জাতীয় শক্তি পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণে নিয়ামক

রায়হান আহমেদ তপাদার »

পররাষ্ট্রনীতি হলো কোনো সার্বভৌম রাষ্ট্রের গৃহীত সেসব নীতি যা রাষ্ট্র তার রাষ্ট্রীয় স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে যোগাযোগ রক্ষার ক্ষেত্রে সম্পাদন করে থাকে। অন্য রাষ্ট্রের মতো বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে রাষ্ট্রের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতাকে তুলে ধরে এমনকি জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও সমতার প্রতি শ্রদ্ধা, অপর রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা, আন্তর্জাতিক বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধান এবং আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘের সনদে বর্ণিত নীতিসমূহের প্রতি শ্রদ্ধা, এ সকল নীতিই হবে রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভিত্তি।পররাষ্ট্রনীতি বিশারদরা প্রায়ই বলে থাকেন, এটি হচ্ছে অভ্যন্তরীণ রাজনীতির সম্প্রসারিত অংশ। আর জাতীয় নেতৃত্বই তা নির্ধারণ করেন।জাতীয় নেতৃত্বের দায়িত্ব জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণ। এটি নীতিগত বিষয়। সুতরাং পররাষ্ট্রনীতি ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতার স্বার্থেই পরিচালিত হয়; এটাই বাস্তবতা। গোটা বিশ্বব্যাপী চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে বাংলাদেশের জন্য তা বিব্রতকর। চীন যেভাবে বাংলাদেশের উন্নয়ন ও নিরাপত্তায় জড়িয়ে গেছে তাতে বাংলাদেশের আশঙ্কিত হওয়ার কারণ রয়েছে।
অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় রূপকল্পে ভারতের একটি বিশেষ অবস্থান রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য হচ্ছে ভারতকে দিয়ে চীনকে ঠেকানো। সবারই জানা কথা, চীন-ভারত শত্রুতা অনেক পুরনো। অতি সাম্প্রতিক সময়ে চীন-ভারত উত্তেজনা বেড়েছে। চীনের আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক প্রকল্প- বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ-বিআরআইকে ব্যর্থ করে দেয়ার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নানা ধরনের ফন্দিফিকির আঁটছে। চীনকে ঠেকানোর লক্ষ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আসিয়ান জোটভুক্ত দেশগুলোর সাথে সামরিক সহযোগিতা অনেক বৃদ্ধি করেছে। এটি এখন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বাধিক অগ্রাধিকারের বিষয়। বাংলাদেশ যদিও সবার সাথে সখ্য এবং সহযোগিতার নীতি অনুসরণ করছে তবুও যখন সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে- তা বাংলাদশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে বাধ্য। একজন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক প্রশ্ন তুলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র-চীন দ্বন্দ্বে কার পক্ষ নেবে বাংলাদেশ? বিষয়টি গুরুতর এবং জাতীয় নেতৃত্বের জন্য কঠিনতর পরীক্ষা। উল্লেখ্য, বৈশ্বিক রাজনীতিতে কোনো দেশের সুস্পষ্ট নীতি ও অবস্থানের যেমন প্রভাব থাকে, তেমনি তার অনুপস্থিতিরও প্রভাব পড়ে। এটি বিশেষ করে সেই সব রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, যেগুলো রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে শক্তিশালী। সেই দিক থেকে আমাদের প্রথমেই দেখা দরকার যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান কী-বৈশ্বিক জিডিপির ২৪ দশমিক ৭ শতাংশ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের। তার পরে আছে চীন, যার অংশ হচ্ছে ১৫ দশমিক ১ শতাংশ।
অন্যদিকে সামরিক শক্তির দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান শীর্ষে। মোট বাজেট বরাদ্দ হচ্ছে ৫৯৬ বিলিয়ন ডলার, যা পরবর্তী সাতটি দেশ-চীন, সৌদি আরব, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, ভারত, ফ্রান্স ও জাপানের সম্মিলিত ব্যয় ৫৬৭ বিলিয়নের চেয়ে বেশি। ২০১৫ সালের আগস্ট মাসে পলিটিকোতে প্রকাশিত এক নিবন্ধে ডেভিড ভাইন দেখিয়েছিলেন যে পৃথিবীর ৭০টি দেশে ছোট-বড় মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটি আছে ৮০০। প্রত্যক্ষভাবে যুক্তরাষ্ট্র একাধিক সংঘাতে জড়িত রয়েছে। এর মধ্যে আফগানিস্তানের যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সংযুক্তি ইতিহাসের দীর্ঘতম। ইরাকেও যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্যরা উপস্থিত আছে। সরকারি হিসাবে সাড়ে ১৩ হাজার মার্কিন সৈন্য ‘ওয়ার জোন’ বা যুদ্ধক্ষেত্রে রয়েছে। বৈশ্বিক শক্তিগুলোর মধ্যে এক দশকের বেশি সময় ধরে প্রভাববলয় বাড়ানোর যে প্রতিযোগিতা চলছে, সেখান থেকে যুক্তরাষ্ট্র তাকে সরিয়ে রাখতে চায় কি না, সেটাই বোঝার জন্য দরকার একটি সুস্পষ্ট পররাষ্ট্রনীতি, যা ট্রাম্প প্রশাসন এখনো তুলে ধরেনি। এই শূন্যতার ফলে আঞ্চলিক শক্তিগুলো নিজ নিজ অঞ্চলে তাদের আধিপত্য বাড়াতে পদক্ষেপ নেবে। ইতিমধ্যেই আমরা বিভিন্ন অঞ্চলে তার লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি। সিরিয়াকে কেন্দ্র করে ইরান-তুরস্ক-সৌদি আরবের আঞ্চলিক দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় চীন ও ভারতের দ্বন্দ্ব এবং রাশিয়ার প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা সহজেই চোখে পড়ে। আফগানিস্তানে সম্প্রতি চীনা সৈন্যদের উপস্থিতির যে খবর বেরিয়েছে, তাকে চীন মহড়ার অংশ বলে বর্ণনা করলেও অনেকেই একে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব বাড়ানোর চীনের বর্তমান নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলেই মনে করেন।

যুক্তরাষ্ট্র কোন ধরনের জোটের সঙ্গে যুক্ত, কারা তার মিত্র, অন্য দেশগুলোর সঙ্গে তার সম্পর্ক কী। পররাষ্ট্রনীতি যেমন একটি দেশের প্রতিরক্ষানীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, তেমনি সংশ্লিষ্ট তার বাণিজ্যনীতির সঙ্গেও। এতটা গুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও পররাষ্ট্রনীতির বিষয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের নীরবতা বিস্ময়কর। ফলে আমাদের নির্ভর করতে হবে আকার-ইঙ্গিতের ওপরই জাতীয় নিরাপত্তার অজুহাতে সাতটি মুসলিমপ্রধান দেশ থেকে যাতায়াতের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ আদালতে স্থগিত হয়ে গেলেও তা সংশোধিতভাবে আবারও জারি করা হয়েছে সোমবার, যাতে ইরাককে তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এই পদক্ষেপে স্পষ্ট যে ইরান এবং মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কিছু দেশের সঙ্গে ট্রাম্প প্রশাসন বৈরিতার পথই বেছে নিয়েছে। উপরন্তু আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ ও সহিংস উগ্রপন্থাকে র‌্যাডিক্যাল ইসলামিক টেররিজম বলে চিহ্নিত করার মাধ্যমে তিনি মুসলিম জনগোষ্ঠীর সঙ্গে একধরনের দূরত্বই শুধু তৈরি করছেন না, সন্ত্রাসীদের হাতে প্রচারের অস্ত্রও তুলে দিচ্ছেন। ২০১৭ সালে প্রতিশ্রুতির চেয়ে কম শরণার্থী গ্রহণের সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিকভাবে যেসব প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, সেগুলো পুনর্বিবেচনার নামান্তর। একইভাবে আমরা জলবায়ু চুক্তির বিষয়টিকেও দেখতে পারি, কেননা জলবায়ুবিষয়ক জাতিসংঘের সংস্থা ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জের নির্বাহী সেক্রেটারি প্যাট্রিসিয়া এস্পিনোজা জানিয়েছেন, তিনি রেক্স টিলারসনের সঙ্গে বৈঠক করতে চেয়েছিলেন কিন্তু তাঁর পক্ষ থেকে কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।
সম্প্রতি ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (টিপিপি) থেকে প্রত্যাহার কেবল বাণিজ্যিক জাতীয়তাবাদের ইঙ্গিত নয়, অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র তার প্রভাব বিস্তারের জন্য সফট পাওয়ারের চেয়ে হার্ড পাওয়ারের দিকেই ঝুঁকে পড়ছে বলে মনে হয়। কূটনীতি, মানবিক সাহায্য ও উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের চেয়ে শক্তি প্রদর্শনই এই প্রশাসনের নীতি বলে আমরা ধরে নিতে পারি। একদিকে একলা চলো বলে বিশ্বের বহুজাতিক সংস্থাগুলো থেকে যুক্তরাষ্ট্র দূরে সরে থাকছে, অন্যদিকে সামরিক শক্তি আরও বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি-বিষয়ক শূন্যতার প্রতিক্রিয়া কেবল যে যুক্তরাষ্ট্রের ওপরই পড়ছে তা নয়, তার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে অন্য দেশগুলোর ওপরও। ন্যাটোবিষয়ক পরস্পরবিরোধী বক্তব্য ও অবস্থানের কারণে ইউরোপের দেশগুলোই কেবল সংশয়ে আছে তা নয়, পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো তাদের নিরাপত্তা নিয়েও চিন্তিত। কেননা, ন্যাটো এবং যুক্তরাষ্ট্রের দুর্বল অবস্থানের সুযোগে রাশিয়া তাদের ওপর চাপ সৃষ্টির সুযোগ পাচ্ছে। অন্যদিকে এশিয়ায় চীনের প্রভাববলয় বৃদ্ধির যে সুযোগ তৈরি হয়েছে, তা কেবল অর্থনৈতিক নয়, সামরিকও বটে। বিভিন্ন অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতি বা সংশ্লিষ্টতা যে সব সময়ই ইতিবাচক হয়েছে, এমন যেমন দাবি করা যাবে না, তেমনি কোনো অঞ্চলে এককভাবে বড় একটি শক্তির একচ্ছত্র আধিপত্যও ছোট দেশগুলোর জন্য কোনো ইতিবাচক কিছু নয়, সেটাও মনে রাখা দরকার।
ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে এই শূন্যতার একটা বড় কারণ হচ্ছে, ট্রাম্পের রাশিয়া বিষয়ক জটিলতা। রাশিয়ার সঙ্গে তাঁর নির্বাচনী প্রচার দলের যোগাযোগের বিষয়টি এখন কেবল সন্দেহের বিষয়ে সীমিত নেই, ইতিমধ্যেই আইনমন্ত্রী জেফ সেশনসহ অনেকেরই রাশিয়ার রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে যোগাযোগের প্রমাণ মিলেছে। এ নিয়ে রিপাবলিকান পার্টির কোনো কোনো নেতা আনুষ্ঠানিক তদন্তের দাবিতে ডেমোক্র্যাটদের সুরে কথা বলতে শুরু করেছেন। কংগ্রেসের সামনে এটা নিয়ে সেশনের বক্তব্য মিথ্যাচার কি না, সেই প্রশ্নও উঠছে। এসব বিতর্কের মধ্যেই ট্রাম্প কোনো রকম প্রমাণ ছাড়াই সাবেক প্রেসিডেন্ট ওবামার বিরুদ্ধে আইনভঙ্গের অভিযোগ তুলেছেন, যা এমনকি এফবিআইপ্রধান পর্যন্ত সঠিক নয় বলেই বলেছেন। সময়ের পরিবর্তনের সাথে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির ভবিষ্যৎ অর্জনের সম্ভাবনা অনেকটা ক্ষীণ হয়ে পড়ছে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ তার প্রতিবেশী এবং আঞ্চলিক রাষ্ট্রসমূহের সাথে এবং বিশ্বের আরো কিছু রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূলনীতি সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে শত্রুতা নয় এটি সত্তরের দশকের ধারণা, যা প্রায় ৪৫ বছরের পুরনো। বর্তমান পরিবর্তিত বিশ্ব প্রেক্ষাপটে পুরনো ধারার পরররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করে বাংলাদেশ প্রতিনিয়ত তার অর্জনের সম্ভাবনা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। সুতরাং পররাষ্ট্রনীতির লক্ষ্য নিয়ে নতুন কৌশল-পরিকল্পনা করা উচিত, যার মাধ্যমে পরিবর্তিত বিশ্বে নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের পথে বাংলাদেশ এগিয়ে যেতে পারে।

লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট
ৎধরযধহ৫৬৭@ুধযড়ড়.পড়স