জিমের বন্ধুরা

নুরুল ইসলাম বাবুল »

বিকেলের ফুটবল মাঠ আজ একদম ফাঁকা । জিম এসে দেখল একা একা দাঁড়িয়ে আছে জাহিদ। কিছু একটা আন্দাজ করছিল জিম। তার আগেই জাহিদ জানাল, মাঠের নিয়মিত খেলোয়াড়রা আজ জেলা সদরের টিমে খেলতে গেছে। সেই দলে খেলোয়াড়সহ গেছে অনেকেই। জিম সার্কেলের জাহিদ আর নাঈমের যাওয়ার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত যাওয়া হয়নি ওদের। জাহিদ নিজে থেকেই জানাল সে কথা। মাঠের অন্য পাশ দিয়ে নাঈমকেও আসতে দেখা গেল। কয়েকজন খুদে খেলোয়াড় মাঠের আশেপাশে ঘুরঘুর করলেও এখনো খেলতে নামেনি কেউ। একটু পরে এলো রাসেল। রানা ও শামীম এলো অনেকক্ষণ পর। ওরা ছয়জন সহপাঠী। একসাথে খেলাধুলা করে। কবিতা আবৃত্তি করে। ছবি আঁকার চেষ্টা করে। পড়ালেখায় একে অপরের সহযোগিতা করে।
ক্লাসের প্রথম সারির মেধাবী শিক্ষার্থীদের মধ্যে ওদের নাম সামনের দিকে। তাই পরীক্ষায় তুমুল প্রতিযোগিতা হয় ওদের মধ্যেই। ক্লাসের ফার্স্ট বয় জিমের প্রস্তাবেই এই দল গঠন করেছে ওরা। রানা এর নাম দিয়েছে ’ছয় তারকা’ । অসম্ভব বুদ্ধিমত্তার অধিকারী জিসান মাহমুদ জিম। এই ছয় তারকা দলের দলনেতা। রানা সহ-দলনেতা। যদিও সাহস ও শক্তিতে জাহিদ অনেক এগিয়ে তবুও রানাকে সহকারীর পদ দেওয়া হয়েছে। জাহিদ নিজেই তা প্রস্তাব করেছিল। নাঈম, রাসেল ও শামীম এসব বিষয় নিয়ে মাথা ঘামায় না। নাঈমের শুধু একটাই স্বভাব মুখের সামনে কোনো রকম বাছ-বিচার ছাড়াই যা-তা বলে ফেলে। ‘ছয় তারকা’ গঠনের কারণ আত্ম উন্নয়ন করা, নানারকম ভালো কাজে নিজেদের সম্পৃক্ত করা, মানুষের জন্য সেবামূলক কাজে অংশগ্রহণ করা। গত কয়েক মাস ধরে তারা এরকম নানা কাজ করেছে। আজ মাঠে খেলা না-থাকায় বেশ নিরিবিলি পরিবেশে বসে ছয় তারকা গোষ্ঠী বিশেষ বৈঠকে মনোযোগ দিল। শুরুতে জিম বলল, শুনলাম, গতরাতে চৌধুরী বাড়িতে ডাকাত এসেছিল।
জাহিদ বলল, কেউ কেউ বলছে ভূত এসেছিল।
রাসেল বলল, আর যা-ই বলিস, আমার মনে হয় চৌধুরী বাড়িতেই ওই ভূত বাস করে।
শামীম বলল, তোর ধারণাই সত্য। নিশ্চয়ই চৌধুরী বাড়ির পুরনো ভিটায় ভূতগুলো থাকে।
নাঈম বলল, তোরা বুঝতে পারছিস না। ওগুলো ভূত নয়।
জাহিদ নাঈমকে সাপোর্ট করল।
জিম মনে মনে চিন্তা করছিল। কী হতে পারে।
বেশকিছু দিন হলো জাহিদের মাথায় গোয়েন্দাগিরি করার ভূত চেপেছে। তবে তা অতি মাত্রায় নয়। সুযোগ পেলে ছোটখাট কোনো রহস্য উদঘাটন করার ইচ্ছা। সেটা করতে চায় বন্ধুরা মিলেই। সে কথা মনে করেই জাহিদ বলল, চৌধুরী বাড়ির গতরাতের ঘটনায় কিন্তু রহস্য লুকিয়ে আছে।
জিম বলল, কী বলতে চাস তুই?
জাহিদ এবার আরও জোর গলায় বলল, চৌধুরী বাড়িতে ডাকাত না ভূত এসেছিল তার রহস্য জানা দরকার।
শামীম বলল, বাঘা স্যার তো বললেন এ জন্য থানা আছে। পুলিশ আছে। তাঁরা দেখবেন।
জাহিদ মনের বাসনা খোলাসা করল না। কিছু একটা বলতে গিয়ে নাঈমের কারণে থামতে হলো।
নাঈম গান গাইতে শুরু করল। অসাধারণ গানের কণ্ঠ নাঈমের। এখন সে কবিগুরুর ‘আমরা সবাই রাজা, আমাদের এই রাজার রাজত্বে/ নইলে মোরা রাজার সাথে মিলব কী সত্ত্বে গানটি গাইছে।
নাঈমের গানের শেষে শামীম আবৃত্তি করল কাজী নজরুল ইসলামের ‘লিচু চোর’ কবিতাটি।
তখন আস্তে আস্তে সন্ধ্যা নেমে আসছিল। গোধূলি রং মিলিয়ে যাচ্ছিল। একটু পরেই ভেসে উঠল মুয়াজ্জিনের আযান। মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনিও শোনা গেল। পাখিরা কিচিরমিচির শব্দে ঘরে ফিরে যাচ্ছে। জিম সবাইকে তাড়া দিয়ে বলল, চল, এবার বাড়ি যাই।
সন্ধ্যার পরপরই নিজ হাতে হারিকেনের চিমনি মুছে আলো জ্বালিয়ে নিলো জিম। নিজের পড়ার টেবিলে গিয়ে বসল। পড়ালেখার চাপ নেই। একে তো কেবল নতুন ক্লাসে উঠেছে, তারপর আবার বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা দুদিন পরেই। স্কুলে ক্লাস হয় না। খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার জন্য অনুশীলন করা নিয়ে ব্যস্ত সবাই। তবু প্রিয় পড়ার টেবিলে বসল জিম। বাংলা বই খুলে কয়েকটি কবিতা পড়ল বেশ মনোযোগ দিয়ে। একটু পরে জিমের বাবা বাড়ি ফিরলেন। বড়ো একটা ব্যবসা আছে তাঁর। খুবই ব্যস্ত থাকেন সারাদিন। আজ অনেকটা আগেই ফিরলেন তিনি। ফিরেই দাদার ঘরে গেলেন। জিম লক্ষ্য করেছে বাবা যখনই বাড়ি ফেরেন সবার আগে দাদা-দাদির সাথে দেখা করেন। কথা বলেন। শরীরের বিষয়ে খোঁজ-খবর নেন। কিছু কিছু নরম খাবার এনে দেন। জিমের পড়ার ঘরের পাশেই থাকেন ওর দাদা-দাদি। অনেক বয়স হয়েছে তাঁদের। বাবা ও ঘর থেকেই ডাকলেন, জিম, একটু এদিকে এসো তো?
জিম বাবার কথায় সাড়া দিয়ে বলল, আসছি বাবা।
বাবাকে সালাম দিয়ে সামনে দাঁড়াল সে।
জিমের বাবা একটা প্যাকেট হাতে দিয়ে বললেন, রান্না ঘরে গিয়ে এটা তোমার আম্মুকে দিয়ে এসো। আর তোমার দাদার জন্য একগ্লাস পানি আনো। ঔষধ খাবেন তিনি।
জিম দৌড়ে গেল মায়ের কাছে। সেখানে দাদিও ছিলেন। জিমকে পড়তে বলে নিজেই পানি নিয়ে এলো দাদি।
রাতে একসাথে বসে খাবার গেল সবাই। ঘুমানোর আগে একসাথে বসে নানারকম গল্প করল। এর মধ্যেই জিমের মা জানাল, ভোরবেলা শীতের পিঠা বানাবেন তিনি।
জিম বলল, মা, আমার বন্ধুদের খাওয়ানো যাবে?
শুনে হাসলেন জিমের বাবা-মা। দাদা-দাদিও হাসলেন।
মা বললেন, ভোরে ঘুম থেকে উঠেই ওদের ডেকে নিয়ে এসো।
বাবা বললেন, হ্যাঁ। নিয়ে এসো ওদের। ভাপা পিঠা গরম গরম খেতে হয়।
আনন্দে জিমের চোখে খানিকটা জল এসে গেল।