জেলা প্রশাসক এজাহারুল ফয়েজ: স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব

মোহাম্মদ মুনীর চৌধুরী »

অধ্যাপক এ এফ এম এজাহারুল ফয়েজ প্রশাসনে ও শিক্ষকতায় চট্টগ্রামের এক কীর্তিমান ব্যক্তিত্ব, যাঁর স্মৃতিচারণ করার মত সমসাময়িক প্রজন্ম এ পৃথিবীতে এখন নেই।

১৯০৯ ইং সনে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার ফতেপুর ইউনিয়নের জাহাপুরের মুফতি বাড়িতে তাঁর জন্ম। তদানীন্তন ব্রিটিশ ও পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের এক উজ্জল নক্ষত্র ছিলেন এজাহারুল ফয়েজ, যাঁর সততা, ন্যায়পরায়নতা ও প্রশাসনিক কঠোরতা ছিলো কিংবদন্তীর মতো। নীরবে-নিভৃতে সরকারি গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে তিনি জনসেবা করেছেন নিরবচ্ছিন্নভাবে। তাঁর পিতা ফতেপুরের প্রসিদ্ধ জমিদার ও ঘোড়সাওয়ার মরহুম ফজল বারী চৌধুরী এবং মাতা এয়ার খাতুন। তাঁর মাতৃভক্তি ছিলো অসাধারণ, অতুলনীয়, বৃদ্ধ বয়সেও তিনি মা’কে কোলে তুলে নিতেন এবং প্রাণপনে সেবা করতেন।

এ এফ এম এজাহারুল ফয়েজের ভাইদের মধ্যে ছিলেন কীর্তিমান পুরুষ অধ্যাপক আবুল মনসুর ফয়জুল কবীর (চট্টগ্রাম সরকারি কমার্স কলেজের অধ্যাপক), পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমে শায়িত ভারতের হুগলি কলেজের অধ্যক্ষ এ.কে লুৎফুর আহম্মদ ছিদ্দিকী, মেডিকেল অফিসার ডা. আবুল আব্বাস এবং জাহাপুরের সমাজসেবক জহুরুল আনোয়ার সিদ্দিকি।

চট্টগ্রামের প্রসিদ্ধ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আরআরএসি ইনস্টিটিউশন থেকে এজাহারুল ফয়েজ ১৯২৬ ইং সনে মেট্রিকুলেশনে সব বিষয়ে লেটার পেয়ে মেধা তালিকায় প্রথম স্থান অর্জন করেন। এছাড়া চারিত্রিক দৃঢ়তা, অনলবর্ষী বক্তৃতা, সময়ানুবর্তিতা ও নিয়মানুবর্তিতার জন্য ছাত্র জীবনে অসাধারণ কৃতিত্বের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি বিশেষ পুরস্কার লাভ করেন। ১৯২৮ ইং সনে তিনি পুনরায় মেধা তালিকায় স্থান নিয়ে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। সে সময় চট্টগ্রাম জেলায় বক্তৃতা ও সাহিত্য প্রতিযোগিতায় তিনি আবার শ্রেষ্ঠত্বের পুরস্কার অর্জন করেন।

এরপর বৃত্তি নিয়ে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন এবং ইংরেজিতে অনার্সে ১ম স্থান অর্জন এবং কৃতিত্বের সাথে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। কঠোর অধ্যবসায় ও পরিশ্রমের মাধ্যমে তিনি ব্রিটিশ আমলে উচ্চ শিক্ষায় এ অসাধারণ কৃতিত্ব অর্জন করে রেকর্ড সৃষ্টি করেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তদানীন্তন ভারতবর্ষের কতিপয় শিক্ষকের সাম্প্রদায়িক হীনমন্যতার জন্য তাঁর মেধার সঠিক মূল্যায়ন ও যোগ্যতার যথার্থ মূল্যায়ন হয়নি।

১৯৩৫ ইং সনে বেঙ্গল সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে জনাব এজাহারুল ফয়েজ সরকারি চাকরিতে যোগদান করেন। এর পূর্বে ১৯৩৪ ইং সনে বেঙ্গল এডুকেশন সার্ভিসে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়ে ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজ (বর্তমান হাজী মোহাম্মদ মহসিন কলেজ)-এ কিছুদিন অধ্যাপনা করেন।

চাকুরী জীবনের প্রারম্ভে জনাব এজাহারুল ফয়েজ সেকেন্ড অফিসার ও ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দিনাজপুর, গফরগাঁও ও ইসলামপুরে চাকরি করেন। এরপর জামালপুর, নেত্রকোনা, বরিশাল সদর, সিরাজগঞ্জ, ফেনী ও ফরিদপুরে মহকুমা প্রশাসক (এসডিও) পদে অত্যন্ত দক্ষতা ও সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। সিভিল সার্ভিসে একাধারে এত গুরুত্বপূর্ণ মহকুমাসমূহে প্রশাসক পদে দায়িত্ব পালন ছিলো তাঁর অনবদ্য সাফল্যের স্বীকৃতি। তিনি চাকুরি জীবনে সরকারি তদন্ত বা ইনস্পেকশনে যেয়ে কখনো দাপ্তরিক খরচে কোনো খাবার খেতেন না, একান্ত ব্যক্তিগত খরচে তিনি সরকারি সফরে চাল, ডাল, মরিচ, মসলা ইত্যাদি সংগ্রহ করতেন ও সাথে নিয়ে যেতেন।

এরপর তদানীন্তন পাকিস্তান পার্লামেন্টের স্পীকার মরহুম তজমুদ্দিন খানের (রাশেদ খান মেননের পিতা) একান্ত সচিব পদে ঢাকা ও করাচীতে চাকুরি করেন। এরপর করাচীতে পাকিস্তান তথ্য মন্ত্রণালয়ের আন্ডারসেক্রেটারি পদে কিছুদিন চাকরি করেন। অত:পর রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তান সরকারের উপসচিব পদে চাকুরি করেন।

১৯৬৪ ইং থেকে ১৯৬৮ ইং পর্যন্ত তিনি নোয়াখালী জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, বগুড়া জেলার যুগ্ম জেলা প্রশাসক এবং বগুড়ায় জেলা প্রশাসক পদে চাকুরি করেন। বিভিন্ন কর্ম ক্ষেত্রে তিনি জনকল্যানে বহু অবদান রাখেন। তন্মধ্যে সিরাজগঞ্জ ও জামালপুরে তাঁর উদ্যোগে কলেজ, ঈদগাহ ও কবরস্থান নির্মিত হয়। ১৯৬৮ ইং সনে তিনি সরকারি চাকুরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন।

তাঁর মেধা, পান্ডিত্য ও সততার স্বীকৃতি স্বরূপ বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৩ ইং সনে জনাব এজাহারুল ফয়েজকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য পদে নিয়োগ প্রদান করেন। আমলা হয়েও অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক সংস্কারমূলক কাজ সম্পাদন করেন, যা’ ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে গেছে।

ব্যক্তিজীবনে অত্যন্ত সৎ, নির্লোভ ও ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিত্ব জনাব এজাহারুল ফয়েজ বৃটিশ বা পাকিস্তান সরকারের অন্ধ আনুগত্য করেননি বিধায় তিনি আমলাতন্ত্রের সর্বোচ্চ সোপানে উন্নীত হতে পারেননি। পাকিস্তান আমলে সিএসপি অফিসারদের বৈষম্য ও বঞ্চনারও শিকার হয়েছিলেন তিনি। চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির জাহাপুরে তাঁর স্মৃতি বিজড়িত ভগ্নপ্রায় মাটির ঘরটি কালের সাক্ষী হয়ে আছে।

১৯৭১ সনে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী চট্টগ্রাম শহরে হত্যাযজ্ঞ শুরু করলে জনাব এজাহারুল ফয়েজ পাকিস্তানী সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বহু বাঙালী পরিবারকে রক্ষা করেন। তাঁর কনিষ্ঠ সন্তান এএফএম ফারুক পাকিস্তানী হানাদারদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। পাঁচলাইশ-কাতালগঞ্জ এলাকায় পাকিস্তানি সৈন্যদের অনুরোধ করে তিনি বহু বাঙ্গালী মালিকানাধীন ভবনের ছাদ থেকে মেশিনগান, কামান ইত্যাদি অপসারণ এবং বাড়ি সৈন্যদের দখলমুক্ত করেন।

এ এফ এম এজাহারুল ফয়েজের ইংরেজি, বাংলা ও উর্দুতে জ্ঞান ও পাণ্ডিত্য ছিল অসাধারণ ও ঈর্ষণীয়। চট্টগ্রামের দৈনিক আজাদী পত্রিকায় তিনি ছিলেন একজন কলাম লেখক। অবসরের পর তাঁকে দেখা যেত, লাকড়ী ক্রয় করে রিকশায় চড়ে তার বাসায় আনতেন এবং রান্নার কাজে ব্যবহার করতেন। পুরাতন আসবাবপত্র ও সাদামাটা উপকরণ দিয়ে তিনি অত্যন্ত সহজ-সরল জীবন নির্বাহ করেছেন। তাঁর পিতামহ মুফতি ফয়জুল্লাহ ছিলেন চট্টগ্রাম কলেজের আরবি ও ফারসী বিভাগের স্বনামধন্য অধ্যাপক।

আধ্যাত্মিক চেতনায় ও ধর্মীয় মূল্যবোধে উজ্জীবিত অধ্যাপক এজাহারুল ফয়েজ পদস্থ আমলা হয়েও আড়ম্বরবিহীন জীবন যাপন আমাদের সবার জন্য অনুকরণীয়। ১৯৮৩ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর এএফএম এজাহারুল ফয়েজ ৭২ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। জাহাপুরের আধ্যাত্মিক সাধক হযরত মুফতি গরিবুল্লাহ শাহ (রহ.)-এর মাজার সংলগ্ন কবরস্থানে তিনি শায়িত আছেন। মহান আল্লাহ তা’আলা তাঁকে জান্নাতে সমুন্নত মর্যাদা দান করুন। এ নিবন্ধের লেখক মাতামহসূত্রে এ এফ এম এজাহারুল ফয়েজের দৌহিত্র।

লেখক: সাবেক মহাপরিচালক, জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘর, ইমেইল: [email protected].