সেন্টমার্টিনে পর্যটক ভ্রমণ সীমিতকরণ সিদ্ধান্ত
ঝুঁকিতে পড়বে হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ
সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার চেয়ে দ্বীপবাসীর বিক্ষোভ
নিজস্ব প্রতিবেদক, কক্সবাজার:
দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনে পর্যটক সীমিতকরণ, রাত্রিযাপন নিষিদ্ধকরণের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে জীবিকা হারাতে হবে স্থানীয় বাসিন্দাসহ অন্তত তিন লাখ মানুষকে।
দ্বীপের মানুষগুলো পুরনো পেশায় ফিরতে গিয়ে বাড়বে অপরাধপ্রবণতা। কর্মসংস্থান হারাবে পর্যটনশিল্পে নিয়োজিত লক্ষাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী। ঝুঁকিতে পড়বে বিভিন্ন উদ্যোক্তাদের হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ। তাই জনবিরোধী এমন সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন সেন্টমার্টিনের বাসিন্দারা।
জানা গেছে, ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যটন মন্ত্রণালয় ও পরিবেশ অধিদপ্তরের যৌথ সভায় সেন্টমার্টিনে রাত্রি যাপন নিষিদ্ধকরণসহ আরো বেশ কিছু বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। যা কক্সবাজারের পর্যটন খাতের জন্য মারাত্মক হুমকি স্বরূপ হিসেবে দেখছে সংশ্লিষ্টরা। গণমাধ্যমে এই সিদ্ধান্ত প্রকাশের পর প্রতিবাদ মুখর হয়ে ওঠে সেন্টমার্টিনের বাসিন্দারা। শুক্রবার বেলা তিনটায় সেন্টমার্টিন জেটিঘাটে বিক্ষোভ করেছে স্থানীয়রা। তারা এই সিদ্ধান্ত মানতে নারাজ।
স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য হাবিব খান জানান, পূর্বপুরুষ থেকে তারা সেন্টমার্টিন দ্বীপে বসবাস করে আসছেন। দ্বীপটি পর্যটন স্পট হিসেবে পরিচিত হওয়ার পর থেকে তাদের জীবন-জীবিকার ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি সেন্টমার্টিন নিয়ে সরকারের গৃহীত সিদ্ধান্তে স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। সেন্টমার্টিনদ্বীপে পর্যটন শিল্প বিকশিত হওয়ার পূর্বে এখানকার মানুষ সমুদ্র হতে মাছ আহরণ, প্রবাল উত্তোলন, প্রবাল পাথরকে নির্মাণ কাজে ব্যবহার, মাছের অভয়ারণ্য ধ্বংস, শামুক-ঝিনুক সংগ্রহ করে নানা উপায়ে জীবিকা নির্বাহ করছিল। এতে দ্বীপের পরিবেশ মারাত্মক হুমকীর সম্মুখীন হয়েছিল। পরবর্তীতে পর্যটন শিল্পের বিকাশে মানুষ পর্যটন শিল্পের দিকে ঝুঁকে পড়ে। এখন যদি আগের অবস্থায় ফিরে যেতে হয় তাহলে পরিবেশের যেমন ঘটবে বিপর্যয়, তেমনি পথে বসবে হাজার হাজার মানুষ।
সেন্টমার্টিনের বাসিন্দা আব্দুল মালেক জানান, বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন ভ্রমণ নিরুৎসাহিত করার জন্য অনলাইনে নিবন্ধনের মাধ্যমে প্রতিদিন ১ হাজার ২৫০ জন পর্যটক সেন্টমার্টিন ভ্রমণের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হলে বিদেশি পর্যটক বাংলাদেশ ভ্রমণে না আসার পাশাপাশি দেশীয় পর্যটক কক্সবাজার ভ্রমণে বিমুখ হবে। এতে সেন্টমার্টিন দ্বীপে ভ্রমণ ব্যবসা ক্ষতি হওয়ার সাথে সাথে হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগে গড়ে উঠা কক্সবাজার পর্যটন ব্যবসাও ক্ষতি সাধিত হবে।
পর্যটন ব্যবসায়ী আনোয়ার কামাল জানিয়েছেন, পর্যটনকে ভালবেসে বাৎসরিক মাত্র ৫ মাস ব্যবসা করার ঝুঁকি নিয়ে উদ্যোগক্তাগণ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগে-জাহাজ ব্যবসায়ী, হোটেল, মোটেল, কটেজ, রেস্টুরেন্ট ও ক্ষুদ্র ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে, তাতে বিনিয়োগকারীর পুঁজি হারানোর পাশাপাশি কর্মরত তিন লক্ষাধিক মানুষ ব্যবসা ও কর্মসংস্থান হারাবে।
সি-হিলটপ ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলসের প্রোপ্রাইটর এবং টুয়াকের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এসএম কিবরিয়া খান জানান, কোভিট-১৯ এর প্রভাবে প্রায় ৭ মাস পর্যটন স্পট বন্ধ ছিল। ফলে পর্যটন ব্যবসায়িরা মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখিন হয়েছে। অন্যদিকে পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়িরা সরকারি কোন সহায়তা পায় নি। এমতাবস্থায়, এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হলে পর্যটনশিল্পে ধস নামবে।
এদিকে, পর্যটন ও পরিবেশের মধ্যে সমন্বয় ঘটিয়ে রেসপন্সিবল ইকো ট্যুরিজম বাস্তবায়নের মাধ্যমে সেন্টমার্টিনদ্বীপ নিয়ে সৃষ্ট সংকট নিরসনে ১২টি প্রস্তাবনা দিয়েছেন পর্যটন সংশ্লিষ্টরা।
সেন্টমার্টিনের ব্যাপারে সিদ্ধান্তের আগে জেলা প্রশাসন, সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউট, কোস্টগার্ড, নৌবাহিনী, বিজিবি, পরিবেশ অধিদপ্তর, ট্যুরিজম প্রতিষ্ঠান, জাহাজ মালিক, আবাসিক হোটেল মালিক, বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড, পরিবেশ সংগঠন ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সমূহের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে কমিটির মাধ্যমে সমীক্ষা চালানোর দাবী জানান কক্সবাজার হোটেল মোটেল গেস্ট হাউস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম সিকদার।
সেন্টমার্টিনে পর্যটক ভ্রমণ সীমিতকরণ ও রাত্রিযাপন নিষিদ্ধকরণের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবীতে সংবাদ সম্মেলন করেছে ট্যুর অপারেট অ্যাসোসিয়েশন অব কক্সবাজার-টুয়াক।
শুক্রবার দুপুরে শহরের একটি কনফারেন্স হলে সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন টুয়াকের সভাপতি তোফায়েল আহম্মেদ। তিনি কক্সবাজারের পর্যটনকে বাঁচাতে সব ধরনের ষড়যন্ত্র মোকাবেলা প্রস্তুত আছেন বলে জানান। সেই সাথে পর্যটনখাতের ক্ষতি হয় এমন কোন সিদ্ধান্ত না নিতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি অনুরোধ করেন। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন টুয়াকের সভাপতি।
এ সময় টুয়াকের সিনিয়র সহ-সভাপতি আনোয়ার কামাল, সহ-সভাপতি হোসাইন ইসলাম বাহাদুর, সাধারণ সম্পাদক আসাফ উদ দৌল্লা আশেক, সাংগঠনিক সম্পাদক ফারুক আজম, যুগ্ম সম্পাদক আল আমীন বিশ্বাস, এসএ কাজল, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক সম্পাদক মো. তোহা ইসলাম, শহিদুল্লাহ নাঈম, মোহাম্মদ ইউছুপ, মোহাম্মদ শিবলি সাদেক, মুহাম্মদ মুসা, জিল্লুর রহমান চৌধুরী, আবদুস সাত্তার, সাইম রহমান অভিসহ সংশ্লিষ্টরা উপস্থিত ছিলেন।