শিপন মহাজন, হরে আমাত চৌধুরী রামিসা, ইমতাহা হক রিয়া, অপিতা দেববর্মন, সামিয়া জাকের মৃণা, সৈয়দা ফাইবুষ আতিয়া নূর আমিরী, আলিশা মহিম মারুমা, নওশিন আক্তার সাথিয়া ও সন্দীপণ দে »
বর্তমান ডিজিটাল যুগে ব্যবসায়িক কার্যক্রমের বড় একটি অংশ অনলাইনের উপর নির্ভরশীল। ই- কমার্স, অনলাইন ব্যাংকিং, ডিজিটাল লেনদেন, তথ্য সংরক্ষণ থেকে শুরু করে যোগাযোগ-সব কিছুতেই প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে। কিন্তু এই সুযোগের পাশাপাশি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো অনেক সময় অনেক বড় হমকির সম্মুখীন হয় একমাত্র সাইবার ক্রাইমের মাধ্যমে। হ্যাকিং, ফিশিং, তথ্য চুরি, ভুয়া লেনদেন আজকের দিনে ব্যবসায় জগতের জন্য এক ভয়াবহ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাইবার অপরাধ কেবল আর্থিক ক্ষতিই করে না, বরং গ্রাহকের আস্থা ও প্রতিষ্ঠানের সুনামও নষ্ট করে দেয়। তাই ব্যবসায়ে টিকে থাকার জন্য সাইবার ক্রাইম প্রতিরোধ এখন একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ।
সাইবার পলিসি বলতে একটি সরকার ও বিভিন্ন সংস্থা কর্তৃক প্রদত্ত এমন বিধিমালা যা ডিজিটাল তথ্য, নেটওয়ার্ক এবং সিস্টেমকে সাইবার হুমকি ও অপব্যবহার থেকে রক্ষা করে। সাইবার পলিসির উদ্দেশ্য হলো সাইবার অপরাধ প্রতিরোধ করা, ডেটার গোপনীয়তা ও সুরক্ষা এবং ডিজিটাল কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করা। ব্যবসায়ে এসব সমস্যা নিরসনের জন্য সাইবার পলিসি একটি দিকনির্দেশনা হিসেবে কাজ করে। বাংলাদেশ ক্রমাগত এবং প্রতিনিয়ত সাইবার হমকির সম্মুখীন হচ্ছে। গড়ে, বাংলাদেশী ব্যাংকগুলি প্রতিবছর প্রায় ৬৩০টি সাইবার হামলার সম্মুখীন হয়। প্রায় শতকরা ৪০% ব্যবসা প্রতিষ্ঠান অন্যান্য দেশের মতো সাইবার নিরাপত্তাকে গুরুত্বের সাথে নেয় না। অনেক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান গ্রাহকদের কাছ থেকে পণ্য সরবরাহের কথা বলে অর্থ নিয়ে নেয় কিন্তু পণ্য সরবরাহ করে না, যা সরাসরি প্রতারণা। বাজারমূল্যের চেয়ে অনেক বেশি ছাড় দিয়ে পণ্য বিক্রি করে গ্রাহকদের আকৃষ্ট করা এবং পরে তাদের সেই অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনাও ঘটে। ভুয়া বা চুরি করা ব্যাংকিং কার্ড ব্যবহার করে টাকা উত্তোলন/লেনদেন। কার্ডের নম্বর, পিন, ঙঞচ ইত্যাদি অবৈধভাবে সংগ্রহ করা। আসল কার্ডের তথ্য ব্যবহার করে নকল কার্ড তৈরি করা। উদাহারন হিসেবে ইভ্যালির কথা বলা যায়। ঊাধষু ছিল বাংলাদেশের সবচেয়ে আলোচিত ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মগুলোর একটি। এটি বাজারমূল্যের চেয়ে ৩০%-৫০% পর্যন্ত ছাড় ঘোষণা করত। অথচ, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিপোর্টে দেখা যায়, ঊাধষু গ্রাহক ও মার্চেন্টদের কাছ থেকে প্রায় ৪,০০০ কোটি টাকা অগ্রিম নিয়েছিল। কিন্তু তাদের কাছে সম্পদ ছিল মাত্র ৬৫ কোটি টাকার মতো।
দ্বিতীয় উদাহারণ হিসেবে অষবংযধ গধৎঃ’র কথা বলা যায়। এই প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ১.৩৯ কোটি টাকা গ্রাহকের কাছ থেকে নিয়ে ও প্রতিশ্রুত অনুযায়ী পণ্য সরবরাহ করেনি। একাধিক ব্যাংকের গ্রাহকের ডেবিট কার্ড ক্লোন করে প্রতারণামূলকভাবে টাকা তোলা হয়। পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিট কয়েকজন বিদেশি নাগরিককে গ্রেপ্তার করে।
ডিজিটাল বিজনেস হলো এমন একটি ব্যবসায়িক পদ্ধতি যা ডিজিটাল প্রযুক্তি যেমন কম্পিউটার, মোবাইল, ইন্টারনেটের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। এটি পণ্য বা সেবা প্রদান, ক্রয়, বিক্রয় সহ ব্যবসার বিভিন্ন কার্যাদি সম্পন্ন করতে ডিজিটাল মাধ্যমের উপর নির্ভর করে। এ মডেলটি পুরোপুরি অনলাইন নির্ভর এবং নেটওয়ার্কের ভিত্তিতে চলে যা ব্যবসার পরিধি বাড়াতে এবং সেবা সারাবিশ্বে গ্রাহকদের দ্বারে দ্বারে ভার্চুয়ালি পৌঁছাতে সহায়তা করে। বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহার শুরু হয় ১৯৯৩ থেকে এবং ডিজিটাল বিজনেসের বিশেষ করে ই-কমার্স সূচনা হয়েছে ২০০০ সালের ১০ জানুয়ারি, যখন দেশের প্রথম ই-কমার্স ওয়েবসাইট মুন্সিজি ডট কম চালু হয় এবং ২০০৫ সালে ঈষরপশইউ.পড়স-এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলো ই-কমার্স শুরু করলেও, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ফেসবুক ও অন্যান্য অনলাইন প্ল্যাটফর্ম (যেমন: দারাজ, প্রিয়শপ, চালডাল ইত্যাদি) মাধ্যমে ছোট বড় উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহণে এটি দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
বাংলাদেশে ডিজিটাল বিজনেস বা অনলাইন ব্যবসার জনপ্রিয়তা ২০২০ সালের পর ব্যাপক পরিসরে বৃদ্ধি পায়। অতপর: ফিনটেক/ ডিজিটাল পেমেন্ট (নগদ, বিকাশ, রকেট, উপায় ইত্যাদি) প্ল্যাটফর্মের প্রচলন বৃদ্ধি পায় প্রধানত মোবাইল ব্যাংকিং ব্যাবহারের মাধ্যামে। যখন ২০০০ এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে এসে ডাচ-বাংলা ব্যাংক প্রথম মোবাইল ব্যাংকিং সেবা চালু করে, তখন থেকে এর বিস্তৃতি আরো বাড়তে থাকে। সময়ের ধারাবাহিকতায় এখন ডিজিটাল ব্যবসার অবস্থা অনুকূল, যেখানে ই-কমার্স দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং লক্ষ লক্ষ মানুষ অনলাইন ব্যবসার সাথে যুক্ত হচ্ছে যার মধ্যে নারী উদ্যোক্তারাও উল্লেখযোগ্য। কোভিড-১৯ মহামারীর পর থেকে প্রায় ২ লাখের বেশি ফেসবুক ভিত্তিক অনলাইন ব্যবসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রায় ২০-২৫ লক্ষ মানুষ সরাসরি বা পরোক্ষভাবে ই-কমার্স খাতের সাথে যুক্ত। এছাড়াও, ৫০ হাজারের বেশি নারী উদ্যোক্তা অনলাইন ব্যবসায় সক্রিয়ভাবে কাজ করছেন, আইসিটি ডিভিশনের সহায়তায় অনেক স্টার্টআপ গড়ে উঠেছে (পাঠাও, সহজ, সেবা ইত্যাদি), যা ব্যবসার সুযোগ বাড়িয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিপোর্ট অনুযায়ী, দেশের ৯০-৯৫% লেনদেন এখন ডিজিটাল মাধ্যমে হচ্ছে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি, নারী ক্ষমতায়ন, এবং ছোট-বড় উদ্যোক্তাদের জন্য সুযোগ তৈরি হওয়ায় ই-কমার্স দেশের ডিজিটাল অর্থনীতিতে অপরিহার্য ভূমিকা রাখছে।
সাইবার সিকিউরিটি পলিসি হল একটি প্রতিষ্ঠানের দ্বারা তৈরি করা নীতিমালা যা তথ্য সুরক্ষা এবং সাইবার নিরাপত্তার উদ্দেশ্যে নির্দেশনা দেয়। ব্যবসায়ে সাইবার পলিসি বলতে কিছু দিকনির্দেশনাকে বুঝায় যা ব্যবসায়ের অনলাইন কার্যক্রম পরিচালনায় রোড ম্যাপ হিসেবে কাজ করে এবং যা অনুসরণ করার মাধ্যমে ব্যবসায়ে সাইবার আক্রমণ সংক্রান্ত ঝুঁকি অনেকাংশে কমে।
ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে যেসব সাইবার পলিসি নেওয়া উচিত তা হলো:কে কোন ডাটা বা সিস্টেম ব্যবহার করতে পারবে তা নির্ধারণ করা। শক্তিশালী পাসওয়ার্ড ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা। ডাটা সুরক্ষা ও গোপনীয়তা নীতি গুরুত্বপূর্ণ ডাটাকে ঊহপৎুঢ়ঃ করা। ইমেইল স্প্যাম ও ফিশিং প্রতিরোধের জন্য ফিল্টার ব্যবহার। অফিস নেটওয়ার্কে অনিরাপদ ওয়েবসাইটে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা। হ্যাকিং, ডাটা ব্রিচ, বা র যানসমওয়্যার হলে কীভাবে তা মোকাবিলা করা হবে তার লিখিত পরিকল্পনা। কর্মীরা নিজের ডিভাইস দিয়ে কাজ করলে সেগুলোতে অ্যান্টিভাইরাস ও ঠচঘ ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক আইন (যেমন: এউচজ, উরমরঃধষ ঝবপঁৎরঃু অপঃ ইত্যাদি) অনুযায়ী সিকিউরিটি ব্যবস্থা রাখা। সর্বোপরি বলা যায় যে, ব্যবসা খাতে সাইবার সুরক্ষার জন্য একটি জাতীয় সাইবার ব্যবসায়ী নীতি প্রনয়ন করতে হবে, যে নীতিতে ডেটা সংরক্ষণ, অনলাইন লেনদেন নিরাপত্তা, ডিজিটাল পরিচয় যাচাই, অপরাধ দমন ব্যবস্থা থাকবে। ছোট ও বড় উদ্যোক্তাদের জন্য সহজলভ্য সাইবার নিরাপত্তা গাইডলাইন প্রনয়ণ করতে হবে। তাদের সঠিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে গ্রাহকদের আস্থাশীল প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠতে হবে। উদ্যোক্তাদের জন্য সাইবার সাপোর্ট সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। সাইবার প্রতারণা (ভুয়া ওয়েবসাইট, ফিশিং, ভুয়া অফার) থেকে গ্রাহকদের রক্ষার্থে ক্যাম্পেইন করে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের জন্য বছরর একবার সাইবার নিরাপত্তা অডিট বাধ্যতামূলক করা উচিত, যার ফলে দূর্বলতা শনাক্ত করে দ্রুত সমাধান করা যেতে পারে।
ব্যবসার দ্রুত অগ্রগতি হলেও সাইবার নিরাপত্তাহীনতা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে ই-কমার্স, ফিনটেক এবং মোবাইল ব্যাংকিং খাতের দ্রুত বৃদ্ধি অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও হ্যাকিং, চিটিং, তথ্য চুরি এবং ভুয়া লেনদেনের মতো সাইবার অপরাধ পর্যায়ক্রমে ব্যবসায়িক আস্থা ও গ্রাহক সুরক্ষাকে হুমকির মুখে ফেলছে। ঊাধষু অষবংযধ গধৎঃ-এর মতো ঘটনার মাধ্যমে বোঝা যায়, সঠিক সাইবার পলিসি ও কার্যকর পর্যবেক্ষনের অভাব আছে বলেই গ্রাহক ও উদ্যোক্তা উভয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাই ব্যবসার দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়ন নিশ্চিত করতে সাইবার সুরক্ষা নীতি কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা, ডিজিটাল পেমেন্টে সুরক্ষা বৃদ্ধি, ক্রেডিট কার্ড ফ্রড নিরসন এবং জনসচেতনতা গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি। উপযুক্ত নীতিমালা ও প্রযুক্তির সঠিক প্রয়োগই ডিজিটাল ব্যবসাকে নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য করে তুলতে পারে।” এসব পদক্ষেপ শুধুমাত্র অর্থনীতিকে শক্তিশালী করবে না, বরং বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশকে আরও এগিয়ে নিতে সহায়তা করবে।
লেখকবৃন্দ : আইন অনুষদ শিক্ষার্থীবৃন্দ, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়।