ট্রেনযাত্রা ও অনিন্দ্য সুন্দরী

সাঈদুর রহমান লিটন »

যশোর স্টেশনটা তখন ব্যস্ত, জনসমুদ্রের মধ্যে দিয়ে হেঁটে আমি পৌঁছে গেলাম আমার নির্ধারিত বগিতে। গন্তব্য রাজশাহী, একটি ইন্টারভিউয়ের জন্য। এমন ইন্টারভিউ এর আগেও কত দিয়েছি , কত জায়গায়, ফলাফল সেই শূন্য। অথচ যতবারই ডাকে, চলে যাই আশা নিয়ে, হয়তো এবার কিছু হবে। মাথায় চিন্তার ভার, মনে হতাশার ছায়া, তার মাঝেই ট্রেন ছাড়লো।
সিটে আমি একা। ভাবলাম অনেকটা সময় তো, কেউ হয়তো পরে উঠবে। বেশিক্ষণ লাগলো না, আমার পাশের সিটে উঠলেন এক ভদ্রলোক। বয়সে আমার চেয়ে কয়েক বছরের বড় হবেন হয়ত, চেহারায় সাদামাটা, কিন্তু চোখে-মুখে একটা মায়া আছে। ভদ্রলোক আমার দিকে তাকিয়ে হালকা হাসলেন, আমিও সৌজন্যবশত হাসি ফিরিয়ে দিলাম।
ভাবলাম, সম্পর্কটা একটু এগিয়ে নেওয়া যাক। যেহেতু দীর্ঘ যাত্রা, গল্পগুজব করলে সময়টা ভালো কাটবে।
কোথায় যাচ্ছেন স্যার?
রাজশাহী। সরকারি স্কুলে পোস্টিং। আপনি?
একটা ইন্টারভিউ আছে। দেখি, আরেকটা চেষ্টার ধাক্কা। চাকরি এখনও ধরা দেয়নি।
গল্প জমে উঠলো দ্রুতই। জানলাম তিনি একজন সরকারি হাই স্কুলের বিজ্ঞানের শিক্ষক, বাগেরহাটের বাসিন্দা। ভদ্রলোক বেশ ভালোমানুষ, কথাবার্তায় ভদ্র, মাঝেমাঝে হালকা হাসি। আমি গল্প করার ফাঁকে ভাবলাম, এই মানুষটি যেন বহুদিনের চেনা, এমন আপন মনে হচ্ছিল।
আমাদের সারির উল্টো দিকের লাইনে এক মা ও মেয়ে এসে বসলেন। মা বয়সে প্রৌঢ়া, কিন্তু মেয়েটি! আহা, এমন রূপ তো সিনেমাতেও দেখা যায় না। এক ঝলক তাকিয়ে থেকেই বুঝলাম, প্রেম নামক বিপজ্জনক রোগটির প্রাথমিক উপসর্গ আমার হৃদয়ে শুরু হয়ে গেছে। এমন সৌন্দর্য, যেন প্রকৃতি নিজের হাতে গড়ে তুলেছে। চোখ দুটো গরুর বাছুরের মতো সরল, দাঁতগুলো নিখুঁত, হাসলে যেন সকালটা আরও আলোকিত হয়ে ওঠে।
আমি মুখ ফিরিয়ে পাশের স্যারকে বললাম, স্যার, মেয়েটি খুব সুন্দর, তাই না?
ভদ্রলোক মাথা নেড়ে হেসে বললেন, হ্যাঁ, দারুণ সুন্দর।
এরপর আমরা দুজনে মিলে মেয়েটি নিয়ে আলোচনা শুরু করলাম, যেন কোনো গবেষণায় বসেছি। আমি বললাম, এমন মেয়ের সাথে যদি প্রেম করা যেতো, জীবনটা কেমন হতো বলুন তো? স্যার হেসে বললেন, অফার দিয়ে দেখুন না।
আমি বললাম, না স্যার, আমি বেকার। প্রেম তো দূরে থাক, মেয়েটির বাবার সামনে দাঁড়াতেই লজ্জা পাবো।
তিনি হাসতে হাসতে বললেন, আরে, আপনি তো ভালো ছেলে, এমন ছেলের জন্য কেউ নিশ্চয়ই রাজি হয়ে যাবে।
আমি ভেবে ভেবে কল্পনায় একেবারে বিয়ের প্রিপারেশন অবধি পৌঁছে গেলাম। মেয়েটির নাম হতে পারে শ্রুতি কিংবা সৃষ্টি এমন মিষ্টি কিছু। আমাদের সংসারে রবীন্দ্রসংগীত চলবে, ছুটিতে দুজনে মিলে পাহাড়ে যাবো, ফেসবুকে জোড়া প্রোফাইল পিকচার… ভাবনারা একেকটা সিনেমার দৃশ্য হয়ে মাথায় ঘুরতে লাগল।
এভাবে গল্প, কল্পনা, আর হাস্যরসের মাঝেই ট্রেন রাজশাহী পৌঁছে গেল। ট্রেন থামতেই আমরা নেমে পড়লাম। আমি ভাবলাম, এই অচেনা অথচ কাছের মানুষটির সঙ্গে একটা ছবি তুলে রাখি কি না। বিদায় নিতে এগিয়ে গেলাম।
ভদ্রলোক পকেট থেকে একটা ভিজিটিং কার্ড বের করে দিলেন। ভালো লেগেছে আলাপটা। সময় পেলে বেড়াতে আসবেন, আমার বাড়ি বাগেরহাট, সাইনবোর্ডের কাছেই।
আমি বললাম, অবশ্যই স্যার। আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে খুব ভালো লাগলো।
এরপর তিনি একটু থেমে হেসে বললেন, আচ্ছা, আপনাকে একটা কথা বলি। ওই যে বলছিলেন, মেয়েটি খুব সুন্দর?
আমি হেসে মাথা নাড়লাম, জি, অপূর্ব সুন্দর ।
তিনি আঙুল দিয়ে দেখালেন, উনি আমার ওয়াইফ, আর মেয়েটি আমার একমাত্র মেয়ে, শ্রুতি।
আমি যেন বজ্রাহত হলাম । দাঁড়িয়ে আছি, মুখের হাসিটা ধীরে ধীরে জমে গেল। আমার মুখের ভাব বদলে গেছে সেটা আমি টের পেলাম, কিন্তু কিছু বলার ভাষা খুঁজে পেলাম না। শ্রুতি তখন একটা হালকা হাসি দিয়ে রিক্সায় উঠছে, মা-বাবার পাশে বসে।
স্যার আরেকবার হাসলেন, ভালো থেকো। আশীর্বাদ রইল। রিক্সাটা ধীরে ধীরে চলে গেল।
আমি দাঁড়িয়ে রইলাম রাজশাহীর প্ল্যাটফর্মে, এক হাতে ব্যাগ ধরা, মুখে হালকা স্তব্ধতা আর ভেতরে এক অসহ্য কৌতুক।