেকে টাকার ব্যবস্থা করে দেবো।
– দাদা আমি আপনার পা ছুঁয়ে ভগবানের নামে শপথ করছি কোনদিন মালিকের সাথে বেঈমানী করবো না।
তখন থেকে আমার বাবা জগৎহরি জলদাস নাম পাল্টে হয় জগৎহরি বহদ্দার। কী উন্নতি বাবার। প্রথম বছরে ফিসিং বোট নেয় একটা । রাঙাবালি যাবার ট্রলারও বাড়ে একটা।
আমি জগৎহরি বহদ্দারের এক মাত্র মেয়ে তুবড়ি। ছোট বেলায় মা-কাকি, বউদিকে দেখতাম শুধু শাড়ি পরতে। গায়ে ব্লাউজ কখনও দেখিনি। এটা নাকি জেলে মেয়েদের নিয়ম। কী শীত, কী গরম, বর্ষায় ওই খালি গায়ে থাকতো আঁচল পেঁচিয়ে।
ধীরে ধীরে আমি বড়ো হলাম। আমিও খালি গায়ে থাকি। মেয়েদের যুবতী বয়সে ঐ খালি গায়ে চলাফেরায় নানান অসুবিধে হয়। যুবক ছেলেরা অশুভ দৃষ্টিতে দেখে। আমার বাড়ন্ত শরীর দেখতো চুপিচুপি জেলে সর্দারের ছেলে বলরাম।
নদীতে স্নান করার সময় অনেকের সাথে যেতাম। সবাই সমবয়সী। সবার বাড়ন্ত শরীর। কতক্ষণ লুকিয়ে রাখা যায় শাড়ীর আঁচলে। ভেজা শাড়িতে স্পষ্ট ভেসে উঠতো সব। সেই ফাঁকে বলরাম উঁচু গাছে বসে নয়তো আড়ালে মেয়েদের স্নান দেখতো। অসভ্য ছেলে একটা। আবার কিচ্ছু বলা যাবে না সর্দারের ছেলে।
এভাবে দিন যায়। নিজের ঘরে একা নিজেকে দেখি, সত্যি অনেক বড়ো হয়ে গেছি। কারো বিয়ে অনুষ্ঠান দেখলে বিয়ে করতে ইচ্ছে করে। মা-বাবা বিয়ের কথা বলে না। ওরা আমাকে দেখে বোঝে না আমি বড়ো হয়েছি। মা বাড়ির কাজে, বাবা ব্যবসার কাজে সারাদিন ব্যস্ত। মনে নেই মেয়েটি বড়ো হলো।
অথচ আগে কম বয়সে জেলে মেয়েদের বিয়ে দিতো। আমার বাবা মাকে বিয়ে করছিলো চৌদ্দ বছর বয়সে। অথচ আমার বয়স ষোল পার হলো কবে? মা-বাবার আমার বিয়ে বিষয়ে কোনো ভাবনা নেই। নিজেদের যৌবনের বয়সের কথা মনেও রাখে না। কী অদ্ভুত পৃথিবীর নিয়ম!
যুগে যুগে সবকিছু বদলে যাচ্ছে। একদিন রাতে মেরীবৌদি বাজার থেকে ব্লাউজ, ব্লাউজের ভেতরে পরার একটি ছোট রøাউজ এনে পরতে বলে। বৌদি আরো বলে, দরজা বন্ধ। কেউ আসবে না, পরো। আমি ওসবের কী জানি। বৌদি হয়তো জানে। পরেছে মনে হয়। না হলে বুকটা এতো সুন্দর কেন? বৌদি বলে, এটার নাম ব্রেসিয়ার, ছোট নাম ব্রা। প্রথমে এটা পরো বলে আমাকে পরিয়ে দেয়। পরার পর বিরাট স্বস্তি পেলাম। আগে বুকটা নড়তো, এখন নড়ে না। তারপর ব্লাউজ পরিয়ে দেয়। গায়ের আঁচলটা কাঁধে জড়িয়ে দিয়ে বলে, খুব সুন্দর লাগছে ননদিকে।
আমি ভয়ে কাঁপছি। বৌদি প্রশ্ন করে, কী হলো তোমার, কাঁপছো?
– ভয়ে বৌদি।
– কেন ভয়?
– মা এসব দেখে যদি মন্দ বলে! কোনদিন তো এই পোশাকে দেখেনি। খালি গায়ে দেখেছে।
– কিচ্ছু বলবে না মা। আমি বুঝিয়ে বলবো। তুনি শুধু বলো, কেমন লাগছে তোমার।
আমি নিজেকে দেখে লজ্জা পেয়ে দুই চোখ ঢাকি। আমি বলরামকে মনে মনে পছন্দ করি। সুন্দর ছেলে। স্বাস্থ্যবান, ফর্সা, সুঠাম দেহ, ঝকঝকে কালো চুল। দূর থেকে শুধু দেখি। লেখাপড়া নেই। আমার মতো। জেলের ছেলেদের লেখাপড়া নেই। বড়ো হলো মাছ ধরো, নৌকা চালাও কাজ। বলরাম জেলে সর্দারের ছেলে। বড়ো লোক।ওই পরিবারের সাথে আমাদের পরিবারের আত্মীয় হয় কখনও। বাবার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক আছে শুনেছি। তাতে কী?
দুপুরে সবাই স্নান করতে যাই। জোয়ার-ভাটায় স্নান করি। আজ স্নানের সময় জোয়ার ছিলো। জলের তেজটা কেমন জানি বেশি। গত রাতে প্রচন্ড বৃষ্টি হয়েছে। সেই কারনে নদীর জলে তীব্র গতি। পা পসকে যেতেই জলের স্রোতে ভেসে যাচ্ছিলাম। সাথীদের চিৎকারে বলরাম ঝাঁপিয়ে পরে আমাকে কূলে তোলে।
আমি জল খেয়ে বেঁহুশ। বলরামের সহযোগিতায় সবাই আমাকে বাড়ি পৌঁছে দেয়। বাবা রাঙাবালি। মা, বৌদি, দাদা, কাকা বাড়িতে। বলরামের সবাই প্রশংসায় পঞ্চমুখ। আজ বলরাম না থাকলে তুবড়ি নদীর জলে তলিয়ে যেতো।
এই খবরটা বলরামের বাবা সর্দার কানাইলালের কানে পৌঁছায়। তিনি তো রেগেমেগে আগুন। বিত্তের অহংকারে বড় গলায় শাসায় জগৎহরির মেয়ে নদীর জলে পরেছে, বলরামের কী দরকার ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঁচানোর। অসহ্য, অসম্মান আমার। ঘরের কোনও কাজে নেই, পরোপকারে ব্যস্ত। হারামজাদা ঘরে আসুক ঠ্যাং ভেঙে দেবো।
কানাইলালের চিৎকার শোনে বউ মনিবালা উঠোনে আসে। মনিবালা মেট্রিক পাশ করা মেয়ে। কোনও দূর্নীতি, অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা পছন্দ করে না কানাইলালের। অন্যায় দেখলে মুখোমুখি উত্তর দেয়। আজকেও ছাড়েনি। বলে, কী হয়েছে তোমার। কাকে বকছো? কে কী করলো শুনি।
– তোমার গুনধর পুত্র নিস্কর্মা বলরাম নদীতে ঝাঁপিয়ে পরে জগৎহরির মেয়েকে জল থেকে উদ্ধার করে বাহবা পাচ্ছে। কত প্রশংসা, নাম।
– তাতে দোষের কী দেখলে? একটি মেয়ের জীবন বাঁচিয়েছে। এটাতো মানবিক কাজ। এসব কাজ মানুষের দায়িত্ব। মানুষ মানুষের জন্য। আরও একটি কথা মনে রাখবে, সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।
মনিবালার কথার অর্থ কানাইলাল কি বোঝে? শুনে জেলে সর্দার কানাইলাল চুপ। কী ভেবে কানাই বলে, আমার সাথে জগৎহরির পরিবারের পার্থক্য কতটুকু জানো?
– কিসের পার্থক্য?
– আমি কুতুবদিয়ার বিত্তশালী , ক্ষমতাবান মানুষ। এবং জেলেদের সর্দার। একজন মানিব্যক্তি। আমার মুখের ওপর কথা বলার সাহস করে কেউ? আর তুমি বলছো আমার ছেলে জগৎহরির মেয়েকে নদীর জল থেকে বাঁচিয়ে মহৎ কাজ করেছে।
– এটা তোমার মিথ্যে অহংকার। কোনো বাহাদুরী নয়। শোনো, কথা বাড়িও না। টাকাকড়ি আজ আছে কাল থাকবে ঠিক নেই। পৃথিবীতে সব অনিত্য, নিত্য কিছু নয়। সব পরিবর্তনশীল। সেইজন্য কাউকে ছোট বলে তাচ্ছিল্য করা ঠিক? না। তাই আমার ইচ্ছে জগৎহরি রাঙাবালি থেকে ফিরলে ওর মেয়ে তুবড়িকে বলরামের বউ হিসাবে প্রস্তাব নিয়ে যাবো।
– ছি ছি মনিবালা কী বলছো? তা কেনদিনও হয়? আকাশে-পাতালে সম্বন্ধ হতে পারে বলো!
– পারে। তুমিও একদিন গরীব ছিলে। মনে পরে, দুইবেলায় একবারও ভাত জুটতোনা তোমার। আমাকে ঘরের বউ হিসেবে তোলার পরে উন্নতি, আজকের এই বিত্তশালী কানাইলাল সর্দার। আমার কথা শুনে চলায় এই আমূল পরিবর্তন। বিত্তবান তুমি। অতীত ভুলবে না কেনদিন। ভুললেই ভরাডুবি মনে রেখো। তুমি জলদাস, জগৎহরি জলদাস, পার্থক্য তোমার টাকাকড়ি প্রচুর। জগৎহরির তা নেই।
– আচ্ছা তোমার ছেলেটা নিস্কর্মার ঢেকি। জগৎহরির মেয়েকে তোমার বলরামের সাথে বিয়ে দেবে মনে হয়। কি খাওয়াবে বউকে। সেই মুরোদ আছে বলরামের। কিছু করুক আগে।
– বেশতো, বাজারের একটি দোকানের দায়িত্ব বলরামকে দাও। শিখিয়ে তৈরি করো ওকে। ও পারবেই। তুমিতো আবার নিজের ছেলের চেয়ে কর্মচারীদের বেশি বিশ্বাস করো।
এবার কানাই কথা বাড়ায় না। বাজারের দিকে পা বাড়ায়।
বলরামের মা- বাবার কথা আমার কানে আসে। শোনে বৌদি, মা, কাকা। সবাই ভয় পায় কানাইলালকে। ভীষণ গরম অত্যাচারী মানুষ। কথাকাজে মিল নেই, বেপরোয়া, মদ্য পান করে । মানুষকে মানুষ ভাবে না। বিশেষত যাদের টাকা কম,তাদের মোটেই পছন্দ কওে না। মনিবালাই আর কি? কতক্ষণ মুখোমুখি দাঁড়াবে। সামনাসামনি যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ কানাইলাল সুবোধ, তারপরে ——!
আমি তুবড়ি, এমুহূর্তে বড্ডো একা। বলরাম কোথায়? আমার বুক ভরা যন্ত্রণার খবর তার হৃদয় জানে?
শ্রীকৃষ্ণ বলে, দূরে থাকলে প্রেম জাগ্রত হয়, কাছে এলে মিলিয়ে যায়।
আমি তুবড়ির কি সেই একই দশা!
কী জানি!