মোহীত উল আলম »
ষাটের দশকের মাঝামাঝি। আমাদের কাজীর দেউড়ির বাসা থেকে চিটাগাং কলেজিয়েট স্কুল বেশ দূরে। বাবা গুণে গুণে দিতেন তিন আনা। এক আনা যাওয়ার বাস ভাড়া, এক আনা আসার বাস ভাড়া, আর এক আনা খাওয়ার। যথারীতি এক আনার জায়গায় দুই আনাই খেয়ে ফেলতাম। ঝালমুড়ি, কিংবা কুলফি বরফ, লাল বা কমলা বা সবুজ রং ছিটান। আসতাম হেঁটে। সবদিন নয়, কোন কোন দিন। পুরোনো বিমান অফিসের উল্টো দিকে, এখন যেখানে সুইমিং পুলটা হয়েছে, সেখানে ছিল একটা বিরাট বট গাছ। এই বটগাছের তলায় প্রতি বিকেলেই কোন না কোন ক্যানভাসার এবং তার সহযোগীরা নানান রকমের ওষুধ বিক্রির আয়োজন করে নানান তামাশা করত, ওষুধ বিক্রির জন্য গানবাজনার সমাবেশ করত। ক্যানভাসার মাঝখানে থাকত, আর তার চার পাশে লোকের ভিড়। আমি স্কুল থেকে ফেরার পথে কোন কোনদিন সাথে সঙ্গী থাকত, কোন কোনদিন থাকত না। কিন্তু আমার প্রচ- লোভ হতো ঐ ক্যানভাসারের ওষুধ বিক্রির চেষ্টা দেখার। কিন্তু নিতান্তই কিশোর ছিলাম বলে ভয় পেতাম। বাবা-মা’র দেয়া অদৃশ্য বারণ কাজ করত, সন্ধ্যার আগে অবশ্যই বাসায় ফিরতে হবে। কিন্তু একদিন ঠিকই লোভ সামলাতে পারলাম না। ভিড়ের মধ্যে ঢুকে গেলাম। দেখি কি, সাধারণ গোছের একটা লোক হাফ হাতা শার্ট গায়ে আর পরনে লুঙ্গি, একটা চোঙা হাতে নিয়ে তার ওষুধের গুণের বয়ান করছে। তখন বুঝতে পারিনি, এখন বুঝতে পারি, বেশির ভাগ ওষুধ ছিল পুরুষের শক্তিবর্ধক ওষুধ। তবে যেখানে আমার চোখ গেল, দেখলাম মাটির ওপর গিরগিটির মতো দুটো বিশালকায় টিকটিকি, আর পাশের ছোট্ট একটা টেবিলে চার চারটে মুরগীর ডিম রাখা। লোকটা গিরগিটিগুলোকে বলছে স্যান্ডা, আর স্যান্ডার তেল সে শিশি ভরে বিক্রির চেষ্টায় রত। ওই চোঙা দিয়ে সে জোরে জোরে বলছিল, একবার মালিশ করলেই ফল পাবেন। এমনি দাম এত, তবে তার কাছে কম দামে পাওয়া যাচ্ছে, এবং বিফলে মূল্য ফেরত। কিন্তু আসল আকর্ষণ সে ধরে রাখল অন্য জায়গায়। সেটা কী? ঐ যে মুরগির ডিম চারটা রাখা আছে, সে একটা একটা ডিম হাতে নেয়, বিকেলে হেলানো সূর্যের আলোর বিপরীতে একটুক্ষণ ধরে বলে, জনাব, এই ডিমটা ঠিক আছে, সন্ধ্যা লাগতে না লাগতেই ডিম ফুটে বাচ্চা বের হবে। আরেকটা নেয়, সেটাও রোদের বিপরীতে পরখ করে দেখে, এবং একই কথা বলে, জনাব, এটারও সময় হয়ে এসেছে, একটু পরেই এটা ফুটেও বাচ্চা বের হবে। আবার সে স্যান্ডার তেল বিক্রিতে মনোযোগ দেয়। প্রথম দিকে না হলেও আস্তে আস্তে ভিড়ের মধ্যে থেকে দু’একজন করে তার শিশি কিনতে লাগল। তার সহযোগী এক একটা শিশি বের করে ঝুড়ি থেকে আর সে বিক্রি করে টাকা পকেটে গোঁজে। আবার ডিমগুলির কাছে যায়, ডিমগুলি পরখ করে দেখে একে একে, আবার বলে, সময় হয়ে এসেছে, একটু পরেই ডিম ফুটে বাচ্চা বের হবে।
অন্যদের কথা জানি না, আমি, বড়দের মধ্যে সম্ভবত একমাত্র কিশোর, আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছি, কখন ডিম ফুটে বাচ্চা বের হবে। আর এদিকে সূর্য প্রায় ডুবে যাচ্ছে। এম এ আজিজ স্টেডিয়ামের (তখন নিয়াজ স্টেডিয়াম) পেছনে সূর্য আড়াল পড়ে গেল। সন্ধ্যা লাগছে প্রায়, কিন্তু লোকটা আর ডিমের দিকে যায় না। আমি ডিমগুলোর দিকে তাকিয়ে আছি, কখন বাচ্চা ডিম ফুটে বের হবে। সন্ধ্যা লাগল (এখন যেমন মাগরিব লাগলেই চারদিক থেকে আজান শোনা যায়, তখন সে ব্যবস্থা ছিল না।), আর লোকটা হঠাৎ ডিমগুলি ঝুড়ির ভিতর ভরতে ভরতে বলল, জনাব, আরেকটু হলেই ডিম ফুটতো, কিন্তু সন্ধ্যা হয়ে গেছে, আপনাদের পরিবার পরিজনেরা অপেক্ষা করছে, আজকে ফিরে যান, কালকে আবার এখানে আসব, আপনারাও আসেন, কালকে বাচ্চা ফোটাব। এ বলে গলায় হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে সে একটা গান ধরল। তার সহযোগীও গাইল। আর আমি হতশ্বাস হয়ে বাসার দিকে লম্বা দৌড়।
স্কুল জীবনের এই অভিজ্ঞতা আমার মনে আজকে এল সকালবেলায় বেলা মিরাবেলার একটি প্রবন্ধ পড়ে। শেক্সপিয়ারের অন্যতম খলনায়ক ইয়াগোর চরিত্রের ওপর আলোকপাত করতে গিয়ে এই প্রবন্ধকার বলছেন যে লন্ডন শহরের রাস্তায় এই ওষুধবিক্রেতা ক্যানভাসাররা গিজগিজ করত। এদেরকে ইংরেজিতে বলে মাউন্টিব্যাংক। তারা অতি চমৎকারভাবে ভাষাকে ব্যবহার করে তাদের পণ্য বিক্রি করত, যার বেশির ভাগই ছিল নকল। কিন্তু কথার যাদুতে বশ করে ক্রেতাদের কাছে পণ্য বিক্রি করার এই কৌশলটি বেলা মিরাবেলার মতে শেক্সপিয়ার তাঁর চরিত্র ইয়াগোর মধ্যে প্রতিস্থাপিত করেন। (যাঁরা আমার ফেইসবুক পেইজ “শেক্সপিয়ার, মাই লাভ”-এর সঙ্গে পরিচিত তাঁরা নিশ্চয় দেখেছেন যে আমি এই প্রবন্ধটার ওপর একটি প্রশংসামূলক অভিমত দিয়েছি আজকে।)
এখন আমি যে ভাবনা থেকে এই আলোচনাটি করছি সেটি হলো আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে যে ধরনের একটি পরিস্থিতি তৈরি হয়ে গেছে, তাতে আমি বেলা মিরাবেলার প্রবন্ধ থেকে উসকানি পেয়ে আমার দেখা ঐ প্রবঞ্চক ক্যানভাসারের ডিম ফুটিয়ে বাচ্চা বের করার সঙ্গে এখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতির যেন একটা মিল খুঁজে পাচ্ছি।
সেটা কীরকম? দেখুন, তুলনাটা খুব সহজ। ‘ডিম ফুটে বাচ্চা বের হবে’ এর সঙ্গে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিময় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে কিনা এই সংশয়ের সঙ্গে সাযুজ্য আছে। নির্বাচন অবশ্যই অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিময় হবে এই প্রত্যয় যাঁরা দিচ্ছেন, তাঁদের সঙ্গে আমার কৈশোরকালীন দেখা ক্যানভাসারের ডিম ফুটে বাচ্চা বের হবে সে প্রত্যয়ের সঙ্গে মিল আছে। আবার যাঁরা নির্বাচন আদৌ অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিময় হবে কিনা সে সংশয়ের সঙ্গে সেই বটতলায় জমায়েত হওয়া দর্শকবৃন্দের মিল আছে। যারা ক্যানভাসারের পেশার মধ্যে যে ফাঁকি আছে, তার মধ্যে যে জিব এবং মনের ফারাক আছে, অর্থাৎ সে যা বলে তা বোঝায় না, এবং তার কথার যাদু বা চাতুরিতে যারা পা দেবে না, তারা হচ্ছে সে দর্শকবৃন্দ বা জনগণের অংশ যারা বাংলাদেশে কখনও অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিময় নির্বাচন হতে পারে বলে বিশ্বাস করে না।
কিন্তু ক্যানভাসারের পেশাতো শেষ হয়ে যায়নি। এখনও হাটে-মাঠে, গ্রামে-বন্দরে, ট্রেনে, বাসে, ফেরিতে, জলযানে এই পেশার লোকজন টিকে আছে, যার অর্থ হচ্ছে তাদের ব্যবসাটা চলছে। লোক-ঠকানির ব্যবসা সম্ভবত মানবসভ্যতায় সবচেয়ে প্রাচীন এবং সফল ব্যবসা। বেশিদূর যেতে হচ্ছে না। টিভিতে কালকে (১৬/৭/২৩) বাংলাদেশ আফগানিস্তানের টি২০ দ্বিতীয় এবং ফাইন্যাল ম্যাচ দেখার সময় একটি চমৎকার বিজ্ঞাপনে দেখাচ্ছিল কীভাবে একটি স্প্রে দিয়ে মোটেও মশা মারা পড়ছিল না, তখন বিজ্ঞাপিত স্প্রেটি দেবার সাথে সাথে সব মশাই মারা পড়ল ঘরের ভিতরে আর বাইরের মশা আর ঘরেই ঢুকল না। বিজ্ঞাপনটির মাজেজাই হলো যে বিজ্ঞাপিত স্প্রেটি সবচেয়ে ভালো, আর অন্য সব স্প্রেটি খারাপ।
বিজ্ঞাপনের এই ভাষার সঙ্গে রাস্তার ক্যানভাসারের ভাষার কোন পার্থক্য নেই। আসন্ন নির্বাচনের প্রচার প্রচারণার ভাষার সঙ্গেও যথেষ্ট সাযুজ্য দেখতে পাই। অর্থাৎ আমার পণ্যই শ্রেষ্ঠ।
অর্থাৎ, আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিময় হবে এই প্রতিশ্রুতিশীল বাক্যাবলিকে আমরা যদি ক্যানভাসারের পণ্য বিক্রির তাগিদের সঙ্গে তুলনা করি, তা হলে বুঝতে পারব যে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিময় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এই ধারণাটি জিনিস বিক্রির মতো শুধু দেশে নয় বিদেশেও বিক্রি করতে হবে। যদিও তুলনাটা খানিকটা অসংগতিপূর্ণ, কিন্তু পণ্য বিক্রির মতো আইডিয়া গছিয়ে দেওয়া, পণ্য বিক্রি করারই সামিল। অর্থাৎ, ডিম ফুটে বাচ্চা বের হবেই- এই প্রত্যয়টি লোকের মনে স্থায়ী করতে হবে।
বাংলাদেশের নির্বাচন কীভাবে হবে, কারা করবে, কারা করবে না, এগুলি একান্তই বাংলাদেশের নিজস্ব ব্যাপার। কিন্তু ব্যাপারটা অত সহজ না, কারণ আধুনিক বিশ্বে বাংলাদেশ নানানভাবে নানান বিশ্ব নেটওয়ার্কিংয়ের সঙ্গে জড়িত। কেন জানি না, আমেরিকা, রাশিয়া, চীন এই তিন পরাশক্তি এবং প্রতিবেশী শক্তিশালী দেশ ভারত, এবং মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামী দেশগুলো এবার নানান ভূ-রাজনৈতিক পারষ্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট কারণে বাংলাদেশের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে প্রখর মনোযোগ দেখাচ্ছে।
ক্যানভাসারের পরিপ্রেক্ষিত অনুযায়ী এই বিদেশি শক্তিগুলো হলো দর্শকবৃন্দের মধ্যে তারাই যারা ক্যাভাসারের ডিম থেকে বাচ্চা ফুটানোর ব্যাপারে আগ্রহী নয়, যারা হয়ত ক্যানভাসারের কাছে গোপনে অর্থ লগ্নি করে রেখেছে যে ডিম ফুটে বাচ্চা বের হবে এই কথা বলে বলে ব্যবসাটা কেমন জমে, তা দেখতে।
তবে ক্যানভাসারের পেশার যেমন ঘাটতি পড়ে না, তেমনি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতেও বাধা থাকবে না। ক্যানভাসারের ওষুধে সামান্য স্বাস্থ্যহানির আভাস থাকতে পারে, কিন্তু নির্বাচন উপলক্ষে সংঘাত, হানাহানি, লোকক্ষয় ইত্যাদি না হবার জন্য সব পক্ষকেই সচেষ্ট হতে হবে।
একবার কেন আমরা বিশ্বাস করি না যে এবার ডিম ফুটে বাচ্চা বের হবেই!
লেখক: শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক