শচীন্দ্র নাথ গাইন :
রাতুল আর ইভা ভাই-বোন। রাতুলের বয়স নয় বছর, তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র। ইভা আগামী ডিসেম্বরে চার বছরে পড়বে। স্কুলে যাওয়ার বয়স হয়নি। মা’র পাশে সকাল-সন্ধে বইখাতা নিয়ে বসে পৃষ্ঠা উল্টায়, ছবি দেখে আর হিজিবিজি আঁকে।
দু’ভাইবোনের মধ্যে খুব মিল। কোনোকিছু নিয়ে মোটেই গোলমাল করে না। খুব শান্তশিষ্ট। বাবা-মাকে তারা খুব শ্রদ্ধা করে, তাদের উপদেশ মেনে চলে। বাবা সকাল ৮টায় অফিসে চলে যান, ফেরেন সন্ধ্যার পর। রাতুলের স্কুল চলতো সকাল ৯টা থেকে, ফিরতে দুপুর গড়িয়ে যেত। ইভার তখন কিছুটা মন খারাপ থাকতো। মা বুঝতে পেরে ইভাকে কাছে ডেকে মাথায় হাত বুলিয়ে অনেক গল্প শোনাতেন।
এ বছর কী এক ভয়ানক রোগ করোনা এসে সব যেন তালগোল পাকিয়ে গেল। বাবার অফিস, রাতুলের স্কুল সব বন্ধ। সবাই যার যার বাসায় খাঁচায় আটকা পাখির মতো। বাবা বলেন, এটা লকডাউন।
প্রতিবছর রাতুলের স্কুলে জ্যৈষ্ট মাসে গরমের ছুটি পড়লে বাবাও কদিন অফিস থেকে ছুটি নেন। মা-বাবার সাথে ইভা-রাতুল গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যায়। দাদা-দাদিও তাদেরকে কাছে পেয়ে আনন্দে মেতে ওঠেন। আম, কাঁঠাল, লিচু, জাম, খেজুর, তরমুজসহ আরও কত তাজা পাকা ফল পাওয়া যায় তখন গ্রামে। রসে সব টইটম্বুর। জ্যৈষ্টকে তাই তো মধুমাস বলে। টাটকা-তাজা রসালো সুমিষ্ট ফল খাওয়ার মজাই আলাদা। এবার গ্রীষ্মের সেই মজাটা তারা একদম পায়নি। লকডাউনের কারণে অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজের সাথে তখন যানবাহন বন্ধ ছিল। ফলের স্বাদ নেওয়ার ইচ্ছে থাকলেও তখন বাড়ি ফেরা সম্ভব হয়নি। বাসায় শুয়ে বসে ঢাকাতে সময় কেটেছে। অনেকদিন পর যানবাহন চলা শুরু হতেই দাদার ফোন পেয়ে ইভা-রাতুলের গ্রামের বাড়ি যাওয়ার বায়না শুরু হয়ে গেল। ঈদ-উল-আযহার দুদিন আগে তারা গ্রামে ফিরেছে। ঈদের দিনের মজাটা ওরা এবার পুরোপুরি উপভোগ করতে পারেনি। ঈদের মাঠে যাওয়া হয়নি। করোনার কারণেই কেমন যেন নিষ্প্রাণ একটা ভাব ছিল।
তবু দাদা-দাদি, বাবা-মা সবাই মিলে একসাথে কাটাতে পেরেছে এটাও তো অনেক বড় পাওয়া।
ঈদ শেষে ওদের বাবার অফিস খুলেছে। তাই তিনি ঢাকায় চলে গেছেন। মা’র সাথে ইভা-রাতুল আর কটা দিন থাকার আশায় এখনো গ্রামের বাড়িতেই।
ওদের বাড়ির সামনেই বিশাল উঁচু দুটো তালগাছ। তাল ধরেছে প্রচুর। ভাদ্র মাস পড়তেই তাল পাকা শুরু হয়েছে। ধুপধাপ করে রাতদিন তাল পড়ে। মউ মউ একটা মিষ্টি গন্ধ নাকে লাগছে। দাদা প্রতিদিন ভোরে পাকা তাল কুড়িয়ে ঝুড়িতে করে নিয়ে আসেন। ইভা-রাতুলকে ডেকে দাদি একদিন সকালে বললেন, আজ তোমাদেরকে তালপিঠে বানিয়ে খাওয়াব।
শুনে ওরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকে। এ সময় অন্যবছর বাড়িতে আসা হয়নি। একবার বাজার থেকে কিনে আনা দুটো তালে মা তালের বড়া বানিয়ে তাদেরকে খাইয়েছিলেন।তালপিঠের নাম শুনেছে ওরা। বানাতে দেখেনি, খাওয়াও হয়নি। ওদের থতমত ভাব দেখে পাশে দাঁড়িয়ে মা মুখ টিপে হাসতে থাকেন।
অধীর আগ্রহে তালপিঠে বানানো দেখার আর খাওয়ার অপেক্ষায় থাকে ওরা।
বিকেলে গোটা পাঁচেক পাকা তাল নিয়ে ওদের মা আর দাদি হাত দিয়ে চটকিয়ে ছেঁকা শুরু করলেন। গাঢ় হলদে রস বের করে গামলায় রাখতে থাকেন। তারপর এক গামলা পাকা তালের ছেঁকা রস নিয়ে দাদির সাথে মাও ঢুকলেন রান্নাঘরে। ইভা-রাতুলও মা’র পিছনে পিছনে গেল।
আলাদা আলাদা পাত্রে কিছু ময়দা, চালের গুঁড়া, আখের গুড়, নারকেল কোরা, তেল ও পরিষ্কার করে রাখা কিছু কলাপাতা আগেই টেবিলে সাজিয়ে রেখেছেন দাদি। ওরা পাশে গিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মা’র কাছ থেকে সাজিয়ে রাখা জিনিসপত্রের নাম জেনে নিলো।
খুব মনোযোগ দিয়ে ওরা মা আর দাদির পিঠে বানানো দেখতে থাকে। ময়দা, চালের গুঁড়া, আখের গুড় পরিমাণ মতো নিয়ে তালের ছেঁকা রস একসাথে সুন্দর করে মিশিয়ে ফেললেন দাদি।
তারপর কলাপাতায় সামান্য তেলের
প্রলেপ লাগিয়ে সবকিছু মেশানো পাকাতালের রস সেই পাতার ওপর লাগিয়ে আরেক খ- কলাপাতা দিয়ে ঢেকে দিয়ে থরে থরে সাজিয়ে রাখলেন। এবার চুলার ওপর ফ্রাইপ্যান চাপিয়ে আগুনের তাপে গরম করতে থাকলেন। গরম হওয়ার পর কলাপাতায় মোড়া তালের মিশ্রণ ফ্রাইপ্যানের ওপর দিয়ে ৪/৫ মিনিট পরপর নামিয়ে আধপোড়া কলাপাতা খুলে ফেলতেই তালপিঠে। আহ্,গরম গরম নরম নরম তালপিঠে খেতে কীযে মজা! ইভা-রাতুলের তালপিঠে খাওয়ার আনন্দ-উল্লাস দেখে দাদা-দাদি এবং মাও ভীষণ খুশি।