ঐতিহ্যের ঢাকাই মসলিন ফিরিয়ে আনার পথে আরও এক ধাপ এগুলো বাংলাদেশ। বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের গবেষকদল ইতোমধ্যেই তৈরি করেছে মসলিনের ১৯টি কাপড়।
তারা বলছেন, উৎপাদিত এই কাপড়গুলোর সঙ্গে ইংল্যান্ডের ভিক্টোরিয়া এন্ড আলবার্ট মিউজিয়াম এবং বাংলাদেশের জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত মসলিনের মিল রয়েছে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ‘বাংলাদেশের সোনালী ঐতিহ্য মসলিনের সুতা তৈরির প্রযুক্তি ও মসলিন কাপড় পুনরুদ্ধার (১ম পর্যায়)’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় ছয়টি শাড়ি, সাতটি ওড়না ও ছয়টি নমুনা কাপড় তৈরি করা হয়েছে।
আগামী বছরের মাঝামাঝি সাধারণ মানুষের জন্য ঢাকাই মসলিন বাজারে আনতে পারবেন তারা।
মসলিনের সুতা তৈরির প্রযুক্তি ও মসলিন কাপড় পুনরুদ্ধারের জন্য বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডকে আজ মঙ্গলবার জনপ্রশাসন পদক ২০২০ ও ২০২১ প্রদান করা হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক শ্রেণিতে কারিগরি গবেষণা (বিজ্ঞান ভিত্তিক) ক্যাটাগরিতে প্রতিষ্ঠানটি পদক পায়।
২০১৪ সালের অক্টোবরে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় পরিদর্শনের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মসলিনের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার সম্ভাবনা যাচাই করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি বাংলাদেশের কোন কোন এলাকায় মসলিন সুতা তৈরি হতো, তা জেনে সেই প্রযুক্তি উদ্ধার করতে বলেন।
মসলিন পুনরুদ্ধারে পরবর্তীতে বাংলাদেশে তাঁত বোর্ডের চেয়ারম্যানকে আহ্বায়ক করে সাত সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি করা হয়। তারও পরে আরও সাত জনকে কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
ওই কমিটির তত্ত্বাবধানে তাঁতশিল্পীদের সহযোগিতায় এই কাপড়গুলো তৈরি করা হয়। বর্তমানে এগুলো তাঁত বোর্ডের প্রজেক্ট অফিসে সংরক্ষিত আছে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, ফুটি কার্পাস তুলা মসলিন তৈরির প্রধান উপকরণ। সেটি থেকে হাতে তৈরি পিটতাঁতে সুতা তৈরি করতে হয়। সেজন্য শুরুতে ছয় জন ‘সুতা কাটুনী’কে প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করা হয়। বর্তমানে এই সংখ্যা ৭৫। তারা ২০০ থেকে সর্বোচ্চ ৫৫৭ মেট্রিক কাউন্টের সুতা তৈরি করতে পারছেন, যেটিকে তারা মসলিনের জন্য আদর্শ মনে করছেন।
জুলাই ২০১৮ থেকে জুন ২০২১ সাল মেয়াদে নেওয়া এই প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল ১২ কোটি ১০ লাখ টাকা। তবে মেয়াদ শেষে খরচ হয়েছে মাত্র ৩ কোটি ৯২ লাখ টাকা।
প্রকল্প পরিচালক বাংলাদেশে তাঁত বোর্ডের প্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা আয়ুব আলী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘প্রকল্পের কাজ শুরু করার পর ফুটি কার্পাস তুলা থেকে হ্যান্ড স্পিনিংয়ের মাধ্যমে সুতা তৈরি থেকে কাপড় উৎপাদন পর্যন্ত সাতটি ধাপ পার হতে হয়েছে। কঠিন বিভিন্ন উৎস থেকে গবেষণা তথ্য ব্যবহার করে এই সফলতা এসেছে।’
প্রাচীন ও মধ্যযুগে ঢাকার বয়ন শিল্পীদের হাতে তৈরি মসলিন কাপড় হয়ে উঠেছিল বিশ্বের ধনী ও অভিজাত শ্রেণির মর্যাদার প্রতীক। ১৭৪৭ সালে মাত্র এক বছরে মোট ২৮ লাখ ৫০ হাজার টাকার ঢাকাই মসলিন রপ্তানি হয়েছিল বলে জানতে পেরেছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।
তারা জানিয়েছেন, মোঘল রাজশক্তির পতন, ব্রিটিশ শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতার অভাব, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আধিপত্য, ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লব, ঢাকাই মসলিনের ওপর উচ্চহারে কর আরোপ, তাঁতি/কারিগরদের আঙ্গুল কর্তনসহ বিভিন্ন কারণে ১৯ শতকের মাঝামাঝি সময়ে এসে ঢাকাই মসলিন উৎপাদন সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে যায়।
জনপ্রশাসন পদক প্রদান উপলক্ষে আজ এক অনুষ্ঠানে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী বলেন, ব্যাপক অনুসন্ধান ও গবেষণার মাধ্যমে মসলিনের কাঁচামাল ফুটি কার্পাস খুঁজে বের করা, ফুটি কার্পাসের চাষাবাদ, সুতা উৎপাদন, কারিগরদের দক্ষতা উন্নয়ন করে উন্নতমানের মসলিন উৎপাদন করা সম্ভব হয়েছে। মসলিনের ভৌগোলিক নির্দেশক নিবন্ধন সনদ (জিআই) ও পেটেন্ট অর্জিত হওয়ায় দেশের তাঁতশিল্পের টেকসই উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে।
তিনি বলেন, ঐতিহ্যবাহী ঢাকাই মসলিন রপ্তানি করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হবে এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে।
সূত্র : দ্য ডেইলি স্টার