তারপরেও ধর্ষণ থামছে না কেন

৮ মার্চ ছিল আন্তর্জাতিক নারী দিবস। সে দিবস উপলক্ষে দেশ জুড়ে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে অনেক অনেক অনুষ্ঠান হয়েছে। নারী নিয়ে আশাব্যঞ্জক কথাবার্তাও হয়েছে। অথচ সেদিনের কয়েকটি ঘটনা ছিল এমন, গাজীপুরের শ্রীপুরে আরেকটি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। বনের ভেতর নির্জন স্থানে আরমান মিয়া নামের এক ব্যক্তি শিশুটিকে ধর্ষণ করে সে দৃশ্য মুঠোফোনে ধারণ করেছেন এবং সেই ভিডিও ক্লিপ তিন বন্ধুকে পাঠিয়েছেন। ওই ব্যক্তিকে গণপিটুনি দিয়ে এলাকাবাসী পুলিশের জিম্মায় দেন। একই দিনে ঠাকুরগাঁওয়ের সদর উপজেলায় পঞ্চম শ্রেণির এক ছাত্রীকে ধর্ষণের ঘটনায় গ্রেপ্তার হন মোজাম্মেল হক মানিক নামের এক শিক্ষক। ৮ মার্চ রাতে কেরানীগঞ্জে চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা এক নারী দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন বলে অভিযোগ উঠেছে। মামলার পর আশরাফুল ও দীপ সরকার নামের দুই অটোরিকশাচালককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

আমাদের মনে রাখতে হবে, নারী ও শিশু নির্যাতনের যেসব ঘটনা গুরুতর হয়, সেসব উঠে আসে সংবাদ মাধ্যমে। এর বাইরে অনেক খবর আড়ালেই থেকে যায়। নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতন বিষয়ে ১৬টি জাতীয় দৈনিকের তথ্য সংকলন করে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ জানিয়েছে, গত বছর নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের ২ হাজার ৫২৫টি খবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। এর মধ্যে জানুয়ারি থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত ৭ মাসে ১ হাজার ৬৬৪টি ও আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৫ মাসে ৮৬১টি নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। গত বছর ৩৪৫ জন ধর্ষণ, ১৪২ জন দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ২৩ জনকে। ধর্ষণের কারণে আত্মহত্যা করেন ছয়জন।
একটি দৈনিকে বলা হয়েছে, ২০১৬ সালে দিনাজপুরে যৌনাঙ্গ ব্লেড দিয়ে কেটে পাঁচ বছরের এক শিশুকে ধর্ষণ করেন প্রতিবেশী সাইফুল ইসলাম। অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় সাইফুলের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। আদালত থেকে জামিন নিয়ে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি দিনাজপুর জেলা কারাগার থেকে মুক্ত হয়েছেন তিনি। এ ঘটনায় ক্ষোভ সৃষ্টি হলেও আসামিকে আবার কারাগারে পাঠানোর মতো কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। ওই শিশুর বাবা ক্ষোভ প্রকাশ করে সে পত্রিকার সাংবাদিককে বলেছেন, আসামি চোখের সামনে ঘুরেফিরে। তাঁর স্ত্রী ও মেয়ে এখন ঘর থেকে বের হতে চান না।
এই যদি অবস্থা হয় তাহলে ধর্ষকেরা বেপরোয়া হয়ে উঠবে না কেন? সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে নারী ও শিশু ধর্ষণ এবং নির্যাতনের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সংগঠন ইউনিভার্সিটি টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইউট্যাব)। সংগঠনের বিবৃতিতে বলা হয়, অতিসম্প্রতি দেশজুড়ে নারীদের প্রতি সহিংসতা ও হেনস্থার ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে। জীবনে চলার পথে নিত্যদিনই নারীরা যেমন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন, তেমনি অনলাইনেও তারা সাইবার বুলিংসহ বিরূপ আচরণের শিকার হচ্ছেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে রাস্তাঘাট এবং শপিংমল ও কর্মস্থল থেকে আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে শিশু, ছাত্রী এবং নারী শ্রমিকসহ বিভিন্ন পেশার নারীদের শ্লীলতাহানী এবং হেনস্থা করা হচ্ছে। ধর্ষণ ও নির্যাতনের মাধ্যমে নারীদেরকে হত্যা করার মতো নির্মম ও জঘন্য ঘটনাও ঘটছে।

ইউট্যাবের নেতারা বলেন, দেশে একের পর এক নারীকে হেনস্থা ও আক্রমণ এবং সামগ্রিক বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি গড়ে উঠছে, তা রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতা ও সম্প্রীতির জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই অসভ্যতা ও সহিংসতার পেছনে কোনো উগ্রগোষ্ঠীর উসকানি বা মদদ থাকতে পারে বলেও উল্লেখ করেছেন তারা।
এর সঙ্গে সহমত প্রকাশ করে ওয়াজ মাহফিল ও ধর্মীয় বয়ানের নামে নারীদের প্রতি অপমানসূচক বক্তব্য প্রদানকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করার দাবি জানাই আমরা।