জাহিদ হাসান হৃদয়, আনোয়ারা »
সূর্যের আলো বের হওয়ার আগে ঘুম থেকে উঠে পরিবারের জন্য সকালের নাস্তা তৈরি করে নিজের জন্য টিফিন ভরে নিয়ে ব্যাগ হাতে বেরিয়ে যায় তারা। দিনশেষে ক্লান্ত শরীরে গাদাগাদি করে বাসে, সিএনজিতে চেপে বাসায় ফেরার সময় পরিবারের সদস্যের জন্য নিয়ে যায় চিপস, চকলেট, বিস্কিট ইত্যাদি। কেউ পরিবারের জন্য বাজার করে নিয়ে যায়। সারাদিনের খাটুনি শেষে তাদের চোখেমুখে দুর্বলতার কোনো ছাপ দেখা মেলে না। পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্বটা তারা তুলে নিয়েছে নিজেদের কাঁধে।
বলছিলাম চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার জীবন যুদ্ধে এগিয়ে যাওয়া নারী শ্রমিকদের কথা। এরা নারী হয়েও কারো কাছে এরা পিতার মতো, আবার কারো কাছে বড় ভাইয়ের মতো আবার কারো কাছে নিজের ছেলের মতো। পরিবারের প্রয়োজন পূরণ করে যাচ্ছে।
অনেকেই পরিবারের কথা ভেবে নিজেদের পড়াশোনার ইতি টেনে পরিবারের হাল ধরেছে। অনেকেই স্বামীর অসুস্থতা কিংবা স্বামীর মৃত্যু অনুপস্থিতিতে নিজেদের পরিবারকে আগলে রেখেছে। নিজেদের ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার জন্য অনেক নারীরাই খেটে যাচ্ছে রোজ। আবার নিজের বিয়ের টাকা জোগাড় করতেও তারা চালিয়ে যাচ্ছে জীবন সংগ্রাম।
উপজেলায় অবস্থিত কোরিয়ান এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন (কেইপিজেড), সা’দ মূসা ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কসহ বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান কাজ করে যাচ্ছে এমন হাজার হাজার নারী। সকাল-সন্ধা উপজেলার সদর, কালাবিবির দিঘি, চৌমুহনী, বটতলী, সিইউএফএলসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ভরে যায় নারী শ্রমিকদের পাদচারণায়। বাস, সিএনজি, অটোরিকশা, জিপগাড়িসহ বিভিন্ন যানবাহনে গাদাগাদি করে বাড়ি-কর্মস্থলে ফেরার দৃশ্য দেখা যায়।
বছর দশেক আগেও নারীরা নিজের ঘরের ভেতর থেকে কাঁথা সেলাই করা, টুপি বানানো, জাল বোনা, বাঁশ বা পিতলের নানা জিনিস বানানোর মাঝে সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন প্রায় বেশিরভাগ মেয়েরাই শিল্পকারখানায় ছুটছে। ভালো বেতন এবং অন্যান্য প্রয়োজনের কারণে তারা বেছে নিচ্ছেন এই পেশাকে।
উপজেলার অনেক নারী এবং তাদের পরিবারের সাথে কথা বলে জানতে চেয়েছিলাম তাদের জীবন সংগ্রামের কথা।
হাইলধর ইউনিয়নের মাহবুব নামের এক নির্মাণশ্রমিক বলেন, আমাদের বিয়ে হয়েছে আজ ১৪ বছর। একটা মেয়ে আর দুই ছেলেসন্তান রয়েছে। মেয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে আর বড় ছেলে ৪র্থ শ্রেণি এবং ছোট ছেলেটা নার্সারিতে পড়ে। বিয়ের ৭ বছরের মধ্যে অসুস্থতার কারণে আমি কাজকর্ম করতে অক্ষম হয়ে পড়ি। পরবর্তীতে আমার স্ত্রী কেইপিজেডে কাজ করা শুরু করে। সে থেকে আমার স্ত্রীর রোজগার দিয়ে আমাদের পরিবার এবং ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার খরচ চলে। আর আমি ঘওে থেকে কাজকর্ম করি। এমন একজন জীবন সঙ্গী পেয়ে আমি ধন্য।
তাসলিমা খাতুন নামের ৩৫ বছর বয়সী এক মহিলার সাথে কথা হলে তিনি জানান, ২০১২ সালের দিকে আমার স্বামী মারা যান। তখন আমার কোলে আমার দুই মেয়ে আর এক ছেলে ছিলো। আমার বাবার বাড়ির লোকজন বলেছিলো ছেলেমেয়েদের তাদের দাদির কাছে রেখে অন্য জায়গায় বিয়ে বসতে। তবে আমি রাজি ছিলাম না। নিজের মধ্যে একটা জেদ কাজ করছিলো, আমি আমার ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা করিয়ে তাদের বাবার দায়িত্ব পালন করবো। সেই থেকে কেইপিজেডে কাজ করা শুরু করি। এখন আমার বড় মেয়ে একাদশে ১ম বর্ষে, ছোটো মেয়ে ১০ম শ্রেণি এবং ছেলেটা ৮ম শ্রেণিতে পড়ে। আমি হাল ছাড়িনি কখনো। দিনে কারখানায় কাজ করেছি রাতে এসে ঘরের কাজ করেছি। আমি আজ পর্যন্ত ছেলেমেয়েদের তাদের বাবার অভাব বুঝতে দেইনি। এখন শুধু একটাই স্বপ্ন মেয়ে দুটাকে ভালো ঘরে বিয়ে দেওয়া আর ছেলেটাকে মানুষের মতো মানুষ করা।
সাদিয়া নামের আরেক নারী শ্রমিক বলেন, আমার আব্বুর আমরা ৪ মেয়ে। আমি সবার বড়। আব্বু দালান নির্মাণের কাজ করে। কিন্তু আব্বুর একার পক্ষে পরিবারের খরচ সামলিয়ে আমাদের পড়াশোনার খরচ চালানো সম্ভব হচ্ছিলো না। তাই এসএসসির পর পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে কেইপিজেডে কাজ করা শুরু করছি। এখন আব্বু আর আমার যৌথ আয় দিয়ে পরিবারের খরচ এবং বোনদের পড়াশোনার খরচ ভালো মতোই চলে। আমি ছাড়া বাকি তিনবোন সবাই পড়াশোনা করে।
উপজেলায় অবস্থিত সা’দ মূসা ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের সিনিয়র অফিসার এস এম পিন্টুর সাথে কথা হলে তিনি বলেন, আমার প্রতিষ্ঠানে প্রায় দু’হাজার মতো শ্রমিক কাজ করে। তাদের মধ্যে ৫০% নারীশ্রমিক। আমরা ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের সুযোগ সুবিধার দিকে নজর বেশি রাখি, সে হিসেবে প্রতিমাসে শুক্রবার এবং সরকারি ছুটি ব্যতীত মেডিক্যাল ছুটি হিসেবে একদিন এবং পারিবারিক ছুটি হিসেবে একদিন ছুটি দিয়ে থাকি। এছাড়া গর্ভকালীন ছুটি তো আছেই।
কোরিয়ান এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন (কেইপিজেড) এর সহকারী মহাব্যবস্থাপক (এজিএম) মো. মুশফিকুর রহমান বলেন, কোরিয়ান এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন নারী শ্রমিকদের সঠিক কর্ম পরিবেশ নিশ্চিত করেছে। বর্তমানে কেইপিজেডের বিভিন্ন সেক্টরে ২৭ হাজর শ্রমিক কর্মরত আছেন, যার মধ্যে ৮০% নারী শ্রমিক। শুক্রবার এবং অন্যান্য ছুটি মিলিয়ে কোরিয়ান এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোনের বার্ষিক ১০৮দিনের ছুটি রয়েছে। এর বাইরেও কেউ কোনো কারণে ছুটি নিতে চাইলে সেই ছুটি নেওয়ারও সুবিধা রয়েছে।
নারীদের উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডের বিষয়ে উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা শিরীন ইসলাম বলেন, নারীর উন্নয়নে প্রতিটি ইউনিয়নে কিশোর-কিশোরী ক্লাব স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া সারা বছর নারীদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে বিউটিশিয়ান এবং ফ্যাশন ডিজাইনের তিন মাস মেয়াদি কাজ শিখানো হয়। প্রশিক্ষণ চলাকালীন তাদেরকে ২শ টাকা করে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়। এখান থেকে প্রশিক্ষিত হয়ে তারা বিভিন্ন জায়গায় শিক্ষা দিচ্ছেন এবং নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছেন। এছাড়া যৌতুক, বাল্যবিবাহ, বিভিন্ন পারিবারিক সমস্যা নিয়ে উপজেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর নারীদের জন্য কাজ করে যাচ্ছে।