নিজস্ব প্রতিবেদক »
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সেতু বিভাগের সচিব মো. মনজুর হোসেন বলেন, মূল টানেলের কাজ শতভাগ শেষ। তবে পুরো প্রকল্পের কথা বললে অগ্রগতি ৯৮ দশমিক ৫ শতাংশ। যে ১ দশমিক ৫ শতাংশ কাজ বাকি রয়েছে তা চলাচলের জন্য কোনো সমস্যা সৃষ্টি করবে না। এপ্রোচ রোড, সার্ভিস এরিয়া, পুলিশের ফাঁড়ি নির্মাণ ও ফায়ার সার্ভিস স্টেশন নির্মাণের কার্যক্রম চলছে। তবে কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণে আনোয়ারার চাতরি অংশে কাজ এখনও শেষ হয়নি। টানেলের ইলেক্ট্রোমেকানিক্যাল কাজ শেষে হওয়ার পর প্রি-কমিশনিং ও কমিশনিং দেখা হয়েছে। এছাড়া সবগুলো সিস্টেম কাজ করছে কিনা কয়েকবার করে দেখা হয়েছে। শুরুর দিকে চাতরির কারণে টানেলের সুফল আসবে না। তবে সংশ্লিষ্টরা এ কাজটি দ্রুত শেষ করার পর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন।’
তিনি গতকাল মঙ্গলবার সকাল ১০টায় চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজের সম্মেলন কক্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের উদ্বোধন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি সভায় এ মন্তব্য করেন।
টানেল উদ্বোধন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব টানেল শুধুমাত্র চট্টগ্রামবাসীর জন্য গর্ব নয়, জাতির জন্যও অনেক গর্বের বিষয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় টানেল এখন প্রায়ই প্রস্তুত হয়েছে আমরা বলতে পারি। আগামী ২৮ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী এটা উদ্বোধন করার জন্য তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। আশা করছি, ২৮ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টানেল উদ্বোধন করার পরদিন ২৯ অক্টোবর সকাল ১০টা থেকে সাধারণ মানুষ যাতায়াত করতে পারবে।
শুধু চট্টগ্রামবাসী নয়, পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় নদীর তলদেশে প্রথম টানেল নির্মাণে সবার আগ্রহের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সারাদেশের অনেক লোক টানেল দেখতে আসবেন। তাই ট্রাফিকিং নিয়ে যেন কোনো সমস্যা না হয় তা খেয়াল রাখতে হবে। টানেলের সর্বোচ্চ গতিসীমা থাকবে ৮০ কিলোমিটার। শুরুর দিকে গতি কিছুটা কম রাখা হবে। তবে মোটরসাইকেল কিংবা তিন চাকার কোনো যানবাহন চলাচলের অনুমতি থাকবে না। ট্রাফিকের যেমন এই বিষয়ে প্ল্যান আছে, পুলিশেরও নির্দিষ্ট প্ল্যান থাকতে পারে। সিডিএর পক্ষ থেকে কিছু প্রস্তাব আছে। তারাও কিছু প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।’
ওয়ান সিটি টু টাউনের পরিকল্পনা ছাড়াও টানেলের বড় আরেকটি লক্ষ্যের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘যদিও সরকারের একটি প্রকল্প এ টানেল। সেতু বিভাগেরও লক্ষ্য ছিল টানেলটি তৈরি করা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল ওয়ান সিটি টু টাউন। পতেঙ্গার এক পাশে আগের চেয়ে অনেক উন্নতি হয়েছে। আরও করা হচ্ছে। আনোয়ারা প্রান্তে পৌনে দুই বছর ধরে যা দেখছি অনেক পরিবর্তন হয়েছে। চোখের সামনে সেই পরিবর্তন দেখা যায়। তবে টানেলের যে আরও একটি বড় লক্ষ্য আছে সেটা হলো, কক্সবাজারে কিছু বড় প্রকল্পের সাথে সংযুক্ত হওয়া। আগামী দুই-চার বছরের মধ্যে সেই প্রকল্পে যাতায়াতের জন্য টানেলটি ব্যবহার করা হবে। সেক্ষেত্রে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় পুলিশের আলাদা পরিকল্পনা আছে। তাদের সঙ্গে সমন্বয় করে আমরা সব কাজ করতে চাই।
উদ্বোধনের পরও প্রকল্প কাজ চলমান থাকা ও আনোয়ারা অংশে শিল্পোন্নয়ন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘টানেল উদ্বোধনের পরও আমাদের কার্যক্রম চলবে। পুলিশের পক্ষ থেকে ফাঁড়ি, ডাম্পিং, স্টেশনের কথা বলা হয়েছে সেটা আমরা করতে পারব। সে জায়গা রয়েছে। অপারেশনের যারা রয়েছে, মেইটেনেন্স যারা করবে তাদের নিজস্ব যানবাহন থাকবে। প্রথমদিকে আমরা চেষ্টা করবো এই জিনিসটা অন্যদের সাপোর্ট নিয়ে সবার সমন্বয়ে কাজগুলো এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার। নগরীকে যদি আনোয়ারার ওই প্রান্তে শিফট করা যায় তাহলে এদিকে চাপ কমবে। ব্যবসা, শিল্প কারখানা গড়ে উঠা এগুলোই তো মূল লক্ষ্য। একটি দেশের উন্নয়নে জিডিপিতে পজিটিভ প্রভাব যেটা থাকে সেটা হচ্ছে আমরা সময় বাঁচাতে পারছি কিনা, শিল্প উন্নয়ন ঘটাতে পারছি কিনা, ট্যুরিজমে ডেভেলপ ঘটাতে পারছি কিনা। সব কিছু মিলিয়ে আনোয়ারা প্রান্তে সেই উন্নয়নটা দেখা যাচ্ছে। সেটাই মূল বিষয়। ওয়ান সিটি টাউনের কনসেপ্ট সেখান থেকেই এসেছে।’
তিনি বলেন, টানেলে কোন কোন যানবাহন চলবে সেটা নির্ধারণ করা হয়েছে। টোলও নির্ধারণ করা হয়েছে। ইমার্জেন্সি গাড়ি ও প্রশাসনের অন-ডিউটিরত গাড়িকে টোলের আওতায় আনা হবে না। আর সবাইকে টোল দিতে হবে।
টানেল নিয়ে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘টানেলের কনসেপ্ট আমাদের কাছে নতুন। সেজন্য এটার কিছু চ্যালেঞ্জ আছে। তবে এখানে একটি মজার বিষয় হচ্ছে, টানেলে ঢুকার আগে যেসব গাড়ি এফএম রেডিও চালু করবে তখন টানেল ব্যবহারের নীতিমালা অটোমেটিক চলতে থাকবে। এফএম রেডিওর ছয়টি স্টেশন আছে। সবগুলোতেই এই নীতিমালা রয়েছে। টানেলের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত রেডিওতে এই নীতিমালাগুলো পড়ে শুনানো হবে। এছাড়া ভেতরে যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে সেজন্য রেসকিউ কিভাবে হবে উল্লেখ রয়েছে যা অন্য ব্রিজ বা সড়ক থেকে আলাদা। এতে নিশ্চিত করা হয়েছে কিভাবে টানেল নিরাপদ থাকবে এবং যারা ব্যবহার করবে তারাও নিরাপদ থাকবে। সেই ধারণা থেকে এই মুহূর্তে দুই বা তিন চাকার গাড়ির জন্য এটা নিরাপদ হবে না বলে মনে করি।
সভায় আরও বক্তব্য দেন বিভাগীয় কমিশনার তোফায়েল ইসলাম, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার কৃষ্ণ পদ রায়, ডিআইজি নুরে আলম মিনা, পুলিশ সুপার এস এম শফিউল্লাহ, জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান, নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মাহাতাব উদ্দিন আহমেদ, সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন, টানেলের প্রকল্প পরিচালক হারুন উর রশিদ ও আনোয়ারা উপজেলা চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম।
প্রসঙ্গত, ৩ দশমিক ৩১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের বঙ্গবন্ধু টানেল কর্ণফুলী নদীর দুই তীরের অঞ্চলকে যুক্ত করবে। এই টানেলের মধ্য দিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক যুক্ত হবে। এটা বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ায় নদী তলদেশের প্রথম ও দীর্ঘতম সড়ক সুড়ঙ্গপথ। চীনা প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশন অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড এই সুড়ঙ্গ নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিন পিং প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল নির্মাণকাজ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি ৭১ লাখ টাকা। সর্বশেষ সংশোধিত বাজেটে প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৩ সালের ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়। এছাড়া, নির্মাণ ব্যয়ও ১৬৪ কোটি টাকা বাড়ানো হয়। চলতি বছরের ১৩ জুলাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের টোল নির্ধারণ করা হয়। এতে মোট ১২ ধরনের যানবাহনকে টোল দেওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।