বিবিসি বাংলা »
বাংলাদেশের খ্যাতিমান শিক্ষক, লেখক ও জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ঢাকার সম্মিলিতি সামরিক হাসপাতালে মারা গেছেন। তিনি বেশ কিছুদিন ধরে হার্ট ও কিডনির জটিলতা কারণে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নিয়েছিলেন কিন্তু সাহিত্য– গবেষণা, লেখালেখি ও সাংগঠনিক কার্যক্রমের জন্য তাঁর ভূমিকা ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে উল্লেখ করা হয়েছে।
আনিসুজ্জামানের রচিত ও সম্পাদিত বহু বাংলা ও ইংরেজি বই, শিল্প–সংস্কৃতি ও ইতিহাসের বিবেচনায় খুবই গুরুত্ব বহন করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলছিলেন সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতি ভাবনার ক্ষেত্রে চেতনার বাতিঘরের ভূমিকা পালন করেছেন তিনি।
“একজন শিক্ষক,একজন সমাজ–মনস্ক মানুষ, প্রগতিশীল চিন্তার অধিকারী একজন অনন্য সাধারণ মানুষ হিসেবে তাকে আমরা সব সময় বিবেচনা করি,” বলছিলেন মি.হোসেন।
১৯৬১ সালের রবীন্দ্র জন্ম–শতবর্ষ অনুষ্ঠানে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। ১৯৬৭ সালে একটি খবর ছাপা হয়– রবীন্দ্রনাথের গান পাকিস্তানের জাতীয় ভাবাদর্শের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় বলে বেতার ও টেলিভিশন কর্তৃপক্ষকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রচার হ্রাস করতে বলা হয়। এর প্রতিবাদে বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে বিবৃতিতে আনিসুজ্জামান স্বাক্ষর সংগ্রহ করেন এবং সেটা বিভিন্ন কাগজে ছাপতে দেন।
লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমেদ বলছিলেন সেই সময় থেকেই আনিসুজ্জামান তাঁর ভূমিকার জন্য মধ্যবিত্ত বাঙালির সংস্কৃতির আন্দোলনের অগ্রগণ্য পথিকৃৎ হয়ে দাঁড়ান।
সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলছিলেন “দেশের প্রতিটি সংকটকালে তাঁর বক্তব্য, মন্তব্য এবং ভূমিকা দিকনির্দেশক হিসেবে কাজ করেছে“।
আনিসুজ্জামান ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ই ফেব্রুয়ারি কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। ৪৭–এর দেশভাগের পর তাঁর পরিবার প্রথমে বাংলাদেশের খুলনাতে আসেন। পরে ঢাকায় স্থায়ী হন। ১৯৫৬ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অনার্স ও ১৯৫৭ সালে এম.এ. পাস করেন। এরপর মাত্র ২২ বছর বয়সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন।
‘আনিসুজ্জামান ছিলেন সমাজের চেতনার বাতিঘর‘
১৯৬৯ সালের জুন মাসে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের রিডার হিসেবে যোগ দেন। অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন বলছিলেন বাংলা একাডেমির বাংলা বানান রীতির অভিধানসহ যেকোন প্রকল্পে তাঁর অবদান ছিল সীমাহীন।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন–সংগ্রামে অবদান রেখেছেন ড. আনিসুজ্জামান। ১৯৭১ সালে মুজিব নগর সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ছিলেন তিনি।
১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধান বাংলা ভাষায় অনুবাদের যে কমিটি ছিল সেটার নেতৃত্বে ছিলেন তিনি।
এছাড়া ১৯৯১ সালে গঠিত গণ আদালতের একজন অভিযোগকারী ছিলেন তিনি। মহিউদ্দিন আহমেদ বলছিলেন তখনকার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া মোটেই সহজ কাজ ছিলো না।
তিনি বলছিলেন “বাংলা ভাষার উপর দখল থাকার ব্যাপার না, পুরো বাংলাদেশের স্পিরিটটা, মানুষের আশা–আকাঙ্ক্ষা, সংবিধানে ব্যবহৃত বিভিন্ন শব্দের তাৎপর্য, উৎপত্তি বোঝার মত যে ক্ষমতা থাকা দরকার সেটার অভাব মেটাতে পেরেছিলেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান“।
শিক্ষা, শিল্প–সাহিত্য, সাংগঠনিক ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ,একুশে পদক সহ অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
তিনি শিল্পকলা বিষয়ক ত্রৈমাসিক পত্রিকা ‘যামিনী‘ এবং বাংলা মাসিকপত্র ‘কালি ও কলম‘-এর সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।