টেকসই সবুজ অর্থনীতি ও জলবায়ু পরিবর্তন

সাধন সরকার »

প্রাকৃতিক ভারসাম্য এবং পরিবেশের ক্ষতিসাধন না করে অর্থনৈতিক উন্নয়ন করা গেলে তা উন্নত ও উন্নয়নশীল যেকোনো দেশের জন্য টেকসই প্রবৃদ্ধি বয়ে আনে। সবুজ প্রবৃদ্ধি বা অর্থনীতির মূল কথা হলো- মানুষের উন্নয়ন নিশ্চিত হবে, অভাব দূর হবে কিন্তু পরিবেশের ক্ষতি হবে না। সমগ্র পৃথিবীতেই জলবায়ুগত দুর্যোগের প্রভাব আজ দৃশ্যমান! যদিও জলবায়ুর নেতিবাচক পরিবর্তনের মূল হোতা পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো। উন্নত দেশসমূহ শিল্পায়নের নামে, দ্রুত প্রবৃদ্ধির নামে অতিমাত্রায় কার্বন নিঃসরণ করছে। আর এর ক্ষতিকর প্রভাবে ভুগছে উন্নত ও উন্নয়নশীল সব দেশ। জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবে পৃথিবীব্যাপী বদলে যাচ্ছে মানুষের জীবনযাত্রা। এর ফলে অবকাঠামো, ব্যবসা-বাণিজ্য, কর্মসংস্থান, দারিদ্র্য দূরীকরণসহ নানা ক্ষেত্রে প্রতিকূল প্রভাব পড়ছে। সম্প্রতি জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক ‘জাতিসংঘের আন্তঃসরকার প্যানেলে’র (আইপিসিসি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কার্বন নিঃসরণের বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী ১২ বছরের মধ্যে পৃথিবীতে খরা, বন্যা আর ভয়াবহ তাপপ্রবাহের মতো মহাবিপর্যয় নেমে আসতে পারে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, উষ্ণায়ন ঠেকাতে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে বিশ^ যদি ব্যর্থ হয়, তবে ২০৩০ সাল থেকে ২০৫২ সালের মধ্যে তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার লক্ষ্যমাত্রা দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যাবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হচ্ছে কর্মজীবী নি¤œবিত্ত আর মৌসুমি ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। সামাজিক নিরাপত্তাবলয়ের বাইরে যাদের অবস্থান, যাদের আয়ের সুযোগ ও সম্ভাবনা সীমিত জলবায়ুর নেতিবাচক পরিবর্তনের কারণে তাদের নানাবিধ প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। সভ্যতাকে এগিয়ে নিতে হলে বেশি মাত্রায় জ¦ালানি নির্ভর এবং দূষণসৃষ্টিকারী কলকারখানা নিয়ে ভাবার সময় হয়েছে। এগুলো সংস্কার করা জরুরি হয়ে পড়েছে। আবার এখন যে শিল্পকারখানা গড়ে উঠবে সেগুলো পরিবেশবান্ধব হওয়া দরকার। জলবায়ু দুর্যোগের কারণে ক্ষতির শিকার হওয়া দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কথা এখন ভাবার সময় হয়েছে। কেননা তাদেরকে বাদ দিয়ে টেকসই সবুজ প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব নয়। সবুজ অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে হলে পরিবেশ সুরক্ষা ও আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে কর্মপরিকল্পনা করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনকে উপেক্ষা করার ফলে এখন তা সার্বিক অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে শুরু করেছে। ধারণা করা হচ্ছে, জলবায়ুর নেতিবাচক পরিবর্তনের কারণে পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে যেতে থাকলে কয়েক বছরের মধ্যে বিশ^জুড়ে উৎপাদন ব্যবস্থায়ও ব্যাপক ক্ষতি হবে। পরিবেশবান্ধব টেকসই অর্থনীতির প্রতি গুরুত্ব না দিলে ‘প্যারিস চুক্তির’ (বর্তমান শতাব্দীতে বৈশি^ক তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার ২ ডিগ্রির নিচে রাখা) শর্তাবলী মেনে পৃথিবী রক্ষা করা সম্ভব নাও হতে পারে। সবুজ প্রবৃদ্ধি এমনি এমনি হয়ে যাবে না। তার জন্য নবায়নযোগ্য জ¦ালানি খাতে ব্যাপক কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে সঠিক কর্মপরিকল্পনা নিয়ে এগোতে হবে।
সবুজ অর্থনীতি বাস্তবায়নের জন্য সবচেয়ে যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তা হলো কার্যকর ও উপযুক্ত আইন প্রণয়ন। অনেক দেশ বিশেষ করে উন্নত দেশগুলো পরিবেশ সুরক্ষার কাজটি ব্যয়বহুল ও শ্রমসাধ্য ব্যাপার বলে অনেক সময় এড়িয়ে চলতে চান। টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হলে এক্ষেত্রে পুরোপুরি অগ্রগতি অর্জন করা জরুরি। সম্প্রতি বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শত বছরের মহাপরিকল্পনা ‘বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান, ২১০০’ বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রীকে চেয়ারপারসন করে ১২ সদস্যের ‘ডেল্টা গভর্ন্যান্স কাউন্সিল’ গঠন করা হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যাকে অভিশাপের বদলে আশীর্বাদে পরিণত করতে এটি একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। মনে রাখা দরকার, মাত্রাতিরিক্ত তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে দিন দিন বায়ুম-লের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। জাতিসংঘের বিশ^ আবহাওয়া সংস্থার (ডব্লিউএমও) তথ্য মতে, চলতি শতকে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। তাহলে কি জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় একটু একটু করে হেরে যাবে বিশ^ ? সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে।
প্রতিবছর দেশে দেশে ভয়াবহ দুর্যোগ দেখা দিচ্ছে। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর একটি। তাই সবুজ প্রবৃদ্ধি অর্জন এখন বড় চ্যালেঞ্জের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। জলবায়ু প্রতিকূল পরিবর্তনে অভিযোজনের পাশাপাশি ও দূষণের মাত্রা প্রশমন করতে না পারলে তা সবুজ প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করবে। যেকোনো উন্নয়নে পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন (ইআইএ) সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। টেকসই সবুজ প্রবৃদ্ধির দিকে দেশ এগিয়ে থাকলে উন্নয়ন টেকসই হবে। দারিদ্র্য দূর হবে, কর্মসংস্থান বাড়বে। বনভূমির পরিমাণ বাড়বে। নদী-নালা, খাল-বিল রক্ষা পাবে। কার্বন নিঃসরণ কম হবে এবং দূষণ কমবে। সর্বোপরি পরিবেশ-প্রতিবেশের সুরক্ষা হবে। তবে সবার আগে টেকসই নির্মাণ ও বনায়নের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। পৃথিবীকে বাসযোগ্য করতে হলে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা ভেবে বর্তমান বাস্তবতায় পরিবেশগত সমস্যা মোকাবিলায় সবুজ অর্থনীতির অঙ্গীকার থাকা সবচেয়ে বেশি জরুরি।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও পরিবেশকর্মী
সদস্য, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)
ংধফড়হংধৎশবৎ২০০৫@মসধরষ.পড়স