শ্যামল বণিক অঞ্জন »
সৌরভের মনটা আজ ভালো নেই, সারাদিন কিছু খায়নি, স্কুলেও যায়নি। কারণ আজ সৌরভের শখের টিয়ে পাখিটি খাঁচা থেকে বের হয়ে উড়ে চলে গেছে! সকাল থেকেই শুধু কাঁদছে সৌরভ। কারো কোন সান্তনাই কাজ হচ্ছে না। ঘুম থেকে ওঠার পরে টিয়ে পাখিটাকে স্নান করিয়ে রেখে সৌরভ প্রাইভেটে গিয়েছিলো কিন্তু বাড়ি ফিরে সে দেখে খাঁচাটা শূন্য পড়ে আছে বহু দিনের পালিত তাঁর শখের টিয়ে পাখিটি উধাও! হয়তো খাঁচার দরোজাটা ঠিকমতো লাগাতে ভুল হয়েছিলো যার ফল স্বরুপ এমন হৃদয় ভাঙা ঘটনার সূত্রপাত হয়েছে।
সৌরভের টিয়ে পাখিটা যেমন সুন্দর ছিলো তেমনি সুন্দর করে অনেক কথা বলতো! গেইটে কেউ নক করলেই বলে উঠতো গেইটে কে!
গেইট খুলে দাও! গেইট খুলে দাও। সকাল হতেই সৌরভকে ডাকতো, দাদা উঠো! দাদা উঠো পড়তে যাও, পড়তে যাও! সারাদিন চেঁচামেি তে বাড়িটা মাতিয়ে রাখতো। সৌরভ আদর করে ওর নাম রেখেছিলো টুইঙ্কেল।
সৌরভ খুব খুব ভালোবাসতো ‘টুইঙ্কেলকে, টুইঙ্কেলও যেন সৌরভের মনের সকল কথাই বুঝতো!
প্রতিদিন টুইঙ্কেলকে নানা রকম খাবার দিতো সৌরভ, নানা রকমের ফলমুল, দুধভাত কাঁচা লঙ্কা কামরাঙা আরও অনেক কিছু! সৌরভের বাবা মা সহ বাড়ির সকলেই টুইঙ্কেলকে ভীষণ ভালোবাসতো। তাই আজ বাড়ির সকলের মনেই যেন বিষাদের ছায়া নেমে এসেছে। আর পাগলের মতো সৌরভ খুঁজে বেড়াচ্ছে ওর প্রিয় টিয়ে পাখিটিকে। সাথে ওর কয়েকজন বন্ধু কাকাতো জেঠাতো ভাই বোনেরাও যোগ দিয়েছে। ছোট ছোট গ্রুপে ওরা টুইঙ্কেলকে খুঁজে চলেছে সেই সকাল থেকে! এদিকে সৌরভের মা ছেলেকে একটু কিছু মুখে দেওয়ার জন্য প্রানান্ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। গা মাথা হাতিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে — একটু কিছু খেয়ে নাও বাবা, এরকম পাগলামি করলে কি চলবে? নাও খেয়ে নাও লক্ষী সোনা বাবা।
এমন সময় হঠাৎ কে যেন গেইটে নক করলো আর অমনি কোথা থেকে যেন ভেসে আসলো সেই চির চেনা কন্ঠস্বরটা গেইটে কে? গেইটে কে? বাড়ির সকলেই চমকে উঠলো পরিচিত সেই কন্ঠটা শুনে, সৌরভের মা তো আনন্দে আন্তহারা হয়ে চেঁচিয়ে উঠলো আরে এটা তো আমাদের টুইঙ্কেলের গলার আওয়াজ!
মা চিৎকার করে সৌরভ, এই সৌরভ তাড়াতাড়ি এসো বাবা, তোমার টুইঙ্কেলকে পাওয়া গেছে! মায়ের এরকম কথা শুনে সৌরভ সহ সকলেই দৌড়ে এসে দেখলো পাশের বাসার বিল্ডিংয়ের কার্ণিশে বসে আছে ওর আদরের টিয়ে পাখি টুইঙ্কেল। সৌরভ অনুভব করলো হয়তো টুইঙ্কেলের ভীষণ খিদে পেয়েছে সারাদিন কিছু খায়নি! তাই সৌরভ বুদ্ধি করে টুইঙ্কেলের সব চেয়ে বেশি প্রিয় খাবার দুধ কলা মিশিয়ে ভাত মেখে ওর খাঁচাতে রাখলো, টুইঙ্কেলও আর এক মুহূর্ত দেরি করলো না, সাথে সাথে একটা উড়াল দিয়ে এসে ঢুকে পড়লো ওর চেনা ঘরে মানে খাঁচার মধ্যে। সৌরভ আস্তে করে গিয়ে খাঁচার মুখটা আটকে দিয়ে আনন্দে লাফিয়ে উঠলো — হিপ হিপ হুররে! পেয়ে গেছি! পেয়ে গেছি টুইঙ্কেলকে!! ওর সাথে সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠলো সৌরভের ভাই বোন বন্ধুরাও!
মুহূর্তেই সকলের মাঝেই খুশির জোয়ার নেমে এলো! যেন স্বস্তি ফিরে এলো সকলের মাঝে! সৌরভের বাবা ব্যাংকার সঞ্জয় সাহা রাতে বাসায় ফেরার পরে ফ্রেশ হয়ে এসে চা খেতে খেতে সৌরভের কাছে সব কথা শুনে নিজেও ভীষণ খুশি হলো এবং একটা অবুঝ পাখির এরকম বিশ্বস্ততার গল্প শুনে রীতিমতো বিস্মিত হয়ে গেলেন! এবং ছেলেকে বললেন – আমি একটা কথা বলি শোন, আমাদের টুইঙ্কেল কিন্তু আজ সকলের কাছে তার বিশ্বস্ততার প্রমাণ দিয়েছে! আর এতে কিন্তু আমি রীতিমতো মুগ্ধ এবং বিস্মিত হয়েছি। একটা অবুঝ পাখি আজ আমাদের সকলের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো কারো ভালোবাসা আদর যত্নের কীভাবে মুল্যায়ণ করতে হয়, সম্মান জানাতে হয়। সৌরভের বাবার কথার সাথে সৌরভের মাও একমত পোষণ করলেন এবং বললেন সত্যিই, বিষয়টা কিন্তু খুবই আশ্চয্যের!
বাবা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বললেন, আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে টুইঙ্কেলকে নিয়ে। সৌরভ বাবার মুখে এরকম কথা শুনে ভীষণ কৌতুহলী হয়ে উঠলো জানবার জন্য- বললো কী বুদ্ধি বাবা! বাবা বললেন – এখন থেকে আমরা আমাদের প্রিয় টুইঙ্কেলকে আর খাঁচায় বন্দি করে পুষবো না, ওকে আমরা ছেড়ে দিয়ে লালন পালন করবো। সৌরভ শুনে খুব খুশি হলো! বাবা বললো আপাতত ওকে খাঁচা থেকে ছেড়ে লালন পালন করে পরিবেশের সাথে এ্যাডজাস্ট করিয়ে নিয়ে তারপরে আমাদের বাগানের নারিকেল গাছে ওর বাসা বাধার জন্য একটা ঘর বানিয়ে দিবো ঠিক আছে?
সৌরভ আর ওর মা বাবার কথার কথা সুর মিলিয়ে বললো ঠিক আছে বাবা।
পরের দিন থেকেই শুরু হলো সৌরভের টুইঙ্কেলের স্বাধীন জীবনযাপন। বিশ্বস্ত টুইঙ্কেল ফিরে পেলো ওড়ার স্বাধীনতা, নিজের মতো করে ঘুরে বেড়ানোর স্বাধীনতা! উপভোগ করতে লাগলো প্রকৃত স্বাধীনতার সুখ!