আজ ভয়াল ২৫ মার্চ, বাঙালির জাতীয় জীবনে কালরাত। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ৯ মাস নিরস্ত্র বাঙালির ওপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর চালানো বর্বর গণহত্যার ভয়াবহ স্মৃতি ইতিহাসের এক মর্মন্তুদ অধ্যায়। ২৫ মার্চকে ‘জাতীয় গণহত্যা দিবস’ পালনের প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয় জাতীয় সংসদে ২০১৭ সালের ১১ মার্চ। ২৫ মার্চের মধ্য রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রাবাস, শিক্ষক কোয়ার্টার, পিলখানা বিডিআর সদর দফতর, রাজারবাগ পুলিশ লাইন, আবাসিক এলাকাসহ ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় হামলা চালিয়ে নিরীহ মানুষ হত্যা করে। ঐ রাতে তাঁরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের পূর্বে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং বাংলাদেশের জনগণকে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ ও স্বাধীনতার সংগ্রামে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যেতে আহ্বান জানান।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণের পূর্বপর্যন্ত পাকিস্তানি সৈন্য ও তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার আলবদর গোষ্ঠী ৩০ লক্ষ নিরীহ নারী পুরুষ শিশু হত্যা করে। তিন লক্ষ মা বোনের সম্ভ্রমহানি ও তাদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। মানুষের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়, তাদের সহায় সম্পদ লুঠ করে, দুঃসহ নিপীড়ন নির্যাতনের মাধ্যমে সারা দেশে এক নারকীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। জাতিসংঘের মানবাধিকবার কমিশন বলেছে, ‘স্বল্প সময়ে ইতিহাসের ভয়াবহতম গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে বাংলাদেশে’। দ্বিতীয় বিশ্বযুুদ্ধের পর কোন দেশে এরূপ গণহত্যার নজির নেই। বাঙালি জাতি পাকিস্তানিদের এরূপ ভয়াবহ নির্যাতনের চরম প্রতিশোধ নিয়েছে সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামে পাকিস্তানি সৈন্যদের পরাজিত করে বিজয় অর্জনের মাধ্যমে।
এখন প্রয়োজন পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর গণহত্যার ব্যাপারে জাতিসংঘের স্বীকৃতি। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত বিগত শতাব্দীতে ভিয়েতনাম, কম্পুচিয়া, চিলি, কাসাভো, বুরুন্ডির গণহত্যার বিচার করেছে। রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর গণহত্যা ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে শুনানি চলছে। একশ বছর আগে সংঘটিত আর্মেনিয়ার গণহত্যার স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘ। কিছুদিন আগে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত ফিলিস্তিন ভূÑখ-ে হত্যা ও নির্যাতনের তদন্ত শুরু করেছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী ও তাদের দোসরদের ‘গণহত্যা’ ও ‘মানবতাবিরোধী’ কর্মকা-কে জাতিসংঘ ‘ভয়াবহ অপরাধ ও গণহত্যা’ হিসেবে স্বীকৃতি দিলে বিশ্ববাসীর সামনে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অত্যাচার নির্যাতনের নারকীয় রূপ উদঘাটিত হবে। এটি বিশ্বসভ্যতা ও মানবতার স্বার্থেই জরুরি।
গণহত্যার প্রতি জাতিসংঘ ও বিশ্ববাসীর স্বীকৃতি পেতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কূটনৈতিক প্রচারণা চালাতে হবে। দেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের দোসরদের নির্যাতনের তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করা প্রয়োজন। এ জন্য জেলা পর্যায়ে তথ্য অনুসন্ধানী টিম গঠন করা জরুরি। দেশে বিশ্বমানের গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সম্মুখযুদ্ধের স্থানসমূহে স্মারকস্তম্ভ নির্মাণ, বধ্যভূমি সংরক্ষণসহ স্বাধীনতা সংগ্রামের ঐতিহাসিক ঘটনাসমূহ সমুজ্জ্বল করে তুলতে হবে।
স্বাধীনতা সংগ্রামে শহীদদের আত্মদান, বীরত্বগাথা এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত বাঙালির পর্যায়ক্রমিক আন্দোলনÑসংগ্রামের ইতিহাস প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে নিয়ে যাওয়া জাতির অগ্রগতির স্বার্থেই প্রয়োজন। মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীকে কেন্দ্র করে দেশে ও বিদেশে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও দেশবাসীর বীরত্ব ও ত্যাগের ইতিহাস বিশ্ববাসীকে জানাতে বহুমুখি কর্মকা- পরিচালনা করা প্রয়োজন।
মতামত সম্পাদকীয়