হাফিজ রশিদ খান »
‘জোস্না কেমন ফুটেছে’ আমার প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ। ১৪ সেপ্টেম্বর ১৯৮২ সালে এটি প্রকাশিত হয় কবিতা পরিষদ-চট্টগ্রাম থেকে। প্রচ্ছদশিল্পীরূপে নাম ছাপা হয় চকরিয়া নিবাসী জিয়াউদ্দিন চৌধুরী ও রাহগীর মাহমুদ-এর। নামলিপিটি জিয়াউদ্দিন চৌধুরীর করা আর প্রচ্ছদের মূল অংশটি কালিদাস-এর ‘মেঘদূত’-এর বুদ্ধদেব বসুকৃত অনুবাদগ্রন্থ থেকে সংগ্রহ করেন কণ্ঠশিল্পী রাহগীর মাহমুদ। যে-কারণে উভয়ের নাম ছাপা হয়। ৪৮ পৃষ্ঠার কাব্যটির প্রকাশক ছিলেন আমার দুলাভাই মোহাম্মদ আলী চৌধুরী। দাম ৮ টাকা।
তখন আমার বয়োক্রম ২১। ১৯৭৯ সালে এইচএসসি পাস করে কবিতার প্রেমে পড়ে নিয়মিত লেখাপড়ায় সাময়িক যতি পড়ে গেছে। আমাদের তখনকার আধাগ্রামীণ-আধাশহুরে পরিবেশের একতলা বাড়ির সামনের উঠোন পেরিয়ে ছিল বড়সড় একটা পুকুরÑ লালাপুকুর। ওটার একপাশে বাতাসের তোড়ে জমা হয়ে থাকা কচুরিপানার ফুলের ওপর ওড়াউড়িরত প্রজাপতির তিরতির কাঁপা পাখার রঙ দেখা, আমাদের ভাড়াঘরে দীর্ঘদিন থাকার পর ভালোলাগা হিন্দু মেয়েটিসহ তাদের পরিবারের নীরবে অন্যত্র চলে যাওয়ার ঘটনা আমাকে একদিকে উচ্ছল, অন্যদিকে কেমন মনমরা ভাবনায় ডুবিয়ে রাখে। একই সময়ে চিন্ময়-সাগর-সুবিনয়-কণিকা আর কাদেরী কিবরিয়ার ক্যাসেটধৃত রবীন্দ্রসংগীত আরেক মনোময় ভাবুকতায় নিমজ্জিত করে। আবার পাশেই ছিলেন আজম খান। অন্য এক দিগন্তছোঁয়া বোহেমিয়ান কথা, তাল ও সুরের তড়পানো তারুণ্য। তখনকার মুসলিম হল, পুরোনো একতলা ভবনের চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব ভবনের আলো-আঁধারি গেট পেরিয়ে শাস্ত্রীয় গানের আসরে নিরালা শ্রোতারূপে হাজিরা দেওয়াÑ এসবের সম্মিলিত অভিঘাতে মনের ভেতরে অদ্ভুত এক পরাজগত তৈরি হয়ে গেল। খবর কাগজের সাহিত্যের পাতায় শামসুর রাহমান আল মাহমুদ শহীদ কাদরী আবুজাফর ওবায়দুল্লাহ সৈয়দ শামসুল হক প্রভৃতির কবিতার তাজা ঘ্রাণ, অন্যদিকে শিথানে থাকা ‘বনলতা সেন’ একত্র হয়ে কবিতা-জাতীয় কিছু পংক্তি লিখিয়ে নিচ্ছে যেন গোপনে-গোপনে। সেই কবিতা থরোথরো আবেগে ভাসতে-ভাসতে কিছু সমবয়সি ও অগ্রজ সাহিত্যরসিকের কানে পৌঁছাচ্ছে। এদের সাহচর্য আর উৎসাহ আদি-অন্তহীন নিজস্ব উল্লাসের কাবতাভাষ্যের অগ্নিকাণ্ডে যেন ঘৃতাহুতি দিতে থাকে অনবরত। তার ওপর ওসব পংক্তিবিন্যাস থেকে কিছু-কিছু সেই সময়ের আজাদী’র পাতায় ছাপা হয়ে গেলে আমার ভেতর থেকে জেগে উঠতে থাকে এক নতুন সত্তাÑ যাকে নানাবিধ অমনোযোগের অভিযোগে সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করেছে ঘরের মানুষেরা। এ কেবল সবুজ হোটেল, নভেলটি, সেন্ট মেরিজ স্কুলের খোলা চত্বর আর চৌরঙ্গী হোটেলের আড্ডায় হই-হুল্লোড়ে মজে থাকতে চায় নাওয়া-খাওয়া ভুলে। এ রকম এক কালের প্রহারে হঠাৎই ঠিক করে ফেলা হলো কবিতার বই প্রকাশ করতে হবে। নামকরণের জন্যে বিশেষ বেগ পেতে হলো নাÑ রবীন্দ্র গীতিভান্ডার থেকেই ওটা নেমে এলো কলমের ডগায়Ñ জোছনা কেমন ফুটেছে। তবে খুব দুঃসাহসী এক কাণ্ডও ঘটলো একক
সিদ্ধান্তে। ‘জোছনা’ হয়ে গেল ‘জোস্না’Ñ ফলে দাঁড়ালো ‘জোস্না কেমন ফুটেছে’।
পরে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হলে জবাব ছিল এই : ওপেন সিলেবলে ‘জোছনা’ খুব সাবধানী উচ্চারণ। যা এ বঙ্গে বিরল। সচরাচর এখানে তা ‘জোসনা’ উচ্চারিত হয়। এ কাব্যের আলোচনা-সমালোচনা হলো ব্যাপকÑ ‘বাংলার বাণী’ ‘সাপ্তাহিক বিপ্লব’ ‘দৈনিক দেশ’ ‘গণকণ্ঠ’ কাগজে। ‘দিও না দুঃখ’ কবিতাটি নিয়ে কথা হয়েছিল বেশ। যার প্রথম স্তবকটি
এমন :
আমাকে দিও না দুঃখ
আমি স্বপ্নের আকাশে আগুন ধরিয়ে দেবো
ধূসর আবিলতায় ছেয়ে দেবো কল্পলোকের ভৈরবী বাগান
অস্বাভাবিক কঠোরতায় কেড়ে নেবো বিম্বাধরের মোনালিসা হাসি
চৈতালি হৃদয়ের সুজলা-সুফলা প্রান্তর করে দেবো ঊষর
প্রেমহীন দুরাত্মা অশ^ারোহীর সন্ত্রাসীর চিৎকার যাবে শোনা …