ষোলশহর বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের ডানকান হিল কেটে ২৫ তলার দুই টাওয়ার নির্মাণের আয়োজন করেছে স্যানমার! নগরীর অন্যতম খ্যাতনামা আবাসন কোম্পানি সানমার প্রপার্টিজ এই টাওয়ার নির্মাণের জন্য ইতোমধ্যে শতাধিক গাছ সাবাড় করেছে, আরো গাছ কাটার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। পাহাড়ের পাদদেশে মাটি কেটে চলছে নির্মাণ প্রক্রিয়া। অথচ গাছ কাটার জন্য বন বিভাগ থেকে কোনো অনুমোদন নেয়া হয়নি এবং পাহাড়ে বহুতল ভবন নির্মাণের জন্য পরিবেশ অধিদপ্তর থেকেও কোনো ছাড়পত্র নেয়া হয়নি।
ষোলশহর বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের আওতাধীন জীববৈচিত্র্যগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ পাহাড়ি এলাকাটি এখন ন্যাড়া পাহাড়ে পরিণত হয়েছে। গতকাল শনিবার এলাকার ডানকান হিলে গিয়ে দেখা যায় বেষ্টনী দিয়ে পাহাড়ের পাদদেশে নির্মাণ কাজ করছে শ্রমিকরা। প্রায় ৩০০ ফুট উঁচূ পাহাড় চূড়ায় উঠে দেখা যায়, পাহাড়ের ঢালের গাছগুলো কাটা হচ্ছে। বিভিন্ন জাতের এসব গাছ অনেক পুরনো। আর পাহাড়ের নিচের অংশে নির্মাণ কাজ করছে শ্রমিকদের অপর একটি দল।
পাহাড়ে গাছ কাটার ছবি তুলতে গেলে বাধা দেন সানমারের সাইট ইঞ্জিনিয়ার এস রাহমান। জানতে চাইলে এই কর্মকর্তা বলেন, পাহাড়ের নিচে ও উপরে দুটি টাওয়ার নির্মাণ করা হবে। সেজন্য আমরা প্রাথমিকভাবে কাজ শুরু করেছি। আপনারা ছবি না তুলে আমাদের স্যারদের সাথে কথা বলেন।
এসময় সাইট ইঞ্জিনিয়ার তার উর্ধতন কর্মকর্তাদের অবহিত করলে ফোন করেন সানমারের হেড অফ অপারেশন এ কে এম আহসানুল বারী। তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমরা কোনো কাজ করছি না। আপনার কোনো জিজ্ঞাসা থাকলে অফিসে এসে কথা বলেন।’
প্রকল্পটি চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) থেকে অনুমোদন পেয়েছে কি-না এ কে এম আহসানুল বারীর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অনুমোদনের বিষয়টি আমি অবগত নই। আপনি আমাদের হেড অব সেলস মাহফুজুল বারী সাহেবের সাথে কথা বলেন।’ এই বলে তিনি মোবাইল ফোন মাহফুজুল বারীকে দেন। মাহফুজুল বারী বলেন, ‘স্যানমারের অসংখ্য প্রকল্প রয়েছে তাই প্রকল্পটি সিডিএ’র অনুমোদন পেয়েছে কিনা তা সঠিকভাবে এখনই বলা যাচ্ছে না। ফাইল দেখে বলতে হবে।’
পাহাড় চূড়ায় বিশেষ এই প্রকল্পটি অনেক প্রকল্পের মধ্যে ব্যতিক্রম, তাই এই প্রকল্পের অনুমোদনের বিষয়টি জানা প্রয়োজন। এই প্রশ্নের জবাবে মাহফুজুল বারী বলেন, ‘আমরা এখনো এই প্রকল্পের কাজ শুরু করিনি। এখনো প্রক্রিয়া সম্পাদন করতে বছর দেড়েক সময় লাগবে।’
কিন্তু প্রক্রিয়া শুরু না করলে গাছ কেন কাটছেন? এমন প্রশ্ন করা হলে এ কে এম আহসানুল বারী বলেন, ‘আমরা প্রকল্প এলাকায় কিছুই করছি না।’
সিডিএ সূত্রে জানা যায়, ডানকান হিলে ২৫ তলা ভবনের অনুমোদন দিয়েছিল নগর উন্নয়ন কমিটি। তবে ২০১৩ সালের দিকে দেওয়া সেই অনুমোদন ইতিমধ্যে বাতিল হয়ে গেছে। অনুমোদনে তিন বছরের মধ্যে কাজ শুরু করার শর্ত থাকে। সিডিএ’র প্রধান প্রকৌশলী ও নগর উন্নয়ন কমিটির সদস্য সচিব কাজী হাসান বিন শামস জানান, ‘তিন বছরের মধ্যে কাজ শুরু না করলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে অনুমোদন বাতিল হয়ে যায়।’
কিন্তু পাহাড় চূড়ায় এই ভবনের অনুমোদন কীভাবে পেল এমন প্রশ্নের জবাবে সিডিএ’র প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি শাহীনুল ইসলাম খান বলেন, ‘নগর উন্নয়ন কমিটি ২৫ তলার দুই ভবনের অনুমোদন দিয়েছে। তবে এই দুই ভবনের কারণে এলাকার পরিবেশ ও প্রতিবেশগত অবস্থা শঙ্কটাপন্ন হবে।’ পরিবেশ অধিদপ্তরের বক্তব্য
জানা যায়, গত ২৯ সেপ্টেম্বর বন গবেষণা ইনস্টিটিউট এলাকার ২৪ জন বাসিন্দা পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালকের কাছে স্যানমারের বিরুদ্ধে পাহাড় কাটার অভিযোগ করে। তাদের অভিযোগের ভিত্তিতে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মহানগরের উপ-পরিচালক মিয়া মাহমুদুল হক প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করেন। তিনি কী দেখেছেন জানতে চাইলে মিয়া মাহমুদুল হক বলেন, ‘পাহাড়ের এই জায়গাটি জীববৈচিত্র্যগতভাবে খুবই সমৃদ্ধ এলাকা ছিল। কিন্তু তারা এখানকার গাছগুলো কেটে পাহাড়টিকে নষ্ট করেছে। এই স্থানে তারা (স্যানমার) দুটি বহুতল ভবন নির্মাণ করবে। কিন্তু ভবন নির্মাণের জন্য পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে কোনো অনুমোদন বা ছাড়পত্র নেয়নি। পাহাড় কাটার প্রাথমিক ধাপ হিসেবে তারা গাছগুলো কেটেছে। এজন্য তাদেরকে শুনানির জন্য ডাকা হয়েছে। আগামীকাল (আজ) ১৮ অক্টোবর শুনানি ছিল, কিন্তু আমাদের পরিচালক স্যার অসুস্থ থাকায় এই শুনানিটি পরে নির্ধারণ হবে।’
এবিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মহানগরের পরিচালক মোহাম্মদ নুরুল্লাহ নূরী বলেন,‘পাহাড়ে কোনো স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে না। পাহাড়ে স্থাপনা নির্মাণ করতে গেলে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে ছাড়পত্র নিতে হবে। স্যানমার এখনো সেই ছাড়পত্র পায়নি। আর অনুমোদনের আগে নির্মাণ কাজ শুরু করতে পারবে না। অপরদিকে গাছ কাটার বিষয়টি বন বিভাগের বিবেচ্য বিষয়।’
বন বিভাগের বক্তব্য
নগরে কোনো বৃক্ষ নিধন করতে হলে বন বিভাগ থেকে অনুমোদন নিতে হয়। কিন্তু বন ষোলশহর গবেষণাগারের ভেতরে ডানকান হিলে গাছ কাটার বিষয়ে বন বিভাগের কোনো অনুমোদন রয়েছে কিনা জানতে চাইলে চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা বখতেয়ার নূর সিদ্দিকী বলেন, ‘এক বা দুটি গাছ কাটলে আমরা সাধারণত তেমন কিছু বলি না। কিন্তু কেউ যদি বেশি গাছ কাটে তখন অবশ্যই আমাদের কাছ থেকে অনুমোদন নিতে হয় এবং এর সঠিক কারণ অবহিত করতে হয়। তবে স্যানমার আমাদের কাছ থেকে কোনো অনুমোদন নেয়নি। এজন্য তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার জন্য প্রকল্প এলাকাটি পরিদর্শনে যাওয়া হবে।’
উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম অঞ্চলের পাহাড়গুলো একে একে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। ষোলশহর বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের এই পাহাড়ি এলাকায় অনেক বৃক্ষ রয়েছে। এগুলোতে অনেক পাখি ও বন্যপ্রাণীও রয়েছে। এই স্থানে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হলে নগরীর ভেতরের সবুজ এই অংশটি চিরতরে হারিয়ে যাবে।