দ্বীন মোহাম্মাদ দুখু :
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হওয়ার উপক্রম। আজও উনুন জ্বলেনি রহিমের ঘরে। ছেলেপুলের পেট যেন পিঠের সাথে লেগে আছে। প্রায় দুদিন পানি আর শুকনো চিড়া খেয়ে পার করছে রহিম ও তার স্ত্রী। বাড়ি-বাড়ি থেকে এটা-সেটা চেয়ে ছেলেপুলের সামান্য ক্ষুধা নিবারণের চেষ্টা করছে রহিম দম্পতি। ছোট ছেলেকে নিয়ে পড়েছে মহাবিপদে। দুধ ছাড়া যে ছেলেটা কিছুই খেতে পারে না। ছেলের কান্না সইতে না পেরে রহিমের বউ চুরি করে বসলো। দুধচুরি। পুবপাড়ায় রাখালেরা ছাগল চড়ায়। দুপুর গড়ালে রাখাল গাছের তলায় তন্দ্রা যায়। সেই সুযোগে রহিমের বউ ছাগলের দুধচুরি করে। অবশ্য প্রথম দুবাচ্চার মা হওয়ার পর দুধ কিনতে হতো না। তখন বুকে পর্যাপ্ত দুধ থাকতো। পুষ্টিহীনতায় ভুগে পাঁচ সস্তানের জন্ম দিতে গিয়ে বউটার এখন এমন দশা। রহিম ঘরে ফিরে দেখলো দুধের বাটিতে ত্যানা ভিজিয়ে চিপে বউ ছেলের মুখে দুধ তুলে দিচ্ছে।
দুধ কোথা থেকে আসলো, জানতেও চাইলো না রহিম।
কোনো ব্যবস্থা হলো? কি আর হবেরে বউ! মাছধরা ছাড়া যে আর কিছুই পারি না। বাপদাদার থেকে পাওয়া এই পেশা আর অভাবটাই তো পেয়েছি।
তবে মিয়াবাড়ির বড়মিয়া কইছে, নিষিদ্ধ এই মৌসুমেও খিদিরপুরচরে সে মাছধরার ব্যবস্থা করে দিতে পারবে।
দুখান শর্ত আছে। পয়লা ধরো, বড়মিয়া নিজের জাল দিবে না। আর সাতখান মাছ পাইলে চারখান মিয়ারে দিতে হইবো। ভাবছি সন্ধ্যায় নামাজ পরেই রওনা দিবো। ভবেশ পূজা শেষ করে মন্দিরের সামনে দাঁড়াবে। তারপর মিনিট চল্লিশেক দাঁড় টেনে খিদিরপুর পৌঁছাতে হবে।
দুচার মুঠো চিড়ে নিয়ে যেয়ো টেটনের বাপ।
চিড়ে খাওয়ার সময় কি পাইবোরে বউ?
নিষিদ্ধ সপ্তাহ থাকায় ইলিশ নদীতে গিসগিস করছে।
বড়মিয়ার জাল হইলে কি যে হইত রে ভবেশ!
আমাগো ছেঁড়া জাল দিয়ে কি আর ইলিশ ধরন যায়? গরিবের কপালরে ভবেশ্যা!
ভোর চারটা পর্যন্ত জাল টেনে তেইশখান মাছ পেল রহিম ও ভবেশ।
পুব আকাশ লাল হতে না হতে বড়মিয়ার ট্রলার হাজির। ছোঁ মেরে তেরোখান ইলিশ নিয়ে চলে গেল। পাঁচখান ভবেশকে দিয়ে দাঁড় টেনে গঞ্জের দিকে ছুটলো রহিম ও ভবেশ।
গঞ্জে পৌঁছে ভবেশ ইলশের পোঁটলা বগলদাবা করে কাঁথামুড়ি দিয়ে হাটের ভিড়ের মধ্যে মিলিয়ে গেল।
রহিম গিয়ে দাঁড়ালো হাটের পশ্চিম কোণে কবরস্থানের গলিতে।
যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে রাত পোহায়। কথাটি আজ রহিম হাড়ে-হাড়ে বুঝতে পারল।
মাছের পোঁটলা খুলতেই দুই শৃঙ্খলা হাজির।
রহিমকে লাঠি, চড়-থাপ্পড়ের ভয় দেখিয়ে দুখান ইলিশ নিয়ে গেল দুই শৃঙ্খলা।
ইলিশের গন্ধ ওদের বড়বাবুর নাকেও পৌঁছে গেল।
বড়বাবু তৎক্ষণাৎ কবরস্থানের গলিতে পৌঁছে গেলেন। গিয়েই চোখ বুজে লাঠি দিয়ে পিঠের ছাল তুলে নিল রহিমের। তিনখান ইলিশ ছিনিয়ে নিলো। একখান নিজের বাসায় পাঠালো।
দুখান ইলিশ জাটকা হিসেবে জব্দ করে রহিমকে জেলে পুরে দিল।
জেলের মধ্যে বড়বাবুর সাথে রহিমের দুমিনিট কথা হলো-
রহিম, তোমাকে ছেড়ে দেবো। যদি আমি যা যা বলি তা তা মেনে নাও।
বাবু গো, আমি সব শর্তে রাজি। বড়মিয়ার ছোটভাই পরশমিয়া হাতেনাতে জাটকাসহ হাকিমের হাতে ধরা খাইছে।
পরশমিয়ার দায় যদি নিজের কাঁধে নাও, তবে তোমার বউ-পোলা ভালো থাকবে। তুমিও জামিনে খালাস পাবা।
বড়বাবু পরশমিয়াকে বাইরে বের করে দিল।
রহিমকে রাখলো পরশমিয়ার সেলে।
দিন গিয়ে রাত এলো।
রহিমের বউ দৌড়ে গেল মিয়াবাড়ি।
বড়মিয়া বললো, তোমার স্বামীকে মাছ ধরতে চাঁদপুর পাঠাইছি। ফিরতে কয়েক মাস লাগবে।
টাকা-পয়সা আর যা যা লাগে পরশের কাছ থেকে নিয়ে যাবা, কেমন?
আচ্ছা, বড়মিয়া।
তিন মাস গিয়ে নয় মাস চলে গেল।
এখনো রহিম ফেরেনি।