সনেট দেব »
সমুদ্রের ঢেউ যখন নীল আভায় ঝিকমিক করে, তখন হঠাৎ দেখা যায় এক দলে ডলফিন পানির ওপর উঠে খেলে বেড়াচ্ছে—কখনো লাফিয়ে, কখনো ডুব দিয়ে, কখনো আবার নাক উঁচিয়ে যেন হাসছে। তাদের হাসিমুখ ও বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ এমনই মনোমুগ্ধকর যে, পৃথিবীর সবচেয়ে প্রিয় সামুদ্রিক প্রাণী হিসেবে ডলফিনের জনপ্রিয়তা অনন্য। তবে এই প্রাণী শুধু আদুরে নয়, অবিশ্বাস্যরকম বুদ্ধিমান, সংবেদনশীল এবং সামাজিকও বটে।
ডলফিনের বৈজ্ঞানিক নাম Delphinus Delphis, যা স্তন্যপায়ী প্রাণীর অন্তর্গত এবং Cetacea বর্গের সদস্য। পৃথিবীতে প্রায় ৪০টিরও বেশি প্রজাতির ডলফিন আছে, যাদের মধ্যে কিছু থাকে খোলা সমুদ্রে, আবার কিছু বাস করে নদীতে—যেমন বাংলাদেশে পাওয়া যায় বিরল প্রজাতির শুশুক বা Irrawaddz Dolphin। ডলফিন আসলে মাছ নয়, কারণ তারা শ্বাস নেয় ফুসফুস দিয়ে, ডিম পাড়ে না—বরং জীবন্ত বাচ্চা জন্ম দেয় এবং বুকের দুধ খাওয়ায়। এই কারণেই ডলফিন স্তন্যপায়ী প্রাণী।
ডলফিনের দেহের গঠন সাঁতার কাটার জন্য উপযুক্তভাবে তৈরি। তাদের শরীর সরু, মাথা সামান্য গোলাকার, আর মুখে একধরনের মিষ্টি হাসির রেখা থাকে—যা তাকে সদা আনন্দিত দেখায়। ডলফিনের দৈর্ঘ্য সাধারণত ২ থেকে ৪ মিটার এবং ওজন ১৫০ থেকে ৩০০ কিলোগ্রামের মধ্যে হয়ে থাকে। এরা শ্বাস নেয় মাথার ওপরের ছিদ্র দিয়ে, যাকে বলা হয় ব্লোহোল (Blowhole)। প্রতি কয়েক মিনিট পরপর তারা পানির ওপর উঠে শ্বাস নেয়, তারপর আবার ডুবে যায় গভীরে। ডলফিন ঘণ্টায় প্রায় ৩০ থেকে ৪০ কিলোমিটার বেগে সাঁতার কাটতে পারে, যা তার চঞ্চল স্বভাবেরই প্রমাণ।
ডলফিন পৃথিবীর সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণীদের মধ্যে অন্যতম। বিজ্ঞানীরা বলেন, তাদের মস্তিষ্কের গঠন মানুষের সঙ্গে অনেকটাই সাদৃশ্যপূর্ণ। তারা শেখার ক্ষমতা রাখে, সংকেত বুঝতে পারে, এমনকি মানুষের নির্দেশও অনুসরণ করতে পারে। ডলফিনদের নিজস্ব ভাষা আছে—তারা শিসের মতো শব্দ ও ক্লিক ধ্বনির মাধ্যমে একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করে। প্রতিটি ডলফিনের নিজের একটি “স্বাক্ষর শিস” বা Signature Whistle থাকে, যেটি শুনে অন্য ডলফিন তাকে চিনতে পারে। এটি যেন প্রাণীজগতে একধরনের নামধ্বনি।
ডলফিন একা থাকে না; তারা “চড়ফ” নামে দলে দলে বাস করে। একটি দলে কখনো ১০টি, আবার কখনো শতাধিক ডলফিনও থাকতে পারে। তারা একে অপরের সঙ্গে খেলাধুলা করে, মাছ শিকার করে, এমনকি অসুস্থ বা আহত সঙ্গীকে পানির উপরে ঠেলে ধরে রাখে যাতে সে শ্বাস নিতে পারে—এমন মানবিক আচরণ প্রাণিজগতে বিরল। অনেক সময় দেখা গেছে, বিপদে পড়া জেলেদের বা ডুবে যাওয়া মানুষকেও ডলফিন সাহায্য করেছে। এজন্যই একে বলা হয় “মানুষের বন্ধু সাগরের সন্তান।”
ডলফিন সাধারণত মাছ, স্কুইড এবং ছোট সামুদ্রিক প্রাণী খায়। তারা দলবদ্ধভাবে শিকার করে, একদিকে মাছ তাড়িয়ে নিয়ে আসে, আর অন্যদিকে দাঁড়িয়ে থাকা ডলফিনরা সেই শিকার ধরে ফেলে। এই কৌশল দেখায় তাদের সংগঠন ও বুদ্ধিমত্তা কত উন্নত। মাদি ডলফিন সাধারণত দুই থেকে তিন বছর পর পর একটি বাচ্চা দেয়। জন্মের পর মা ডলফিন ছানাটিকে পানির ওপর ভাসিয়ে প্রথম শ্বাস নিতে সাহায্য করে। তারপর দীর্ঘদিন ধরে তাকে নিজের কাছে রাখে, শেখায় কীভাবে সাঁতার কাটতে হয়, কীভাবে খাবার খুঁজতে হয়। এদের মাতৃত্ববোধ এতটাই প্রবল যে, মানুষকেও যেন অবাক করে দেয়।
ডলফিনের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক প্রাচীনকাল থেকেই। প্রাচীন গ্রিকরা একে পবিত্র প্রাণী মনে করত। আজও বিভিন্ন দেশে ডলফিন থেরাপি নামে বিশেষ পদ্ধতিতে শিশুদের মানসিক বিকাশে এদের ব্যবহার করা হয়। আবার সাগর পর্যটন শিল্পেও ডলফিন দেখা একটি জনপ্রিয় আকর্ষণ। তবে দুঃখজনকভাবে, জলদূষণ, প্লাস্টিক বর্জ্য, জালের ফাঁদ ও শব্দদূষণের কারণে আজ অনেক প্রজাতির ডলফিন বিলুপ্তির পথে। বাংলাদেশের শুশুকও এখন বিপন্ন প্রাণীর তালিকায়।
ডলফিন শুধু একটিমাত্র প্রাণী নয়—সে এক আবেগ, এক প্রতীক। সে শেখায় আনন্দে বাঁচতে, দলে মিলেমিশে থাকতে, আর অপরকে সাহায্য করতে। প্রকৃতির বিশাল নীল জলরাশিতে ডলফিন যেন এক চলমান হাসি—যার ভেতরে আছে মমতা, বুদ্ধি ও সৌন্দর্যের মেলবন্ধন। সাগরের এই হাসিখুশি প্রাণী আমাদের মনে করিয়ে দেয়—বুদ্ধি ও সহমর্মিতা কেবল মানুষের সম্পদ নয়, প্রকৃতিরও এক নিঃশব্দ ভাষা আছে, যা ডলফিনেরা প্রতিদিন তাদের লাফিয়ে ওঠা ঢেউয়ে লিখে যায়।





















































