ইলিয়াস বাবর »
গল্পের বড় শক্তি সে পরিপার্শ্বের সবকিছু নিজের ভেতর ধারণ করতে পারে। এমনকি খুব অনায়াসেই গল্পের অধিগত ভূগোলের বাসিন্দা হয়ে যায় জগতের সকল কিছু। শিল্পের অপরাপর শাখাসমূহে এটা আছে তবে গল্পের সাথে অন্যদের ফারাক এই, গল্প যাবতীয় বিষয়কে একান্তই আপন করে স্থান দিতে পারে তার শরীরে। চারপাশকে এত নিবিড়ভাবে গল্পে প্রকাশ করে কুশলী শিল্পীরা, ভেবে অবাক হতে হয়, মানুষের জীবন কত বিচিত্র! কত বৈচিত্রতা মানবজনমকে ঘিরে রাখে, কত কত হাহাকার আর হর্ষ মানুষকে ভরিয়ে দেয় দিনমান! বস্তুত: একজন নিষ্ঠ গল্পকার তার চোখকে সমাজের চোখ বানিয়ে নেয় সময়ের প্রয়োজনে। নিজের দেখার সাথে, বোঝার সাথে, জ্ঞানের সাথে বিস্তর বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে চলে তার শিল্পের চর্চা। নিয়ত পরিবর্তনশীল সমাজ ও সময়ের সাথে আলাপের পরিসরে এই নির্মাণের পথ বড়ই নির্মম। সময়টা এমন আর মানুষের মনও এমন, নিমিষেই ঘটে যায় অকল্পনীয় অদ্ভূত কিছু। ফলে নমস্য ইলিয়াস উত্থাপিত বাংলা ছোটগল্প মারা যাবার প্রেক্ষিত আমাদের বারেবারে স্মরণে আসে। তবুও জগতের বিস্ময়হেতু চলমান থাকে সৃজনের উসকানি। এই প্রাককথনের উদ্দেশ্য আমাদের খোলাসা করতে হয় এক্ষণে, দেবব্রত সেন প্রণীত ‘তখনও যায়নি ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ’ গল্পগ্রন্থ। বর্তমান গল্পগ্রন্থের গল্পসমূহের পাঠ-পরবর্তী আলাপে আপনাদের স্বাগতম।
গল্পকারের দেখার চোখ নিয়ে যখন আলাপের মুসাবিধা হয় তখন এটাও এক বড় প্রশ্ন নিয়ে হাজির হয় যে, গল্পকার কী দেখে? যদি মানুষই প্রথমত তার চারপাশকে দেখে তবে গল্পকার কেনো বাদ যাবেন তার পরিপার্শ্ব দেখা থেকে? দৃষ্টির বিষয়টাই এমন, আগে নিজেকে তারপর ক্রমশ দূরের দিকে সে যেতে চায়। আমাদের কথাবার্তা প্রাগুক্ত গল্পগ্রন্থের আলোকেই হবে, ফলত আলাপের টোনকে ভিন্নভাবে না দেখাই শ্রেয়। এদেশের, বিশেষত সনাতন সম্প্রদায়ের বহু বহু লোক দেশান্তরী হয়। কেউ স্বেচ্ছায় কেউ বা ধান্ধায়। কেউ ঠকে যায়, কেউবা ঠকিয়ে। আমরা লেখক না শুধু কোনো মানুষকেই ধর্মীয় পরিচয়ে বড়-ছোট করায় বিশ্বাসী নই; কারো ধর্মীয় পরিচয় দিয়ে তাকে জাস্টমেন্ট করাই ন্যায্য হতে পারে না। কিন্তু কিছু বিষয় স্বীকার করতেই হয়, দেবব্রত সেন যেই হৃদয় দিয়ে তার স্বজাতির দেশান্তরি অনুধাবন করতে পারেন দূরের কেউ তা পারবেন না সঙ্গত কারণেই। এইখানে দেবব্রত’র ব্রতকে ধন্যবাদ দিতে হয়। প্রথম গল্প ‘উদ্বাস্তু’। গল্পের সুনীল ও মলিনা তাদের সন্তান নিয়ে চলে যায় পড়শী দেশে। কিন্তু সেখানে তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথ হয় আরও দীর্ঘ, আরও কঠিন। একটা সময় তারা বুঝে যায় পরদেশে সবকিছুই কঠিন। গল্পের নামও তাই বলে আমাদের। কিন্তু লেখকের সততার জায়গা এই, তিনি পরিস্থিতি আড়াল করেননি। ‘তখনও যায়নি ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ’ গল্পটাতে মিলমিশ হয়ে আছে একাধিক দুঃখবোধের বাস্তবতা। এদেশে নির্বাচনকেন্দ্রিক সনাতনীদের নিগৃহীত হবার বদনজির আছে। এর প্রেক্ষিতে দেশান্তরি হবার উদাহরণও অহরহ। নামগল্পের প্রতি পাঠককূলের আগ্রহ থাকে বড় বেশি। ফলে গল্পটি আমাদের মনোযোগের কেন্দ্রে থেকেই যায়। পেশীবহুল সমাজে নির্বাচনের ঢামাঢোলে আমদানি হয় মুরগি মিলনদের, তাদের মাধ্যমে নেতাও নির্বাচিত হয় সেই লেভেলের। মাঝখান দিয়ে পান থেকে চুন খসতেই ক্ষতিগ্রস্থ হয় এক সম্প্রদায়ের লোক। অসম্প্রদায়িকতার ভেক ধরা যত দেবদূতই আসুক কপালের খারাবি যায় না তাদের। তবুও তারা বলে, ‘অনেকবার ভেবেছিলেন ভারতে চলে যাবেন। কিন্তু বাংলাদেশকে মায়ের মতোই ভালোবেসেছিলেন। এ ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে মাটির মায়া তিনি কাটাতে পারেননি। বাপ-দাদার ভিটে-মাটি আঁকড়ে পড়ে আছেন। ওখানে গিয়েও-বা কী করতেন। ভিনদেশি লোকের হাতে নিগৃহীত হওয়ার চাইতে স্বজাতির হাতে হওয়া অনেক ভালো।’
আলোচ্য গল্পের হিমাংশুর এই কথার ‘ভিনদেশি’ শব্দটার দিকে নজর দেবো আমরা। গল্পস্থিত চরিত্রের গল্পকারের এই ভাবনা আমাদের মোহিত করে নিশ্চয়ই। সেইসাথে দেশপ্রেমের একটা বিষয় সামনে আসে সবকিছু বাদ দিয়ে। ‘ভিনদেশি’ বদনসিব কেউই বরণ করতে চায় না এবং স্বদেশের বাইরের যাবতীয় দুনিয়াই ‘ভিন’ স্বদেশবাসীর জন্যে। এই বোধ কখনো কখনো ভুলে যাই আমরা, গল্পকার মনে করিয়ে দেন যতন করে, তার গল্পে। এরপরেও কখনো কখনো অনিবার্য হয়ে যায় দেশান্তরী। যার প্রেক্ষিতে আমাদের ভুলোমনা সময়ে গল্পকার হাজির করেন ‘রাজলক্ষী’। আমাদের অনুভবকে চুরমার করে দেয় অন্তঃসত্ত্বা রাজলক্ষী দাস ও তার মা সুমিতাবালা দাসের ধর্ষণের ইতিহাস। কী নির্মম এক সত্য সামনে আনেন গল্পকার! তাহলে কেনো নির্বাচন নামের এই অসুর, যদি তার কারণেই ধর্ষিত হতে হয় মা-মেয়েকে? ‘রাজলক্ষী’ গল্প থেকে শোনা যাক, ‘হিন্দুর জমি সবাই পানির দামে কিনতে চায়’ অথবা ‘মাইনষে কিল্লাই দেশ ছাড়ে? সহজে ত কেউ বিদেশ যায় না। সমীরের বউ যন বেইজ্জত হইছিল তন হেতির হেডে যে মাইয়াটা আছিল হেতি অন ডাঙ্গর অইছে। এই দেশে থাইকলে মাইয়াটার বিয়াশাদি লই বিপদে হড়ন লাইগত’। গল্পের এই সত্য মূলত বাস্তবতার সত্য। গল্পকার একে খুঁজে পেয়েছেন পরিপার্শ্ব থেকে, স্বজাতির দুর্ভাগা সময় থেকে। যেই আলাপ আমরা শুরুতে তুলেছিলাম যে, গল্পকার অতি কাছের বিষয়ে যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে তা সম্ভব হয় না অচিন কোনো বিষয়ে। দেবব্রত সেনের গল্পকার হিসেবে এই স্বার্থকতা আমাদের অদ্বৈত মল্লবর্মণ কি হরিশংকর জলদাসকে স্মরণে আনে।
ইঙ্গিতটা আমরা আগেই দিয়ে রেখেছি, ফলত আলোচনা এর বাইরে যাবে না ধরে নেয়া যায়। লেখকের দৃষ্টিগত কিংবা দেখক হিসেবে পরিপার্শ্বকে ট্রিট করার মিমাংসাটুকু আমরা দেখার প্রয়াস পাবো। লোকে বলে, ‘বড়র পিরিত বালির বাঁধ’ এই সত্যের আরেক প্রকাশ ‘আশঙ্কা’ গল্পটি। খুব সম্ভবত এর ভেতর দিয়ে বিগত ক‘বছরে চোখের সামনে দিয়ে ধুম করে এমপি কি মন্ত্রী বনে যাওয়া এবং তাদের অলি-অওলাদদের ততোধিক দ্রুত পরিবর্তনের বিষয়টা সামনে আসে। শেষমেশ এই পরিবর্তনও তো এক সময়ের গভীর প্রেমবোধ থেকে আলাদা করে ডাক্তার রাজন কর্মকার ও তৃঞ্চা চক্রবর্তীকে। লেখক অল্প কথায়, স্বল্প পরিসরে গল্পটি আকর্ষণীয় করে তোলেন। এবং তিনি ভুলতে দেন না এইসব পরিবর্তনে সামিল শরীরি প্রপঞ্চকে। শরীরের লোভ এক অমোঘ ও আদি ব্যাপার হয়ে ছড়িয়ে আছে আমাদের ভেতর। ‘শ্লীলতাহানির পরে’ গল্পটি স্মরণে আনে সোনাগাজীর সেই কুখ্যাত অধ্যক্ষের লালসার শিকার এক অভাগা ছাত্রীর কথা। মনে পড়ে, ব্যাংকেই আমাদের এক কলিগ ক্ষোভের সাথে উচ্চারণ করতেন, ‘স্কুলে পরিমল মাদ্রাসায় সিরাজ, আমার বোনদের নিরাপত্তা কোথায় করে বিরাজ!’ এই ক্ষোভ জন্ম দিয়েছে এই রাষ্ট্রেরই কতিপয় পশু। গল্পকার ঘটনা পরম্পরার এই বিন্যাসে তাই বলতে ছাড়েন না, ‘নওরিন এখন আশঙ্কামুক্ত কিন্তু আতঙ্কমুক্ত নয়…’ কেন? এই প্রশ্ন তুলতে হবে সজোরে। দেখা ও জানার এই পরিধিকে প্রশ্নবানে জর্জরিত করতে হবে আমাদের। কেন, ব্যাঙের ছাতার মতোন এত দাঁড়িয়ে থাকা ক্লিনিকের ভেতরেও ভুল রিপোর্টের ভিকটিম হতে হবে প্রিয়ন্তিদের? তাহলে এত এত বাজেট রাখা সরকারি মেডিকেলদের কী কাজ? ‘নিষ্কৃতি’ গল্পে একজন পিতা রফিকের বিমর্ষ চেহারা যেন বা পুরো দেশের স্বাস্থ্য খাতেরই খতিয়ান। গল্পকার বোধকরি সব ধরনের আয়োজনই রাখতে চেয়েছেন আলোচ্য গল্পগ্রন্থে। ফলে নানা মত ও পথ এখানে এসে মিশেছে অবলীলায়। গল্পকার যা দেখতে পান এমনকি যা দেখতে চান তার কল্পিত মানবিক ভূবনে তাও আঁকতে দ্বিধা করেন না। ‘রোহিঙ্গা’ গল্প এই সময়ে বড় বেশি প্রাসঙ্গিক। একজন সমাজসচেতন লেখক মানবিক বটেই তারও বেশি দেশপ্রেমিক। এজন্যই প্রকৃত সমস্যা তিনি দেখিয়ে দেয় রাষ্ট্রযন্ত্রকে। হায়, রাষ্ট্র তো আর সৃজনকারের কথায় চলে না! ‘মেয়েটি রোদের তলায় একা’ এই সমাজের কমন ভাবনা-বৃত্তের একেবারে বাইরের একটি গল্প। ইতিবাচক মনোভাবের এই ফুল ফুটে থাকুক সর্ব পর্যায়ে। কিন্তু ‘সম্পর্ক’ গল্পটা পড়ে আমরা দুঃখবোধে জারিত হই। মানুষ শেষতক তার আঞ্চলিকতা ডিঙিয়ে উঠতে পারে না ন্যূনতম ব্যতিক্রম বাদ দিয়ে, তা আরও একবার দেখি টীলটীর জীবনে। যৌতুকপ্রথা, ছেলেপক্ষের নাকউঁচু ভাব সবটাই লালন করি আমরা নিজের বেলায়। এমনকি ব্যবসায়ী বলতে যা বুঝি তার সাড়ে পনেরো আনাই যে অসৎ, মুখের ফাঁকা বুলির সাথে তাদের অন্তরের বেমিল খুব সহজেই দেখি আমরা এই গল্পে। পাঠক খেয়াল করবেন নিশ্চয়ই, আয়তন কোনো বিষয় না বরং এক গল্পের ভেতর অনেক গল্প উঁকি দেয় গল্পকারের সুচতুর ইশারায়।
সতেরো গল্পের সমাহার ‘তখনও যায়নি ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ’। নানা মাত্রা ও রঙ এখানে হাত ধরাধরি করে চলে। আকারে নাতিদীর্ঘ, বয়ানে সরল প্রায় গল্পের অন্যতম বৈশিষ্ট। কোনো কোনো গল্প এতই ক্ষীণকায় যে, মনে হবে চিপস খাওয়ার অভিজ্ঞতা। কিন্তু রেশ থেকে যায় মগজে। সময় বড় দামি জিনিস এই বোধে কি তবে গল্পকার জারিত? নাকি অল্প কথায় অধিক কিছু ধরতে চাওয়ার চালাকি এটা? কোথাও সামান্যই মেদবহুল শরীর দৃশ্যমান হয় তবে তা ঝুলে পড়ে না। আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার গল্পকে করেছে আরো কমিউনিকেটিভ, এটা বেশ ইতিবাচক বিষয় বটে। ভাষার অতি কচকচানিবিহীন এই সরল যাত্রা দেবব্রতের গল্পকে দিয়েছে বাড়তি অলংকার। এসবের ভেতর দিয়ে মূলত একজন সমাজমনস্ক গল্পকারের উত্থানকে আমরা দেখি। এই দেখার সাথে সম্পর্ক সমাজের, সময়ের। আরো অধিক কণ্ঠস্বরের মিলিত আয়োজনে দেবব্রত সেনের গল্প হয়ে উঠুক সমাজ দেখার আয়না।
তখনও যায়নি ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ
দেবব্রত সেন
বইমেলা ২০২০, কোরাস
প্রচ্ছদ: রুদ্র ভাস্কর
মূল্য: ১৫০ টাকা