সুপ্রভাত ডেস্ক
চলতি অর্থবছরের এপ্রিল মাসের তুলনায় মে মাসে আমদানি এলসি ওপেনিং ও সেটেলমেন্ট দুটোই বেড়েছে। সামনের সময়ে আমদানির চাহিদা আরও বাড়বে তবে ডলারের প্রবাহ নিয়ে শঙ্কায় ব্যাংকাররা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি মে মাসে নতুন এলসি ওপেনিং হয়েছে ৫.৩৩ বিলিয়ন ডলার যা আগের মাস এপ্রিলের তুলনায় ১.০৩ বিলিয়ন বা ২৫% বেশি। একইসঙ্গে এলসি সেটেলমেন্ট মে মাসে হয়েছে ৪.৬৯ বিলিয়ন ডলার যা আগের মাসের তুলনায় বেড়েছে ১০%।
একটি শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘গত এপ্রিল মাসে ব্যাংকগুলো অনেক ধরণের কনজুমার প্রডাক্টের এলসি ও ছোট ছোট অনেক ব্যবসায়ীদের এলসি খোলা কমিয়ে দিয়েছে। কারণ ওই মাসে কিছু ব্যাংক অধিক দামে রেমিট্যান্স কেনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ডেকে সতর্ক করেছে যার প্রভাব ব্যাংকগুলোর ডলারের প্রবাহ আমদানিতে হয়েছে।’ খবর টিবিএস।
তিনি আরও বলেন, ‘সাধারণত মে, জুন মাসে এলসি ওপেনিং বাড়ে কারণ হলো সামনে কোরবানির ঈদ রয়েছে। এছাড়া অতিরিক্ত দামে ডলার কেনা ব্যাংকগুলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শর্তসাপেক্ষে শাস্তি শিথিল করায় মে মাসে এলসি ওপেনিং বেড়েছে।’
যদিও এপ্রিলের এলসি ওপেনিং ৩২ মাসের মধ্যে সবচেয়ে কম ছিল। এছাড়া এলসি নিষ্পত্তি ছিল ২১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। এপ্রিলে এলসি ওপেনিং ও সেটেলমেন্ট হয়েছে যথাক্রমে ৪.৩০ বিলিয়ন ও ৪.৬৯ বিলিয়ন ডলার।
চলতি অর্থবছরের (জুলাই-এপ্রিল পর্যন্ত) সময়ে মোট ৫৬.৩৬ বিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হয়েছে। আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় এ পরিমাণ প্রায় ২৭% কম। সেইসঙ্গে অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে এলসি সেটেলমেন্ট করা হয়েছে ৬২.৪০ বিলিয়ন ডলারের, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৮% কম।
কয়েকজন আমদানিকারক জানিয়েছেন, এলসি মার্জিন রাখাসহ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সব শর্ত মানলেও ব্যাংকগুলো চাহিদামতো এলসি খুলছে না। এক ব্যাংক থেকে আরেক ব্যাংকে ঘুরতে হচ্ছে এলসি খোলার জন্য। এসব কারণে উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, কম্পিউটার বা মোটরসাইকেলের মতো ইন্ডাস্ট্রিয়াল মেশিনারির এলসি খোলা কমেছে ৪৬%। টেক্সটাইল ফেব্রিক ও কেমিক্যালের মতো ইন্ডাস্ট্রিয়াল র’ ম্যাটেরিয়ালের এলসি খোলা কমেছে ৩২%। সিমেন্ট, স্ক্র্যাপ ভেসেলের মতো মধ্যবর্তী পণ্যের এলসি খোলা কমেছে ৩১%, চাল ও গমের মতো ভোগ্যপণ্যের এলসি খোলা কমেছে ১৮%।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত মুখপাত্র জাকির হোসেন চৌধুরী বলেন, ব্যাংকগুলোর এলসি খোলার বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোন ধরণের বাধা নেই। তবে ৩ মিলিয়ন ডলারের বেশি এলসিগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে রিপোর্ট করা হয়। ব্যবসায়ীদের কখনও আমদানি বাড়ে, আবার কখনও আমদানি কমে। সামনে ঈদের সময়ে আরও এলসির পরিমাণ বাড়বে; ব্যাংকগুলোর ডলার প্রবাহও স্বাভাবিক রয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি বেসরকারি ব্যাংকের এমডি বলেন, ‘মুডিস রেটিং সম্প্রতি আমাদের ব্যাংকসহ একাধিক ব্যাংককে নেগেটিভ আউটলুক দিয়েছে, এতে আমাদের ইম্পোর্ট কস্ট বেড়ে যাবে। আমাদের অনেক পেমেন্ট ডেফার্ড করে করে সময় বাড়াচ্ছি, এগুলো পরিশোধ করা ব্যাংকের জন্য চ্যালেঞ্জিং হবে।’
‘রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ের প্রবাহ তেমন বাড়ছে না। এছাড়া বিদেশি উৎস থেকে যে লোন পাওয়া যেতো এই নেগেটিভ রেটিংয়ের কারণে তাতে অনেকটা প্রভাব পড়বে যা ব্যাংকগুলোর জন্য সমস্যা হবে।’
‘কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এখন যেকোন উপায়ে বিলাসী পণ্য আমদানি বন্ধ করতে হবে এবং হুন্ডির ব্যবহার কমাতে হবে। এক্সচেঞ্জ রেট বাড়িয়ে হুন্ডি কমানো যাবে না কারণ দেশে ডলারের রেট বাড়ালে বিদেশে থাকা হুন্ডি কারবারিরা রেট বাড়িয়ে দেবে। কারণ তারা অবৈধ অর্থ দিয়ে ডলার কেনে।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংক চলতি অর্থবছরের (জুলাই-এপ্রিল পর্যন্ত) দশ মাসে প্রায় ১২.৬৭ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে ব্যাংকগুলোর কাছে। ৩১ মে শেষে দেশের রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৯.৯১ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৪২.২০ বিলিয়ন ডলার। সে হিসেবে এক বছরে রিজার্ভ কমেছে ১২.২৮ বিলিয়ন ডলার। এর আগে অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, ‘ক্যাপিটাল মেশিনারিজ ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল র’ ম্যাটেরিয়ালের আমদানি কম হলে দেশের উৎপাদন খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের সক্ষমতা অনুযায়ী উৎপাদন করতে না পারলে বাকি খাতগুলো যেমন: পরিবহন, বিপণন থেকে শুরু করে কনজিউমার লেভেল পর্যন্ত এর প্রভাব পড়ে।’
‘এছাড়া সরকারের রাজস্ব আয়ও কমে। কারণ, ইমপোর্ট ডিউটি, ট্যাক্স, ভ্যাট থেকে সরকারের আয় কমে যায়। সেইসঙ্গে বিনিয়োগও বাধাগ্রস্ত হয়। সবকিছু মিলে আবার ইনফ্লেশনকে ট্রিগার করে, যেটি পণ্যের সাপ্লাই কমে যাওয়ার কারণে হয়। এই ইনফ্লেশন কিন্ত বাইরে থেকে আমদানি করা নয়, নিজেদেরই তৈরি করা,’ বলেন তিনি।