‘জান্তা বাহিনীর চাইতেও বেশি নির্যাতন চালায় আরাকান আর্মি’

শঙ্কায় উখিয়া-টেকনাফে বসবাসরত রোহিঙ্গারা

জিয়াবুল হক, টেকনাফ (কক্সবাজার) »

মিয়ানমারে চলমান সংঘর্ষ ও আরাকান আর্মি রাখাইন রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ শহর ও সীমান্ত চৌকি পুরোপুরি দখলে নেওয়ায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন উখিয়া-টেকনাফে বসবাসরত রোহিঙ্গারা। নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের আশঙ্কাও করছেন তারা।
রোহিঙ্গাদের ওপর বেশি নির্যাতন করে আরাকান আর্মি : মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দেশটির জান্তা বাহিনী ও আরাআসা রোহিঙ্গা ছৈয়দ হোসেন বলেন, রাখাইনে আমাদের সংসারে অভাব ছিল না, নিজের যা সম্পদ ছিল তা দিয়ে খুব সুন্দরমতো সংসার চলতো। কিন্তু আরাকান আর্মির নির্যাতন সইতে না পেরে আমার পরিবারসহ আরও অন্যান্য প্রতিবেশী পালিয়ে উখিয়া উপজেলার থাইংখালিতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছি। রাখাইনে কোনো চিকিৎসাসেবা নেই। খাবার সংকটও তৈরি হয়েছে। পাহাড়ে পাহাড়ে অবস্থান করে কোনোরকমে পরিবার নিয়ে বাংলাদেশে চলে আসতে পেরেছি।
মিয়ানমারের বুচিদং থেকে পালিয়ে থাইংখালি ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া জাহাঙ্গীর আলম নামে এক রোহিঙ্গা যুবক বলেন, রাখাইনে আরাকান আর্মি রোহিঙ্গা যুবকদের টার্গেট করে ধরে নিয়ে যেতো, এতে অনেক রোহিঙ্গা যুবক তাদের নির্যাতনে নিহত হয়েছেন। জান্তা বাকিান আর্মির মধ্যে চলমান যুদ্ধে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত, নির্যাতন ও হত্যার শিকার হয়েছেন রোহিঙ্গারা। এ যুদ্ধে বাড়িঘর, সন্তান ও পরিবার পরিজন হারিয়েছেন বলে জানিয়েছেন রাখাইন থেকে উখিয়া ও টেকনাফে পালিয়ে আসা নতুন রোহিঙ্গারা।
উখিয়া উপজেলার থাইংখালি ১৪ নম্বর ক্যাম্পে অস্থায়ীভাবে বসবাসকারী ও রাখাইনের বুচিদং থেকে ১৪ আগে পালিয়ে হনীর চাইতেও বেশি নির্যাতন চালায় আরাকান আর্মি। রোহিঙ্গাদের বাড়ি-ঘর তারা জ্বালিয়ে দিয়েছে। আমি রাখাইনে পড়াশোনা করতাম। রাখাইনে যুদ্ধের কারণে আরাকান আর্মির নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে বহু কষ্টে পালিয়ে আসতে পেরেছি। আরাকান আর্মি আমার নিজের ভাইকে ধরে তাদের ক্যাম্পে রেখে দিয়েছে। এখনো তারা ছেড়ে দেয়নি।
দালালদের মাধ্যমে পাচার বেড়েছে: নৌকা দিয়ে নাফনদী পার হয়ে আসা টেকনাফ উপজেলার হ্নীলা ইউনিয়নের আলীখালী ক্যাম্পে বসবাসকারী নতুন রোহিঙ্গা ও মংডুর বাসিন্দা আমির হোসেন বলেন, রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর সবচাইতে বেশি নির্যাতন চালায় আরাকান আর্মি। আরাকান আর্মি বলছে, রোহিঙ্গারা নিজেদের ভিটেমাটি ছেড়ে আরাকান আর্মির তৈরি করে দেওয়া ছোট ছোট ঘরে থাকতে হবে। মংডুর বাসিন্দা আমির হোসেন আরও বলেন,‘আমিসহ এক নৌকা করে ১৯ জনের মানুষ পুরাতন রোহিঙ্গাদের সাথে যোগাযোগ করে জনপ্রতি ৩০ হাজার টাকা দিয়ে নাফনদী পার হয়ে আসতে হয়েছে।’
এ ব্যাপারে উখিয়া কুতুপালং ক্যাম্পে বসবাসকারী ও আরকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের সভাপতি ডাক্তার জুবায়ের বলেন, ‘মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে গত ১১ মাসের চলমান যুদ্ধ থেকে হাজার হাজার রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে উখিয়া-টেকনাফ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছেন। আমরা বিশ্ব রাষ্ট্রের কাছে দাবি জানাচ্ছি, নিরাপত্তা ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের মাধ্যমে নিজ দেশ মিয়ানমারের রাখাইনে ফিরতে চাই। তাই আমরা বিশ্ববাসীর কাছে অনুরোধ করবো রাখাইনে আরাকান আর্মি রোহিঙ্গাদের ওপর যে নির্যাতন ও দমন-পীড়ন চালাচ্ছে সেগুলো বন্ধ করতে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা যখন রাখাইনে ছিলাম তখন জান্তা বাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর বিভিন্ন ইস্যু তৈরি করে নির্যাতন করতো, নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করতো। তবে আরাকান আর্মি আমাদের ওপর দমন-পীড়ন চালিয়েছে বেশি। বাড়িঘরে চুরি-ডাকাতি করেছে। বিষয়টি জান্তা সরকারকে জানালেও বিচার পাওয়া যেতো না।’
‘বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের দেশ নয়। আমরা এখানে মানবিক আশ্রয়ে রয়েছি। মিয়ানমার আমাদের নিজ মাতৃভূমি। জান্তা সরকার আমাদের নিরাপত্তা ও নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করলে আমরা চলে যাবো। এভাবে ক্যাম্পের ছোট ঘরে আর কতদিন থাকবো? রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে জাতিসংঘসহ বিশ্ববাসীকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাই।’
একই কথা বলেন, আরাকার রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের উপদেষ্টা মো. তৈয়ব। তিনি বলেন, ‘আরাকান আর্মি একটি সন্ত্রাসী সংগঠন। তাদের কোনো জবাবদিহিতা নেই। তাদের অত্যাচার ও নির্যাতনের বিচার কাদের কাছে দেবো? আরাকান আর্মির চেয়ে মিয়ানমারের জান্তা সরকার আমাদের জন্য অপেক্ষাকৃত ভালো ও নিরাপদ ছিল।’
এ বিষয়ে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শেখ এহসান উদ্দিন বলেন, যেহেতু মিয়ানমারের রাখাইনের মংডু শহরসহ গুরুত্বপূর্ণ সীমান্ত চৌকি পুরোপুরি আরাকান আর্মি দখল করেছে, সেক্ষেত্রে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বিজিবি ও কোস্টগার্ডের সদস্যরা নাফনদীতে সতর্ক অবস্থানে রয়েছেন।
প্রসঙ্গত, গত ১১ মাস ধরে রাখাইন রাজ্য দখলে নিতে আরাকান আর্মি ও মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সঙ্গে তীব্র লড়াই চলে। বর্তমানে বাংলাদেশ-মিয়ানমার ২৭০ কিলোমিটার সীমান্তের পুরোটাই আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে। সেইসঙ্গে রাখাইনের সেনা ক্যাম্প, মংডু শহরসহ গুরুত্বপূর্ণ এলাকা দখলে নিয়েছে আরাকান আর্মি।