জালিয়াতির মাধ্যমে বিটুমিন মার্কেট নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ

নিজস্ব প্রতিবেদক »

নিজেদের কোনো বিটুমিন প্ল্যান্ট নেই অথবা তারা কোনো আমদানিকারকও নয়। অভিযোগ রয়েছে, এরপরও জাল-জালিয়াতির নানা কৌশলে দেশের বিটুমিন মার্কেট নিয়ন্ত্রণ করছে রহমান কর্পোরেশন নামে একটি প্রতিষ্ঠান। আর এর কর্ণধার হচ্ছেন মোস্তফা কামাল।
সড়ক উন্নয়নে জড়িত প্রকৌশলী ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টেকসই সড়কের জন্য ভালো মানের বিটুমিন ব্যবহারের বিকল্প নেই। এজন্যে ৬০-৭০ গ্রেড এবং তার কম গ্রেডের বিটুমিন ব্যবহার করতে হবে। সঠিক মান বা গ্রেডের বিটুমিন ব্যবহার নিশ্চিত করতে কঠোর অবস্থানের কথা জানিয়েছে সড়ক ও জনপথ বিভাগ এবং স্থানীয় সরকার ও প্রকৌশল বিভাগ।
জানা যায়, মোস্তফা কামাল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আবদুল মোনায়েমের হাত ধরে বিটুমিন পরিবহনের কাজ শুরু করেছিলেন। পরিবহনের কাজ করতে গিয়ে বিভিন্ন ঠিকাদারের সঙ্গে পরিচয়ের সূত্রে তিনি নিজেই বনে যান সরবরাহকারী। তার কেনো বিটুমিন প্ল্যান্ট নেই বা আমদানি করেন না; কিন্তু পুরো দেশে মানহীন বিটুমিন মার্কেটের নিয়ন্ত্রণ করেন। বিটুমিনের কালোবাজার নিয়ন্ত্রণ করে এই খাতের গডফাদার পরিচিতি লাভ করেন।
অভিযোগ রয়েছে, রহমান কর্পোরেশনের কর্ণধার মোস্তফা কামাল তার গড়ে তোলা দালাল সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বিভিন্ন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছে প্রকৃত বাজার দরের চেয়ে কম মূল্যে বিটুমিন বিক্রির আদেশ নেন।
কম দামে বিটুমিন দিলেও ইস্টার্ন রিফাইনারির ক্ষেত্রে ৮০-১০০ গ্রেডকে ৬০-৭০ গ্রেড বলে চালিয়ে দেওয়া হয়। আবার প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে আঁতাত করে পরিমাণেও কম দেওয়া হয়। রহমান করপোরেশন বিটুমিন আমদানি করে না, অথচ আমদানিকারকদের থেকেও কম দামে বিক্রি করে। ফলে এখানে গ্রেড জালিয়াতি ও পরিমাণে কম দেওয়া হয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। আর এতে একদিকে যেমন সড়ক নষ্ট হচ্ছে, অন্যদিকে সরকারের রাজস্ব ক্ষতিও বাড়ছে।
সাধারণত সড়ক ও স্থানীয় সরকার বিভাগের সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা ইস্টার্ন রিফাইনারির সিল দেখলে সেই বিটুমিনের মান নিয়ে আর কোনো আপত্তি তোলেন না অথবা এ নিয়ে ল্যাব টেস্টের বিষয়টিও মাথায় আনেন না। সেই সুযোগটিকেই কাজে লাগান মোস্তফা কামাল।
ইস্টার্ন রিফাইনারিতে উৎপাদিত বিটুমিনকে সরকারি কাজ বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলো প্রাধান্য দেয় বলে প্রতারক চক্র এখান থেকে বিটুমিন নিয়ে তাদের জালিয়াতির ফাঁদ পাতে। জানা যায়, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের মালিকানাধীন ইস্টার্ন রিফাইনারিতে উৎপাদিত ৮০-১০০ গ্রেডের বিটুমিন নিজস্ব ড্রামে ভরে ৬০-৭০ গ্রেডের বিটুমিন হিসাবে বিক্রি করা হচ্ছে। তারা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্যাড ও স্বাক্ষর জাল করে চাহিদার কয়েকগুণ বেশি বরাদ্দ নিয়ে থাকে। এমনকি এক্ষেত্রে একাধিক সরবরাহকারী থাকলেও কৌশলে অধিকাংশ বিটুমিনই রহমান কর্পোরেশন উত্তোলন করে।
বিপিসি সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রাম নগরীর লালখানবাজার থেকে শাহ আমানত বিমানবন্দর পর্যন্ত সাড়ে ১৫ কিলোমিটারের এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নামে জালিয়াতি ও প্রতারণার মাধ্যমে বিটুমিন নেন রহমান কর্পোরেশনের মালিক মোস্তফা কামাল। বিষয়টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স- রেনক্যান জেভির নজরে আসে। এর পর ওই দায়িত্ব থেকে তাদের অব্যাহতির কথা বিপিসিকে জানানো হয়।
এদিকে পদ্মা অয়েল কোম্পানি লিমিটেড থেকেও বিটুমিন উত্তোলনে জালিয়াতি করেছে রহমান করপোরেশনসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি করেছে বিপিসি। গত ২৩ জানুয়ারি বিপিসির মহাব্যবস্থাপক (অর্থ) মুহাম্মদ মোরশেদ হোসাইন আজাদকে আহ্বায়ক করে গঠিত কমিটিকে ১০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মুহাম্মদ মোরশেদ হোসাইন আজাদ সুপ্রভাত বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমাদের পূর্বের অফিস অর্ডারের কিছু সংশোধনী আছে। পূর্বের অফিস অর্ডারের সাথে কক্সবাজার এবং রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন, এখানেও বিটুমিনে অনিয়ম আছে কি-না এ বিষয়টাও তদন্ত করার জন্যে আমাদের কমিটিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আমরা পূর্বের অফিস অর্ডারের কার্যপরিধি অনুযায়ী সংশ্লিষ্টদের কাছে তথ্য চেয়ে চিঠি দিয়েছি। পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে চিঠি দেওয়ার জন্যে বলেছি। যেহেতু অধিভূক্ত এলাকাগুলো অনেক বড় তাই আমরা আমাদের কর্তৃপক্ষকে বলেছি, এ প্রতিবেদন দাখিলের সময়সীমা একটু বর্ধিত করার জন্যে। পুরো বিষয়টা যদি অনুসন্ধানের মাধ্যমে তুলে আনা না যায় তাহলে তো প্রতিবেদন নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন অনেকেই। আমরা চাচ্ছি এ বিষয়ে একটা বস্তুনিষ্ঠ প্রতিবেদন দাখিল করতে। সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের কাছ থেকে তথ্য-উপাত্ত পেলে আমরা পরবর্তী স্টেজে জিজ্ঞাসাবাদে যাবো। ’
অভিযোগ রয়েছে, বিআরটি প্রকল্পের জাল প্রজেক্ট পেপার তৈরি করে পদ্মা অয়েল থেকে বিটুমিন নেয় রহমান কর্পোরেশন। এর সঙ্গে জড়িত লিটন ও পারভেজ নামে দুজন। কক্সবাজার ও রাজশাহী বিমানবন্দর প্রকল্পের কাজ করেন মীর আক্তার হোসেন; তাদের নথিপত্র জাল করে ইএলবিএল (ইস্টার্ন লুব্রিকেন্ট ব্ল্যান্ডার্স লিমিটেড) থেকে রহমান কর্পোরেশন সিন্ডিকেট সদস্য শরীফ, রাজিব, কামরুল ও সাদেকের সহায়তায় বিটুমিন উত্তোলন করে। মেঘনা থেকে ছাড় নিতে রেজওয়ান, বাদশা, রাজিব; এসএওসিএলে (স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানি লিমিটেড) কামরুল, লিটন, পারভেজ এবং যমুনায় চক্রের সদস্য হিসাবে কাজ করেন মুজিব। এই সিন্ডিকেটের প্রধান রহমান কর্পোরেশনের পারভেজ, রাজিব, লিটন, কামরুল ও মুজিব।
জানা যায়, ইস্টার্ন রিফাইনারির বিটুমিন বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ইস্টার্ন লুব্রিকেন্ট ব্ল্যান্ডার্স লিমিটেড ও স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানি লিমিটেড। এখানকার কিছু কর্মকর্তার সঙ্গে যোগসাজশে চলে জালিয়াতি। বিটুমিন বরাদ্দ কমিটির পকেটে থাকে বিপণন ও বিতরণের তালিকা।
জানা যায়, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন, কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কাছে বিটুমিনের চাহিদা রয়েছে। তারা ঠিকাদারদের প্রত্যয়নপত্র দিয়ে রাখেন; সেটি প্রদর্শন করে প্রভাব খাটিয়ে বেশ কয়েকটি সিন্ডিকেট পদ্মা, মেঘনা, যমুনা থেকে বিটুমিন বরাদ্দ নেয়। এতে ছোট ঠিকাদাররা চাইলেও বিপণন কোম্পানিগুলো থেকে বিটুমিন পায় না। এতে বাধ্য হয়ে সিন্ডিকেট সদস্যদের কাছ থেকে বেশি দামে নিতে হয় এবং ড্রাম প্রতি সরকারি দরের চেয়ে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত বাড়তি দর গুনতে হয়।
অভিযুক্ত রহমান করপোরেশনের কর্ণধার মোস্তফা কামাল বিটুমিন জালিয়াতি এবং এতে তার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, ‘এটা কোনো একটা চক্র আমার পেছনে লাগছে। বিটুমিন তো আমি বানাই না, আমি নিম্নমানের দেবো কোত্থেকে? আমার কাছে রিফাইনারির (ইস্টার্ন রিফাইনারি) ১০০ গ্রেডের বিটুমিনের কোনো কাগজই (পেপার) নাই। আমার কাছে আছে ৬০-৭০ গ্রেডের কাগজ। আমরা ক্যারিয়ার, আমরা ক্যারিং করি। এটা আমার সঙ্গে ব্যক্তিগত শত্রুতা ছাড়া আর কিছু নয়।’ তার বক্তব্যের রেশ টেনে তিনি আরও বলেন, ‘কিসের সিন্ডেকেট, আমি নিজেই বিটুমিন পাচ্ছি না। আমরা ইস্টার্ন রিফাইনারির কাছে চিঠি দিয়ে জানতে চেয়েছি, কালো তালিকাভূক্ত প্রতিষ্ঠানকে বিটুমিন দিচ্ছেন অথচ জাতীয় মেগা প্রকল্পের জন্যে বিটুমিন দিচ্ছেন না, কারণ কি? সেখানে আমাকে এখন আসামি বানিয়ে ফেলা হয়েছে।’
অভিযোগ রয়েছে, প্রকল্প বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠানের জাল প্রত্যয়নপত্র বানিয়েও বিটুমিন তুলে নেওয়া হয়। এক্ষেত্রে প্রত্যয়নপত্রের মাধ্যমে বিটুমিন বরাদ্দের প্রচলন বন্ধ করে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধির উপস্থিতিতে বিটুমিন খালাসের সুযোগের দাবি খাতসংশ্লিষ্টদের। এতে জাল-জালিয়াতি ও অতিরিক্ত বা ভেজাল বিটুমিন সরবরাহ বন্ধ হবে বলে মনে করেন তারা।